‘বাস পোড়ায়া দিতেছে, মনডা খারাপ’
রোববার সকাল ৮টায় সাইনবোর্ড মোড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে দাঁড়ানো 'গ্রীন অনাবিল' পরিবহনের একটি বাস৷ সাইনবোর্ড থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা যাত্রী পরিবহন করে বাসটি৷ ফাঁকা বাসের ভেতর বিমর্ষ ও উদাস ভঙ্গিতে যাত্রী আসনে বসে আছেন চালক রুবেল মিয়া।
পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে রুবেল বলেন, 'এইখানে কালকে একটা বাস পুড়ছে। মনডা ভাই ভালো না৷ কথা বলতে ইচ্ছা হয় না।'
শেরপুর জেলার বাসিন্দা রুবেল থাকেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে৷ সাত সদস্যের পরিবারে তিনিই একমাত্র উপার্জনকারী৷ ছোটভাই মো. রাজু কলেজে পড়েন। পাশাপাশি একটা ছোট চাকরি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালান।
বিএনপি-জামায়াতের দ্বিতীয় দফায় ডাকা অবরোধের প্রথম দিন আজ। গত তিন দিনের অবরোধ ও একদিনের হরতালে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাত্রীবাহী বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ এ নিয়ে শঙ্কা বেড়েছে রুবেলের।
'প্রতিদিনই বের হইসি, প্রতিদিনই বের হইতে হয়। আমার উপরে সাত জন মানুষ চলে। আমি তো বইসা থাকতে পারি না। আমরা এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়া গাড়ি চালাই। রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর করে, আগুন দেয়৷ কারা দেয়, ক্যান দেয় বুইঝা উঠতে পারি না।'
হতাশা প্রকাশ করে এ বাসচালক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাসা থেকে বাইর হইতে মানা করে কিন্তু সেই মানা তো শোনা যায় না৷ সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকি৷ পুলিশ রাস্তায় আছে কিন্তু কাজ তো হইতেছে না৷ তারপরও তো রাস্তায়, গাড়িতে আগুন জ্বলতেছে।'
দ্বিতীয় দফার অবরোধের প্রথম দিনে সকাল থেকে সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের পাশাপাশি যাত্রীও ছিল কম৷ অবরোধের মধ্যেও যাদের সড়কে দেখা গেছে তাদের ভাষ্য, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সবাই আতঙ্কিত৷ তারপরও বের হয়েছেন কেবল জীবন ও জীবিকার তাগিদে।
তাদেরই একজন ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস। কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাবেন।
'সাইনবোর্ড আছি৷ টেনশন কইরো না, মা' বাসের জন্য অপেক্ষারত এ চিকিৎসক ফোনের অপর প্রান্তে মাকে আশ্বস্ত করছিলেন।
জান্নাতুল বলেন, বাড়িতে তার ১৫ মাসের মেয়ে আছে৷ শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিনই তাকে কর্মস্থলে থাকতে হয়৷ একে তো সরকারি চাকরিজীবী অন্যদিকে চিকিৎসক, রোগীদের চিন্তা করলে হরতাল-অবরোধের অজুহাত তার ক্ষেত্রে চলে না।
'বাড়ির মানুষ সারাক্ষণ টেনশনে থাকে৷ অবরোধের কারণে রাস্তায় বাস কম। অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হচ্ছে, এটাও তো একটা প্রবলেম। এ রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে সকলেই মুক্তি চায়', যোগ করেন তিনি।
সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট; এ দুই মহাসড়ক সরেজমিনে ঘুরেছেন দ্য ডেইলি স্টারের এ প্রতিবেদক। দূরপাল্লার বাস চলাচল খুবই কম ছিল মহাসড়ক দু'টিতে৷ অল্প দূরত্বে চলাচলকারী বাসগুলোও স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেক চলাচল করতে দেখা গেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, শিমরাইল ও কাঁচপুরের তিনটি বাসস্ট্যান্ডে দূরপাল্লার বাসগুলোর কাউন্টারগুলো ছিল বন্ধ। কয়েকটি কাউন্টার খোলা দেখা গেলেও পরিবহন সংশ্লিষ্ট কর্মীরা বলছেন যাত্রী সংকটের কথা।
'মেঘনা সুপার' পরিবহনের বাস ঢাকা থেকে কুমিল্লার মেঘনা পর্যন্ত চলাচল করে৷ সাইনবোর্ডে বাস কাউন্টারে কথা হয় মো. ফাহাদের সাথে।
তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ে গুলিস্তান থেকে যাত্রী নিয়ে সকাল ৬টার মধ্যে এ কাউন্টারে এসে থামে বাসটি। আজ সাড়ে ৮টা বেজে গেলেও বাসের দেখা নেই৷ যাত্রী কম থাকার কারণে বাস ছাড়তে দেরি করছে বলে জানান ফাহাদ।
সাইনবোর্ডে এ বাসস্ট্যান্ডে চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলার বাস ছাড়ে৷ অন্তত ৩০টি পরিবহনের টিকেট কাউন্টার আছে এখানে৷ কিন্তু একমাত্র ফাহাদ ছাড়া বাকি কোন কাউন্টারে কোন পরিবহনের কর্মীর দেখা মেলেনি।
'এমন সময় যাত্রী আর কাউন্টারের লোকজনের হাকডাকে স্ট্যান্ড থাকে রমরমা। অফিস যাত্রীর পাশাপাশি অন্য যাত্রীদেরও ভিড় থাকে৷ কিন্তু এখনকার চিত্র তো দেখছেনই', ফাহাদ বলেন।
সকাল পৌনে ৯টায় একটি বাস এসে থামে সাইনবোর্ডে৷ তাতে চেপে বসেন দুই জন যাত্রী৷ তাদের দু'জনের একজন সরকারি কর্মকর্তা, অপরজন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দু'জনই এ রুটের নিয়মিত যাত্রী।
ফাহাদ বলেন, 'অথচ এ সময় অন্তত ২০ জন যাত্রী ওঠে এখান থেকে৷ সিট না পেয়ে অনেকে দাঁড়িয়ে যেতেও রাজি হয়।বাসমালিক লোকসান গুণতেছে, এতে আমাদের বেতন নিয়াও ঝামেলায় পড়তে হবে৷'
একদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া গতি, অন্যদিকে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক এমন পরিস্থিতি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেন যাত্রী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা৷ সুষ্ঠু রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চান তারা। যাতে এ জ্বালাও-পোড়াও থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
'ছোট একটা চাকরি করি। দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে যে বেতন পাই, তাতে হচ্ছে না। শুধু আমি কেন, সবারই কষ্ট হচ্ছে। তার উপরে বাসায় বসে থাকলে তো বেতন দিবো না। চাকরি বাঁচাইতে কষ্ট হইলেও কর্মস্থলে যেতে বাধ্য,' বলেন ফাহাদ।
মতিঝিলে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি।
আসন্ন সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের বৃহৎ দু'টি রাজনৈতিক দলের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়েন আব্দুল ওয়াদুদ। নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড় এলাকার এ বাসিন্দা চাকরি করেন মহাখালীর একটি বিমা কোম্পানিতে।
তিনি বলেন, বড় দুই দলের জন্য আমাদের অবস্থা খারাপ। সবকিছুর দাম বাড়তেছে, আর দুই দলই আছে ক্ষমতা নিয়ে ব্যস্ত৷ আলুর কেজি ৬০ টাকা, পেঁয়াজের কেজি ১৫০ টাকা৷ এইটার কোনো প্রতিকার নাই।'
এদিকে দ্বিতীয় দফা অবরোধের প্রথমদিনে নারায়ণগঞ্জ জেলায় ভোর থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কোথাও সহিংসতা বা যানবাহনে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া যায়নি। কয়েকটি স্থানে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ঝটিকা মিছিল করেছেন। মিছিল থেকে টায়ারে আগুন দিয়ে সড়ক অবরোধের চেষ্টা হয়েছে। তবে পুলিশ তৎপরতায় অবরোধের চেষ্টা সফল হয়নি।
এদিকে মহাসড়কে বিজিবির টহল দেখা গেছে৷ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরাও।
এদিকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত গত ১২ ঘণ্টায় নাশকতার অভিযোগে বিস্ফোরক দ্রব্য ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নতুন-পুরোনো মামলায় বিএনপির অন্তত ১৩ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) চাইলাউ মারমা।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'দ্বিতীয় দফায় বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দিনে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। কোথাও কোনো গোলযোগের খবর নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও রয়েছে৷ টহল রয়েছে র্যাব-বিজিবির।'
Comments