পূর্ব জুরাইনে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘ভয়াবহ’, জনসভা করবেন এলাকাবাসী
কাগজে-কলমে খোদ রাজধানীতে থাকলেও অনেকটা 'প্রান্তিক' জীবন কাটান জুরাইনের বাসিন্দারা। অপ্রতুল নাগরিক সুবিধা, দূষণের আধিক্য, সুপেয় পানির সংকট ও জলাবন্ধতার মতো নানা সমস্যার কারণে মাঝেমধ্যেই সংবাদ শিরোনাম হয় দক্ষিণ সিটির সবচেয়ে 'দারিদ্র্যপ্রবণ' এই এলাকাটি।
এবার পুরো মৌসুম আসার আগেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি 'ভয়াবহ' হয়ে ওঠায় সরকারিভাবে অস্থায়ী হাসপাতাল খুলে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি এডিস মশা নির্মূলে জরুরি উদ্যোগ নেওয়ার দাবিতে জনসভা করতে যাচ্ছেন পূর্ব জুরাইনের বাসিন্দারা।
আগামীকাল শুক্রবার বিকেল ৫টায় পূর্ব জুরাইনের মিষ্টির দোকান এলাকায় 'আমরা ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে চাই' ব্যানারে এই জনসভা হওয়ার কথা আছে।
জুরাইনের বাসিন্দারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের 'চরম অবহেলা' তাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ২০২১ সালেও জুরাইনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২০ জনের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন। এ দফায় পুরো মৌসুম না আসতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে এবারের পরিস্থিতি আগের চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, গত কয়েকদিনে জুরাইন এলাকায় মশক নিধন কার্যক্রম কিছুটা জোরদার করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা পানি অপসারণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
এখানকার বাসিন্দাদের দাবি, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে এই এলাকার অন্তত ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১ হাজারের বেশি মানুষ। এদের বেশিরভাগ নিম্ন আয়ের। ফলে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
২০২১ সালে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে 'প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প' বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে করা এক গবেষণায়ও দেখানো হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মধ্যে গরিব মানুষ সবচেয়ে বেশি থাকে জুরাইন এলাকায়। থাকার জায়গা, সুপেয় পানি, গোসলের পানির সার্বক্ষণিক সুবিধা, শৌচাগারের ব্যবস্থা, জমি ভোগ–দখলের নিরাপত্তা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ–সংযোগ, সড়ক ও ড্রেনের (নালা) সুবিধাসহ ১৬ ধরনের নাগরিক সুবিধাকে বিবেচনায় নিয়ে দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডের ওপর এই গবেষণাটি করা হয়।
এদিকে সড়ক উঁচু করায় পূর্ব জুরাইনের বেশিরভাগ ভবনের নিচতলার অবস্থান এখন রাস্তার উচ্চতা থেকে নিচে। এতে অনেক ভবনের নিচতলা ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় সেখানে পানি জমে থাকছে। আবার এলাকায় প্রচুর পরিত্যক্ত ভবন থাকায় এসব ভবনে পানি জমে থাকার কারণে এডিস মশা ব্যাপক হারে বংশবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। এ ছাড়া এলাকাটি তুলনামূলক নিচু হওয়ায় বছরের সবসময় বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকে।
এখানাকার বাসিন্দারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত জমে থাকা পানি সরানোর কোনো উদ্যোগ দেওয়া হয়নি। আর পরিস্থিতি বিবেচনায় মশক নিধন কার্যক্রমও পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে পুরো মৌসুম আসার আগেই এ এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে গেছে।
কথা হয় পূর্ব জুরাইনের বাগানবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. মাসুদের সঙ্গে। তিনি একজন রাজমিন্ত্রি। গত ২ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডেঙ্গুতে মারা যান তার স্ত্রী মদিনা বেগম।
মাসুদ বলেন, 'মাত্র ৩ দিনের জ্বরে আমার বউডি মইর্যা গেল। শুরুতে একটা বেসরকারি হাসপাতালে নিসিলাম। পরে সেইখান থেইক্যা মিটফোর্ডে পাঠাইলো। সেইখানেই সব শ্যাষ। এহন ৫ বছরের পোলাডি লইয়্যা কি করতাম ভাইবা পাই না।'
নবীনবাগ এলাকার আরেক পরিবারের ৩ জন সদস্য এখন ডেঙ্গুতে ভুগছেন। ওই পরিবারের ছোটছেলে ছেলে মো. ইউসুফ জানান, তার বাবা-মা ও ভাবি এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত। হাসপাতালে রেখে একসঙ্গে ৩ জনের চিকিৎসার খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য তাদের নেই। তাই বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে তাদের।
