‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেছি, অথচ বিচার পাচ্ছি না’ 

২০১৯ সালে সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে বর্তমানে শয্যাশায়ী মিলন। ভাঙা পা নিয়ে বিচারের প্রত্যাশায় জীবন কাটছে তার। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

২৪ বছর আগে পোশাক কারখানায় কাজ করতেন আনোয়ার হোসেন মিলন (৪০)। পরে পুলিশের 'সোর্স' হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। এলাকার মাদক চোরাকারবারী, ছিনতাইকারীসহ বহু অপরাধী তিনি ধরিয়ে দিয়েছেন।

তবে ২০১৯ সালে সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে বর্তমানে শয্যাশায়ী মিলন। ভাঙা পা নিয়ে বিচারের প্রত্যাশায় জীবন কাটছে তার।

'২৪ বছর আগে সেদিন রাতে আমি গার্মেন্টস থেকে বাসায় ফিরছিলাম। রাত ১০টায় রাস্তা থেকে পুলিশ আমিসহ ৩ জনকে উঠিয়ে নেয়। রাত ২টার দিকে ছেড়ে দেয়,' বলেন তিনি।

সেই রাতে ছাড়া পাবার পর থেকে পুলিশ ও ডিবি কর্মকর্তাদের সোর্স হিসেবে কাজ করেন তিনি। 

'অপরাধীদের ধরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে পুলিশ টাকা পয়সা দিত। আমার সংসার চলে যেত,' মিলন বলেন। 

২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ত্রাসীরা মিলনকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। 

'যারা আমার হাত-পা ভেঙে আমাকে পঙ্গু বানিয়ে দিল, তাদেরকে আমি ৩ বার পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। ওরা এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী। সেদিন সন্ধ্যায় আমি থানায় যাচ্ছিলাম। পথে লেগুনা থেকে নামিয়ে মিরপুর ১ থেকে ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। ওরা ৮ জন ছিল। আমাকে ধরে নিয়ে যায় পীরেরবাগ একটি মাঠে,' মিলন বলেন।

'নেওয়ার পরে একটা ভাঙা কাঠের চেয়ারে বসায়। বলে, "তুই বহুত আমাদেরকে জ্বালা যন্ত্রণা করছোস। ধরায়ে দিছোস।" আমি বললাম, "আপনাদের ভালোর জন্যই করছি। আমাকে ছাইড়া দেন আর ধরায়ে দিব না"।'

'তারা রড, লোহার পাইপ, মোটা কাঠ দিয়ে হাতে, পায়ে, পিঠে বেধড়ক পেটায়। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিশ্রাম নিয়ে আবার মারে। রাত ২টা বাজে একটা রিকশায় উঠায়ে দেয়। আমি তখন অচেতন। রিকশাচালক আমাকে নতুনবাজারে নিয়ে গেলে সেখানকার লোকজন আমাকে চিনতে পেরে পঙ্গু হাসপাতালে (জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান) নিয়ে যায়,' বলেন তিনি।

এ ঘটনার ১৮ দিন পর ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেছেন মিলনের বাবা আবদুল সাত্তার (৬৫)।  মামলায় তুষার, ইসমাইল, তুষার ২, জনি, মাসুম, সাগর, রোকন, বিসিল ও ইমনকে আসামি করা হয়।

মিলন বলেন, 'পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করেছে। আসামি ধরতেও গড়িমসি করেছে। আসামিরা প্রভাবশালী, এই এলাকার বাড়িওয়ালার ছেলেপেলে। মামলায় ৯ জনের নাম থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে ৫ জনের নাম বাদ দিয়ে দেয়।' 

চার্জশিটে নাম বাদ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মিলনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সঞ্জীবন রায় চৌধুরী। 

তিনি বলেন, 'মামলাটি মিরপুর পুলিশের একজন সাব-ইনসপেক্টর তদন্ত করছিলেন। তিনি এজাহারনামীয় আসামির ৫ জনের নাম বাদ দিয়ে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। সেসময় বিচারক শুনানিতে এ বিষয়ে জানতে চান। তখন বাদী ও ভুক্তভোগী আদালতে জানান যে তারা আসামির নাম বাদ দেওয়ার ব্যাপারে কিছু জানেন না। এ নিয়ে বিচারক তদন্ত কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা করেন। গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি চার্জশিটে না রাজি দেন আদালত। মামলাটি এখন পিবিআইতে আছে।'

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকা মেট্রো উত্তরের সাব ইন্সপেক্টর রবিউল ইসলাম বর্তমানে এই মামলা তদন্ত করছেন। 

জানতে চাইলে রবিউল ইসলাম বলেন, 'মামলাটি আমি তদন্ত শুরু করেছি। চার্জশিট থেকে ৫ আসামির নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে আমি অবগত আছি। এ ব্যাপারে ভিক্টিমের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। এলাকার সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছি। এখনো কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে আমি আশা করছি যে নিরপেক্ষ একটি চার্জশিট দিতে পারব। এ ব্যাপারে আমি সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলছি।'

এ বিষয়ে জানতে উত্তরা পশ্চিম থানার ইনসপেক্টর ইনভেস্টিগেশন ইয়াসিন গাজীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দ্য ডেইলি স্টার। আগে তিনি মিরপুর থানায় সাব ইনসপেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মিরপুর থানায় থাকাকালীন মিলন তার সোর্স হিসেবে কাজ করেছেন বলে জানান তিনি। 

তিনি বলেন, 'আমি মিলনের সঙ্গে কাজ করেছি। সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসামি ধরিয়ে দিত। তাকে যখন সন্ত্রাসীরা পিটিয়েছিল ততদিনে আমি ওই থানা থেকে বদলি হয়ে যাই।'

বর্তমানে কল্যাণপুর ১০ নং পোড়া বস্তিতে থাকেন আনোয়ার হোসেন মিলন। স্ত্রী ও ২ ছেলে নিয়ে তার ৪ সদস্যের পরিবার। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। পায়ে রিং নিয়েই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালান তিনি।

'আমার ছেলেমেয়ে কাউকেই বেশি পড়াশোনা করাতে পারিনি। দুই ছেলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। সংসারের হাল ধরতে এখন এক ছেলে বাসের হেল্পারের কাজ শুরু করেছে, আরেকজন গার্মেন্টসে কাজ করে,' বলেন তিনি। 

'এখনো পায়ে রিং। বাম হাতের আঙুল কাজ করে না। এই অবস্থায় বেশি সময় ধরে রিকশা চালাতে পারেন না। দিনে ৩/৪ ঘণ্টার মতো চালাই। এর বেশি চালালে পা ফুলে যায়। এখনো আমার শরীরের জায়গায় জায়গায় এখনো ব্যথা।

'এই দুরবস্থার মধ্যে যাদের নামে মামলা করেছি তারা এখনো হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতে গিয়ে প্রায় জীবনটা দিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ এখন আমার ওপর হামলার তদন্ত করছে না, মামলা নিতে গড়িমসি করছে, আসামি ধরতেও গড়িমসি করে,' মিলন বলেন।

Comments

The Daily Star  | English

The ceasefire that couldn't heal: Reflections from a survivor

I can’t forget the days in Gaza’s hospitals—the sight of dismembered children and the cries from phosphorus burns.

5h ago