‘উপাচার্য পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ’

‘সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো বেশিরভাগ জায়গায় এখন এরাই লিড করছে। বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ পদে এরাই রয়েছে। সেটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।’

২০২২ সালের শুরুতে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলি ও লাঠিপেটার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা।

ওই আন্দোলন চলাকালীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে করা আপত্তিকর মন্তব্যের জেরে প্রবল সমালোচিত হয়েছিলেন এ উপাচার্য। এবার নিজ বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আবারও বেফাঁস মন্তব্য করে আলোচনায় এসেছেন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।

গতকাল বুধবার শাবিপ্রবির মিনি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে ফরিদ উদ্দিন বলেন, 'সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়, এখানে (শাবিপ্রবি) ওপেন কালচার ছিল, ছেলেমেয়েরা যা খুশি, তাই করতে পারত। কেউ কিছু বলতে পারত না। কারণ, তাদের বয়স ১৮ বছর। কিন্তু আমি বলেছি, সাড়ে ১০টার মধ্যে হলে ঢুকতে হবে। তারা (শিক্ষার্থীরা) এটার নাম দিয়েছে তালেবানি কালচার। তালেবানি কালচার নিয়ে আমি খুবই গৌরবান্বিত, এটা নিয়ে থাকতে চাই। আমি ওপেন কালচার চাই না।'

ফরিদ উদ্দিন আহমেদের এই বক্তব্য নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আলমগীর এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে।

তাদের মধ্যে ইউজিসির মুহাম্মদ আলমগীর ছাড়া প্রত্যেকে বলেছেন, উপাচার্যের মতো দায়িত্বশীল একটি পদে থেকে এমন 'দায়িত্বজ্ঞানহীন' বক্তব্য দিতে পারেন না অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তার এই বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। এর মধ্য দিয়ে তার যে মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে, তাতে এই পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন তিনি।

ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য নিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'এ ধরনের মন্তব্য একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এটা লজ্জাকরও। উনি তো কেবল একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নন, একজন শিক্ষকও বটে। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। উনি তো শিক্ষার্থীদের জানেন; জানেন কীভাবে তাদের সঙ্গে ওঠা-বসা করতে হয়।'

ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচার ও তালেবানি কালচার নিয়ে গৌরব বোধ করার যে কথাগুলো এসেছে সেটাকে 'চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য' অভিহিত করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, 'এমনিতেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নারী শিক্ষার্থীরা নানান রকম অসুবিধার মধ্য দিয়ে যায়। তাদের কোনো সাংস্কৃতিক জীবন নেই। তাদের নিরাপত্তা নেই। এর ওপর এই ধরনের মন্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।'

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষ্য, 'আমাদের কর্তব্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক করা। সেখানে ছেলে-মেয়েরা যাতে সাংস্কৃতিকভাবে নিজেদের সৃষ্টিশীল করে গড়ে তুলতে পারে তার বন্দোবস্ত করা।

'এগুলোর জন্য আমরা মনে করি যে, ছাত্র সংসদ থাকা দরকার। এগুলো নাই। এবং না থাকার ফলে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা, সৃজনশীলনা, ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গড়ে তোলা—এগুলোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। নজরটা সেদিকেই দেওয়া উচিত।'

এদিকে বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, 'এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা আছেন, তারা যখন এ সমস্ত কথাবার্তা বলেন, তখন কিন্তু আমাদের বুঝে নিতে হয় যে, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা কোথায় গেছে।'

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে কোনো সততা নেই মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, 'এটা এই কারণে যে, এরা মুখে বলে আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু যা যা বলে গেছেন, মুক্তিযুদ্ধ যে জন্য হয়েছিল, বাংলাদেশের অস্তিত্ব যে কারণে—এর সবকিছুর বিরুদ্ধে কথা বলে তারা।'

পাশাপাশি এ ধরনের ব্যক্তিদের 'ভণ্ড' হিসেবেও অভিহিত করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা। বলেন, 'সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো বেশিরভাগ জায়গায় এখন এরাই লিড করছে। বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ পদে এরাই রয়েছে। সেটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।'

এ পর্যায়ে ফরিদ উদ্দিন আহমেদের এমন বক্তব্যের নিন্দা জানান তিনি। বলেন, 'আমি মনে করি এমন নারীবিদ্বেষী ও ধর্মান্ধ মন্তব্য করে তিনি তার পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন।'

আর উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্যে 'জঙ্গিবাদকে' উৎসাহিত করার অনুষঙ্গ দেখেন বেলা'র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তার ভাষ্য, 'একটি সমাজে প্রগতিশীল মানুষ থাকবে, প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ থাকবে, রক্ষণশীল মানুষ থাকবে। সেখানে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। কিন্তু রক্ষণশীলতার নামে জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করার কি কোনো সুযোগ আছে?'

রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, 'উনি (ফরিদ উদ্দিন আহমেদ) যে মানসিকতার সমর্থনে কথা বলেছেন; ওনার নিজের ভাষ্য অনুযায়ী সেটা হচ্ছে তালেবানি মানসিকতা। তালেবানি মানসিকতার স্থান কি বাংলাদেশে হওয়ার সুযোগ আছে? যেহেতু আমাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে তালেবানি মানসিকতার বিকাশের কোনো সুযোগ নেই, সেহেতু তালেবানি মানসিকতার সমর্থন করেন এমন কোনো ব্যক্তিকে এত উচ্চ পর্যায়ে আসীন রাখার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।'

এমন পরিস্থিতিতে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে তার পদ থেকে কবে সরানো হবে—সরকারের প্রতি এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন রিজওয়ানা হাসান। বলেন, 'আমরা নাগরিকেরা জবাবদিহিতা চাইতে পারি সরকারের কাছ থেকে। এটা আমাদের অধিকার। তালেবানি মানসিকতার সমর্থন করেন, জঙ্গিবাদি মানসিকতা সমর্থন করেন এমন একজন ব্যক্তির বেতন-ভাতা আমরা কেন দেবো?'

গতকাল তথ্য অধিকার বিষয়ক যে সেমিনারে বিতর্কিত এই বক্তব্য দেন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আলমগীর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য হয়ে ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এমন বক্তব্য দিতে পারেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মদ আলমগীর এই প্রতিবেদককে বলেন, 'এটা আপনি তাকেই (ফরিদ উদ্দিন আহমেদ) জিজ্ঞেস করেন।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladeshi students terrified over attack on foreigners in Kyrgyzstan

Mobs attacked medical students, including Bangladeshis and Indians, in Kyrgyzstani capital Bishkek on Friday and now they are staying indoors fearing further attacks

4h ago