সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পদ

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

লন্ডনের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় একটি প্রপার্টি ২০২২ সালে ১১ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি হয়। রিজেন্ট পার্ক থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে এই প্রপার্টির অবস্থান। বিখ্যাত লর্ডস ক্রিকেট স্টেডিয়ামের অবস্থানও এর ঠিক পাশেই। লন্ডনের সবচেয়ে দামি এলাকাগুলোর মধ্যে এটি একটি। এই প্রপার্টিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু সাদা রংয়ের বাড়ি। বাড়িগুলোতে যে জানালা আছে, এর বিস্তার মেঝে থেকে একেবারে ছাদ পর্যন্ত। সর্পিলাকৃতির সিঁড়িগুলো উঠে যায় উপরের কয়েক তলা পর্যন্ত। সেই সঙ্গে আছে সিনেমা হল ও জিমনেসিয়াম।

এই প্রপার্টির মালিক বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে তিনি গড়ে তুলেছেন রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য। গত রোববার ব্লুমবার্গ নিউজের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

যুক্তরাজ্যে কোম্পানি হাউসের করপোরেট অ্যাকাউন্ট, বন্ধকি চার্জ এবং এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে।

সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটসে আবাসন—যেখানে ইংল্যান্ডের বৃহত্তম বাংলাদেশি কমিউনিটির আবাসস্থল এবং লিভারপুলে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ভবন।

নিউইয়র্কে সদর দপ্তর থাকা আন্তর্জাতিক এই সংবাদ সংস্থা যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রায় আড়াইশ প্রপার্টির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, যখন এই প্রপার্টিগুলো কেনা হয়, তখন যুক্তরাজ্যজুড়ে তীব্র আবাসন সংকট চলছিল এবং এর ৯০ ভাগই ছিল সদ্য তৈরি নতুন বাড়ি।

এই লেনদেনগুলো এমন এক সময়ে করা হয়েছিল, যখন রুশ ধনকুবেররা খুব সহজেই তাদের সম্পদ যুক্তরাজ্যে লুকিয়ে রাখতে পারছে—এমন সমালোচনার মুখে ব্রিটিশ সরকার সম্পত্তির বিদেশি মালিকানায় আরও স্বচ্ছতা দেখাতে চাইছিল। ইউক্রেনে মস্কোর আগ্রাসনের পর যা আরও জরুরি হয়ে ওঠে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা বলছেন, তার এসব সম্পত্তির কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, রাজনীতিবিদদের সম্পৃক্ততা আছে এমন লেনদেন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের আইন আদৌ কার্যকর কি না।

ব্লুমবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে সাইফুজ্জামানের অন্তত পাঁচটি প্রপার্টি খুঁজে পেয়েছে। মিউনিসিপ্যাল প্রপার্টির নথি অনুসারে, এসব সম্পত্তি ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ছয় মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে।

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে পুননির্বাচিত হলেও মন্ত্রিসভায় তার পদ হারান। তবে তিনি সংসদীয় জমি সংক্রান্ত কমিটির সভাপতির পদে আছেন।

যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদের ব্যাপারে গত ২৯ ডিসেম্বর দ্য ডেইলি স্টার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। যুক্তরাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কোম্পানি ফাইলিংয়ের তথ্য থেকে এ হিসাব পায় ডেইলি স্টার।

এতে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে অন্তত ২৬০টি সম্পত্তি রয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর। এসবের জন্য তিনি পরিশোধ করেছেন কমপক্ষে ১৩৪ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন পাউন্ড বা এক হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা।

আওয়ামী লীগ থেকে তিনবারের সংসদ সদস্য (এমপি) সাইফুজ্জামান যুক্তরাজ্যের সম্পদের বিপরীতে আরও অন্তত ৫৩৭টি মর্টগেজ রেখেছেন। সম্পদগুলোর বেশিরভাগই লন্ডনে। তবে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) দেওয়া হলফনামার সঙ্গে তিনি যে আয়কর রিটার্ন দিয়েছেন, সেখানে তার কোনো বিদেশি আয় নেই জানিয়েছেন।

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ডিসেম্বরে প্রাক-নির্বাচনী ঘোষণায় সাইফুজ্জামান তার মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫৮ দশমিক তিন মিলিয়ন টাকা (দুই দশমিক চার মিলিয়ন ডলার) এবং তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের মোট সম্পদের পরিমাণ নয় লাখ ৯৩ হাজার ডলার বলে জানান। তিনি বাংলাদেশে সম্পদের ঘোষণাপত্রে তার যুক্তরাজ্যের সম্পদের পরিমাণ দেখাননি। মন্ত্রী হিসেবে ২০২২-২৩ সালে তার বেতন প্রায় ১০ হাজার পাউন্ড হিসাবে দেখানো হয়।

ব্লুমবার্গ বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হকের সঙ্গে কথা বলছে। তিনি সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য না করে বলেন, 'বাংলাদেশে বসবাসরত অবস্থায় একজন ব্যক্তির বিদেশে সম্পদ অর্জনের কোনো বিধান নেই। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, আমরা ব্যক্তিদের এ ধরনের কিছু করার অনুমতি দিই না।'

সাইফুজ্জামান যুক্তরাজ্যের ২০১৭ সালের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং আইনে সংজ্ঞায়িত 'পলিটিক্যালি এক্সপোজড পারসন (পিইপি)' ক্যাটাগরিতে পড়েন। এটি যুক্তরাজ্যে ব্যবসায়িক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত সম্পত্তির এজেন্ট, ঋণদাতা, প্রপার্টি আইনজীবী এবং অন্যদের ওপর পিইপি শনাক্ত করার কাজ করে।

এইসব ব্যক্তি সম্পত্তি কেনার মতো ব্যবসায়িক লেনদেনে নিযুক্ত থাকলে তাদের সম্পৃক্ততা অতিরিক্ত তদন্তের দাবি রাখে।

ব্লুমবার্গ তাদের প্রতিবেদনে উল্লিখিত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, যাদের মধ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর জন্য সম্পত্তি কেনার সঙ্গে জড়িত আর্থিক সেবা ও আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে।

যে সংস্থাগুলো এর জবাব দিয়েছে তারা জানায়, এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। তবে বাণিজ্যিক গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে বিস্তারিত মন্তব্য দেয়নি তারা।

ডেইলি স্টার গতকাল সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন কল করলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তার নম্বরে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব আসেনি।

বাংলাদেশের বাইরে তার সম্পত্তির মালিকানা বা তার সম্পদের ঘোষণা নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে ব্লুমবার্গও কোনো সাড়া পায়নি।

গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একজন মন্ত্রীর বিদেশে ২০৩ বিলিয়ন টাকার ব্যবসার বিষয়টি প্রথমবারের মতো সামনে আনে। যদিও টিআইবি কোনো মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেনি, তবে তারা বলেছে, কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ যদি তথ্য চায়, তাহলে তারা এর প্রমাণ দিতে প্রস্তুত।

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

8h ago