আলী রীয়াজের বিশ্লেষণে ভিসা নিষেধাজ্ঞা ইস্যু

ভিসা নিষেধাজ্ঞা

বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের তিন মাস আগে নতুন ভিসা নীতির কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও বিরোধী দলের সদস্যরা।

ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপে যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত, এর সম্ভাব্য প্রভাব এবং এ বিষয়ক প্রতিক্রিয়া নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আলী রীয়াজ।

দ্য ডেইলি স্টার: বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না—এমনটি ধরে নিয়েই কি যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের তিন মাস আগে নতুন ভিসা নীতি প্রয়োগ করতে শুরু করল?

আলী রীয়াজ: প্রথম কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গত শুক্রবার ভিসা নীতি কার্যকরের ঘোষণাটা আসায় আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে ওইদিন থেকেই এটা কার্যকর হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, আসলে আগে থেকেই এটা কার্যকর করতে শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। এটা আমরা বুঝতে পারি যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন যে তারা বিষয়টি জানেন, তালিকা তাদের দেওয়া হয়েছে। সেটা তারা লক্ষ্য করছেন।

সুতরাং, এই মুহূর্তেই এটা শুরু হয়েছে, তা না।

আবার নির্বাচনের আগেই এই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, তারা নীতিটা ঘোষণা করেছেন মে মাসে। তখন পর্যন্ত কবে নির্বাচন হবে, সেটা কেউই জানতেন না। এখনো জানেন না। ফলে নির্বাচনের আগেই তারা যে কার্যক্রম শুরু করবেন, সেটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।

গত দেড়-দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের যত প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে গেছেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সঙ্গে যত ধরনের আলোচনা হয়েছে, সবখানেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে এখনকার ব্যবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নন। যদি তারা নিশ্চিত হতেন তাহলে তো আর এই প্রশ্নগুলো উঠতই না যে নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করুন, সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করুন। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই এটা স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন মনে করে—যে পরিস্থিতি বিদ্যমান আছে সেটা সবার অংশগ্রহণে একটা অবাধ নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত নয়। তারা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ দিচ্ছেন, অনুরোধ করছেন।

ডেইলি স্টার: এই উদ্যোগের পেছনে কি বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাই কাজ করেছে, নাকি আরও কোনো কৌশলগত হিসেব-নিকেশ এখানে আছে?

আলী রীয়াজ: এ দুটো কোনো বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত বিষয় নয়। বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের যে কৌশলগত স্বার্থ, তা দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত। ফলে অন্য উদ্দেশ্যে করেছে এইভাবে না ভেবে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে যা দেখতে চায় এবং এই অঞ্চলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে যেভাবে বিবেচনা করে, তার আলোকেই মূলত এসব সিদ্ধান্ত ও নীতিমালাগুলো তৈরি হচ্ছে। এটা আলাদা করে হচ্ছে না।

বাইডেন প্রশাসনের লক্ষ্যই হচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নটাকে প্রাধান্য দেওয়া। সর্বত্রই তারা সেটা করছেন—আমি তা বলব না। কিন্তু যে জায়গায় তাদের কৌশলগত স্বার্থ, জাতীয় স্বার্থ এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন জড়িত, সেখানে তারা এই নীতিমালা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন।

ফলে এগুলো মোটেই বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কিছু নেই। প্রত্যেকটা দেশই তার জাতীয় স্বার্থ ও কৌশলগত বিবেচনাকে সঙ্গে রেখেই বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নেয়। প্রত্যেকটা উদ্যোগই একটা আরেকটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা তো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ধরুন, যুক্তরাষ্ট্রের এই আকাঙ্ক্ষা নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেই। ধরুন অন্য কোনো দেশের নেই। বাংলাদেশের নাগরিকদের গত দুই নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই কি বাংলাদেশের মানুষদের দাবি নয় যে, তারা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চান।

এখন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের দাবি করে বলা হচ্ছে, এই সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ নেই। এটা সব রাজনৈতিক দল বলছে। সম্প্রতি একটি মার্কিন সংস্থার জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ মানুষই বলেছেন যে এখনকার ব্যবস্থায় তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখেন না।