পূর্ব জুরাইন এলাকাটি পড়েছে দক্ষিণ সিটির ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওতায়। এই ওয়ার্ডের বাসিন্দা এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নাগরিক আন্দোলনে যুক্ত মিজানুর রহমানের বক্তব্য, 'জুরাইনের ঘরে ঘরে এখন ডেঙ্গু রোগী। দিনরাত পরিশ্রম করেও কোনো দিশা পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকাবাসী নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা পানি অপসারণে সিটি করপোরেশন কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এ কারণে আমরা ঝুঁকির মধ্যেই আছি।'
গত কয়েকদিনে এলাকায় সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম খানিকটা জোরদার করা হলেও মশা মারার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সকালে লার্ভিসাইড ছিটানো হচ্ছে, বিকেলে ফগিং করা হচ্ছে। কিন্তু এতে কতটা কাজ হচ্ছে জানি না।'
আগামীকাল শুক্রবার জুরাইনের মিষ্টির দোকান এলাকায় যে জনসভা হতে যাচ্ছে, তার একজন উদ্যোক্তাও মিজানুর। তার কাছ থেকে জানা যায়, সরকারি কোনো সহযোগিতা না পেয়ে এলাকার অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল কিছু তরুণ-যুবক দরিদ্র ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য সাধ্যমতো আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজনে রক্ত সংগ্রহের মতো কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দারিদ্র্যপ্রবণ একটি এলাকায় এতটুকু উদ্যোগ যথেষ্ট না। এ জন্য সরকারি পর্যায়ে আরও বড় পরিসরে কিছু করা দরকার। এমন ভাবনা থেকেই কিছু দাবি নিয়ে তারা এই জনসভা করতে যাচ্ছেন।
জুরাইনের অনেক বাসিন্দার অভিযোগ, বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা পানি ও এডিস মশার লার্ভা অপসারণের জন্য তারা ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মীর হোসেন মীরুর কাছে অনেকবার ধরনা দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে কাউন্সিলর মীরুর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে মশক নিধন কার্যক্রমে করপোরেশনের কোনো ঘাটতি নেই মন্তব্য করে দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার। মশক নিধন কার্যক্রমে কোনো ঘাটতি নেই। আমাদের পর্যাপ্ত জনবল আছে, পর্যাপ্ত ওষুধ আছে, পর্যাপ্ত মেশিনপত্রও আছে।'
জমে থাকা পানি অপসারণের ব্যাপারে তার বক্তব্য, 'পানি অপসারণ করবেন বাড়ির মালিকরা। বাড়ির বেজেমেন্ট ও পিলারের নিচে পানি জমে আছে। আমরা এগুলোতে মশার ওষুধ নিয়মিত স্প্রে করছি। তবে কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে যদি গাফিলতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে অবশ্যই আমরা সেটা অ্যাড্রেস করব।'
খোলা জায়গায় পানি জমে থাকলে সেই পানি সরানোর দায়িত্ব কে নেবে- জানতে চাইলে শামসুল কবির আরও বলেন, 'ওই জায়গার মালিকের দায়িত্ব সেটা। তিনি অপসারণ করবেন। আমরা অনেক মালিককে নোটিশ দিচ্ছি, অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। যার সম্পত্তি, রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বও তার।
'(জায়গাটি) যদি সিটি করপোরেশন এলাকায় হয়, অন্য কোনো মালিক নাই, সিটি করপোরেশনের রাস্তায় বা সম্পত্তির ওপর, তাহলে সেটা সিটি করপোরেশন অপসারণ করবে। আমরা অনেক সংস্থার জায়গা পেয়েছি যেখানে ময়লা জমে আছে, পানি জমে আছে। আমরা নিজ উদ্যোগে সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছি। কিছুদিন আগে শাহজাহানপুরের পুরো রেলওয়ে কলোনি সিটি করপোরেশন নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার করেছে। অথচ এটা ওনাদের করার কথা। আমরা ওনাদের সহযোগিতা করেছি। এভাবে কেউ যদি সহযোগিতা চায়, আমরা সেটা করব।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৮৮ জন। চলতি জুলাই মাসের প্রথম ১২ দিনেই মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। এর মধ্যে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে সর্বশেষ ৫ দিনে।
এ ছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। গত শনিবার থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ৫ দিনে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৮৪৫ জন রোগী। আর জুলাই মাসের প্রথম ১২ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মোট রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ১৬৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার একাধিক জরিপেও দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ঢাকা শহরের ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা বেশি।
তাই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে।
Comments