মৌসুমের প্রথম ভারী বৃষ্টিতে খুলনার অধিকাংশ সড়কে হাঁটু পানি-জলাবদ্ধতা
চলতি মৌসুমের প্রথম ভারী বৃষ্টিতে খুলনা নগরীর অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে। নগরীর প্রধান প্রায় সব সড়কে হাঁটু পানি, নিম্নাঞ্চল এখনো কোমর পানির নিচে।
অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতার কারণে বেশ কিছু রাস্তায় সাময়িক সময়ের জন্য যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
খুলনার জোড়া গেটে কেসিসি (খুলনা সিটি করপোরেশন) পরিচালিত সবচেয়ে বড় গরুর হাট হাঁটু পানিতে ডুবে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন গরু ব্যবসায়ীরা।
নগরবাসীর ভাষ্য, নিয়মিত পরিষ্কার না করায় অধিকাংশ ড্রেন বন্ধ, বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাওয়ার পথ নেই; নগরীর ২২টি খাল এখনো দখল হয়নি, ফলে জলাবদ্ধতা দূর হচ্ছে না।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আমিরুল আজাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আজ বুধবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর আগে ২৪ ঘণ্টায় ২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।'
তিনি আরও জানান, এই বৃষ্টি থেমে থেমে আরও অন্তত ২ দিন চলতে পারে।
নগরীর রয়েল মোড়, খানজাহান আলী সড়ক, আহসান আহমেদ রোড, বাস্তুহারা, বাইতিপাড়া, চানমারী, লবণচরা, টুটপাড়া, মিস্ত্রিপাড়াসহ নিম্নাঞ্চলে ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা রয়েছে।
নগরীর নতুন রাস্তা মোড় থেকে আবু নাসের হসপিটাল মোড় ও মুজগুননি সড়কের অধিকাংশ রাস্তা হাঁটু পানির নিচে।
খুলনা নগরীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আজিজুর রহমান বাস্তুহারা কলোনির সামনে একটি লন্ড্রির দোকান চালান। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ১৫ বছর ধরে এই অঞ্চলে জলাবদ্ধতা বেড়ে চলেছে। আমাদের পশ্চিম দিকের যে খোলা মাঠগুলো ছিল সেগুলো বর্ষার পানি ধারণের অন্যতম জায়গা ছিল। এখন সেখানে আবাসন ব্যবসায়ীরা বালু ফেলে উঁচু করায় পানি ধারণ করার জায়গা নেই।'
'তাছাড়া বাস্তহারা ক্যানেল ও কারিগর পাড়া খাল সংস্কার না করায় খালিশপুর-দৌলতপুরের পানি বের হতে পারছে না। ফলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে,' বলেন তিনি।
জলাবদ্ধতার কারণে ঈদের আগের দিন ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে জানান আজিজুর রহমান।
তিনি বলেন, 'এ পাড়ার কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষ গতকাল রাত থেকে পানিবন্দি হয়ে আছে।'
নড়াইলের কালিয়া উপজেলা থেকে ৩টি গরু নিয়ে খুলনার জোড়া গেট হাটে এসেছেন কামাল সরদার। গত সোমবার হাটে আসার পর থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত তার দুটি গরু বিক্রি হয়েছে। একটি গরু এখনো বিক্রি অপেক্ষায় রয়েছে তিনি।
কামাল বলেন, 'হাটের যা অবস্থা তাতে গরুর ভালোভাবে দাঁড়ানো জায়গা নেই। শেষ মুহূর্তে বর্ষায় কাদা-মাটিতে একাকার হয়ে গেছে হাট। আজ শেষ দিনে কেনাকাটার ধুম থাকার কথা কিন্তু তেমন ক্রেতা নেই।'
'অধিকাংশ খামারের বড় গরুগুলো খুবই দুরবস্থায় আছে। গরুগুলো উন্মুক্ত জায়গায় থাকায় ভিজে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাছাড়া হাটের অনেক জায়গায় হাঁটু পানি। আবহাওয়ার উন্নতি না হলে ব্যাপক লোকসানে পড়তে হবে,' আশঙ্কার কথা জানান তিনি।
বেলা'র বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ৩ বছর আগে খুলনা মহানগরী ও জেলার ৩টি উপজেলায় ময়ূর নদসহ মোট ২৬টি খালে ৪৬০ জন দখলদার ও ৩৮২টি অবৈধ স্থাপনা চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করেছিল প্রশাসন। সেসব খাল ও জলাভূমি উদ্ধারে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই খুলনা নগরীতে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।'