সেটার প্রয়োজন, তাগিদ ও ব্যবস্থাপনা কী হবে সেটাই সরকারকে করতে হবে। নাগরিকের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যা করা প্রয়োজন, সেটা করা সরকারের দায়িত্ব।

ফলে যুক্তরাষ্ট্র কী বলল, কী বলল না—তারচেয়েও বড় হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্ন, প্রত্যাশার প্রশ্ন ও আকাঙ্ক্ষার প্রশ্ন। সেই বিবেচনায়, যেহেতু এই ব্যবস্থার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাচ্ছে না, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা যাচ্ছে না, তাই পথ একটা বের করতে হবে।

ডেইলি স্টার: জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরুর প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাইরে থেকে নির্বাচন বানচাল করা হলে বাংলাদেশের জনগণও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

আলী রীয়াজ: বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে যে কারোর ওপরেই ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও করতে পারে, ভারতের ওপরও করতে পারে, চীনের ওপরও করতে পারে, বেলারুশের ওপরও করতে পারে। এটা বাংলাদেশের অধিকার।

কিন্তু কেন করবে? যদি তার জাতীয় স্বার্থের জন্য সেটা প্রয়োজন হয়। তাহলে আওয়ামী লীগ কি এটা জাতীয় স্বার্থের জন্য করবে, না কি দলীয় বিবেচনায় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য করবে? জাতীয় স্বার্থে কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা কিংবা অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা হতেই পারে। জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় যদি এটা করা হয়, তাহলে মানুষ সেটা সমর্থন করবে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক, সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করা হচ্ছে এসব কথাবার্তা বলে। আমরা দেখতে পাই যে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন প্রয়োজনে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। সেটা রোহিঙ্গা সংকট বলুন, কোভিড-১৯ বলুন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বলুন, নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রে বলুন। এসব ক্ষেত্রে যে সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো আছে, জাতীয় স্বার্থে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কেবল রাজনৈতিক রেটোরিক দিয়ে এটাকে মোকাবিলা করার বিষয়টি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি হবে।

ডেইলি স্টার: ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বক্তব্য হলো, এ কারণে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না। তার এই বক্তব্য কতটা বাস্তবসম্মত?

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যদি সম্পর্কের টানাপড়েন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যা পরস্পরের মধ্যে আরও দূরত্ব তৈরি করবে, তাহলে তার প্রভাব সর্বত্রই পড়বে। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে পড়বে, নিরাপত্তা সহযোগিতায় পড়বে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পড়বে—বিভিন্ন মাত্রায় পড়বে। ওনারা যেভাবেই দেখুক, এটা পড়তে বাধ্য।

ডেইলি স্টার: ভিসা নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই সেলফিতে রাজনীতির সব 'ফয়সালা' হয়ে গেছে। বিষয়টি কি এতটাই সরল?

আলী রীয়াজ: ছবি তুলেই যদি কূটনীতি নির্ধারিত হতো, একবেলা কথা বলার মধ্য দিয়েই যদি কূটনীতি নির্ধারিত হতো, তাহলে তো দেশগুলোর এত বড় বড় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাকার প্রয়োজন হতো না।

অনেক বিবেচনার মধ্য দিয়েই পররাষ্ট্র নীতি তৈরি হয়, সব দেশেই। বাংলাদেশের জন্য যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও তাই কিংবা বুরুন্ডির ক্ষেত্রেও তাই। অনেক কিছু বিবেচনা করেই পররাষ্ট্রনীতিটা তৈরি হয়, সম্পর্ক তৈরি হয়, বিকশিত হয়।

কার সঙ্গে কার দেখা হলো, ছবি তোলা হলো কি না—এগুলো এখানে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে না। এগুলো কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচার।

Comments

The Daily Star  | English

World approves $300 bn for poor nations in climate deal

Nearly 200 nations approved Sunday a climate deal that raises to at least $300 billion a year the amount wealthy historic polluters pay poorer countries to take action against global warming

1h ago