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এর আগেও জলাবদ্ধতায় নাকাল হয়েছে খুলনার মানুষ। জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অনেক আন্দোলন হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক প্রথম মেয়াদের শেষ দিকে শত কোটি টাকার 'নগর অঞ্চল উন্নয়ন' প্রকল্প নিয়েছিলেন। ওই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন এলাকায় ড্রেন নির্মাণ ও খাল খনন করা হলেও জলাবদ্ধতা দূর হয়নি।
সূত্র অনুযায়ী, খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ২০১৮ সালের নির্বাচনে ও ২০২৩ সালে সদ্য নির্বাচিত মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের মূল প্রতিশ্রুতি ছিল জলাবদ্ধতা নিরসন। নির্বাচিত হওয়ার পরপরই জলাবদ্ধতা নিরসনে ৮২৩ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে চমক দেখান তিনি। ওই প্রকল্পের আওতায় গত সাড়ে ৪ বছরে ১০৪টি ড্রেনের কাজ শেষ হয়েছে। খরচ হয়েছে ৩৮২ কোটি টাকা। তবে ময়ূর নদীসহ ৭টি খাল খনন ও ড্রেন নির্মাণের ৯১টি কাজ এখনো বাকি রয়েছে।
কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান বলেন, 'জলাবদ্ধতা নিরসন একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয়ে এটি হয়। গত সাড়ে ৪ বছরে অনেক কাজ শেষ হয়েছে, তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। বিশেষ করে পাম্প স্টেশন ও স্লুইস গেট সংস্কার করে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নগরবাসী এর সুফল পাবে।'
প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে কাজ শেষ করতে আরও ১ বছর লাগতে পারে বলে জানান তিনি।
সদ্য নির্বাচিত মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প নিয়ে একই কথা বলছেন। তিনি বলেন, 'বর্তমানে ২০৬টি ড্রেনের সংস্কার কাজ চলছে। সেই সঙ্গে ৭টি খাল খননের কাজও শুরু হয়েছে। এসব কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতা নিরসন হবে।'
কেসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আবদুল আজিজ বলেন, নগরীর অধিকাংশ ড্রেনের সংস্কার চলছে। এ জন্য বৃষ্টি হলে পানি নিষ্কাশনে দেরি হচ্ছে। তবে কোনো স্থানে জলাবদ্ধতা হলে কেসিসি পানি অপসারণের ব্যবস্থা করছে। খুলনা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব ও রূপসা নদীতে জোয়ার আসার সময়ে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ বর্ষার পানি নিষ্কাশন হওয়ার অন্যতম পথ রূপসা নদী ও ভৈরব নদ।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, 'গত ২০ বছর যাবত খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র মহোদয়রা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন যে শিগগিরই জলাবদ্ধতা দূর হবে। এখন পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং সামান্য বৃষ্টি হলে খুলনা শহরসহ এর আশেপাশের এলাকা পানিতে ডুবে যাচ্ছে।'
'বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পরও জলাবদ্ধতার সমাধান করতে পারেননি তালুকদার আব্দুল খালেক। সামান্য বৃষ্টিতে এখনো তলিয়ে যাচ্ছে নগরীর নিম্নাঞ্চল। প্রধান সড়কগুলোতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। বর্তমানে ৮২৩ কোটি টাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের একটি প্রকল্প চলছে। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হলেও তেমন কোনো উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে না,' বলেন তিনি।
আশরাফ আরও বলেন, 'প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের আগে সঠিক পরিকল্পনা জরুরি। খুলনা শহরের আশেপাশে ২২টি খাল সংস্কার না করা হলে কোনোভাবেই এই জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব নয়।'
Comments