আফ্রিকার তরুণরা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ: ড. ইউনূস

অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছেন ড. ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে গত ৮ মে 'ইস্ট আফ্রিকা সোশ্যাল বিজনেস ফোরাম অন ইয়ুথ অনট্রাপ্রিনিয়রশিপ' অনুষ্ঠিত হয়। কেনিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা ও তানজানিয়া থেকে সামাজিক ব্যবসা অংশীজনদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এই ফোরামে সামাজিক ব্যবসা আন্দোলনের অগ্রগতি উদযাপন করা হয়।

ফোরাম চলাকালে প্রফেসর ইউনূস কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার' উদ্বোধন করেন, আফ্রিকার তরুণ সমাজ, নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সামাজিক ব্যবসা কমিউনিটির অংশীজনদের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন।

গতকাল রোববার ইউনূস সেন্টার থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এই অঞ্চলে অবস্থিত ৯টি ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টারের অন্যতম 'তানগাজা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার' কর্তৃক ইউনূস সেন্টার এবং ওয়াই-ওয়াই ভের্ঞ্চাস ও তার বৈশ্বিক অংশীদারদের সহযোগিতায় আয়োজিত এই সম্মেলন ছিল পুরোপুরি 'সবুজ', যেখানে রিসাইকেলকৃত ও টেকসই মেটেরিয়াল ব্যবহার করা হয়।

ফোরামে যোগ দেন ৩০০ জনেরও বেশি আঞ্চলিক অংশগ্রহণকারী, ২৫০ জনের অধিক শিক্ষার্থী এবং ২০ জন আন্তর্জাতিক বক্তা, যাদের মধ্যে ছিলেন নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং আফ্রিকা অ্যান্ড গ্লোবাল পার্টনারশিপস অ্যাট ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিস ওয়ানজিরা মাতাইসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।

প্যানেল সেশনগুলোতে আলোচিত বিষয়ের মধ্যে ছিল কীভাবে সামাজিক ব্যবসা পূর্ব আফ্রিকাতে একটি তরুণ উদ্যোক্তা সংস্কৃতির চর্চা করতে পারে, সার্কুলার ও সবুজ অর্থনীতিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া, পরবর্তী পর্যায়ের সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের উপায় এবং সামাজিক ব্যবসা ইকো-সিস্টেম নির্মাণ পদ্ধতি। প্রফেসর ইউনূসের কর্ম ও আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি সামাজিক ব্যবসাগুলোর অগ্রগতি সেশনগুলোতে তুলে ধরা হয়। এ ছাড়াও এই অনুষ্ঠানে কেনিয়া, উগান্ডা ও রুয়ান্ডায় কাম্পালা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩টি ক্যাম্পাসে ৩টি ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার উদ্বোধন করা হয়।

মূল ভাষণে প্রফেসর ইউনূস বলেন, 'আফ্রিকার তরুণরা হচ্ছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ।' তিনি মনে করিয়ে দেন যে, আফ্রিকা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে তারুণ্য-প্রধান এলাকা, যেখানে জনসংখ্যার গড় বয়স ১৯ বছর।

তিনি আরও বলেন, উন্নত বিশ্বের আত্মঘাতী অর্থনৈতিক মডেল যা সারা পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে আফ্রিকা সেটা অন্ধভাবে অনুসরণ করে না। আমাদেরকে অবশ্যই এই আত্মঘাতী পথ পরিত্যাগ করতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই একটি নতুন নৌকা ও নতুন ইঞ্জিন তৈরি করতে হবে এবং আফ্রিকান তরুণরা তাদের উদ্যোক্তা শক্তি ও সৃষ্টিশীলতা দিয়ে একটি নতুন সভ্যতার পথে মানবসমাজকে চালিত করতে এই নৌকা তৈরি করবে। আফ্রিকার জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশির বয়স ২৫ বছরের নিচে এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৪২ শতাংশ তরুণ আসবে এই মহাদেশ থেকে।

‘ইস্ট আফ্রিকা সোশ্যাল বিজনেস ফোরাম অন ইয়ুথ অনট্রাপ্রিনিয়রশিপ ২০২৩’ অনুষ্ঠানে তানগাজা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, কেনিয়ার একটি টিমের সঙ্গে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও ইউনূস প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

পরদিন 'ইউনূস এনভায়রনমেন্ট হাব'র চেয়ারম্যান নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী প্রফেসর ইউনূস 'শি স্টারস গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম' অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন। ২০২১ সালে জার্মানি ইউনূস এনভায়রনমেন্টাল হাবের সহযোগিতায় জিআইজেডের মাধ্যমে 'এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড স্কিলস ফর ডেভেলপমেন্ট ইন আফ্রিকা' কর্মসূচি চালু করে যার লক্ষ্য কোভিড-১৯ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিরূপ অর্থনৈতিক প্রভাবের শিকার দেড় হাজার ক্ষুদ্র ও মধ্যম আকারের নারী-উদ্যোক্তা ব্যবসার প্রসার ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি। তাদের মধ্যে ৪০২ জন নারী উদ্যোক্তা গত ৯ মে 'শি স্টারস—সি হার এমপাওয়ারড' খেতাব পেয়েছেন। এ ছাড়া কেনিয়ার নেতৃস্থানীয় মিডিয়া গ্রুপ 'স্ট্যান্ডার্ড মিডিয়া গ্রুপ' আফ্রিকান তরুণদের জন্য আয়োজিত একটি অনট্রাপ্রিনিয়রশিপ অ্যান্ড সোশ্যাল বিজনেস প্যানেলে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রফেসর ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানায়, যেখানে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে ছিলেন 'জামী বোরা ট্রাস্ট'র প্রতিষ্ঠাতা মিস ইনগ্রিড মুনরো এবং তানগাজা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল কমিউনিকেশনের পরিচালক ব্রাদার জোনাস জিনেকু ইয়োভি। জামী বোরা ট্রাস্ট ১৯৯০ এর দশকে কেনিয়ার বস্তি এলাকায় একটি গ্রামীণ মডেলের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু করে। প্যানেলটি কেটিএন নিউজ ও কেনিয়ার অন্যান্য টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

প্রফেসর ইউনূস নাইরোবির তরুণদের সংগঠন 'ওয়াইপিও গোল্ড নাইরোবি' কর্তৃক আয়োজিত 'ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস পিচ নাইটে' প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। তিনি ব্যবসায়ী ও সামাজিক ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে একটি ৩ শূন্যর পৃথিবী সৃষ্টির ওপর বক্তৃতা দেন। অনুষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের জুরি বোর্ডে ছিলেন জাতি সংঘের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এবং জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন গ্রুপের চেয়ারপারসন মিস আমিনা মোহামেদ যিনি বলেন যে, কেনিয়া ইতোমধ্যে প্রফেসর ইউনূসের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছে এবং তার কাছ থেকে আরও শেখার ও অনুসরণ করার আছে। প্রফেসর ইউনূস সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের গুরুত্বের ওপর আবারও জোর দেন।

প্রফেসর ইউনূস তার সম্মানে 'অ্যাসপেন নেটওয়ার্ক অব ডেভেলপমেন্ট অনট্রাপ্রিনির্য়স' কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখানে মূল ভাষণে তিনি বলেন, 'সমাজ থেকে দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো দূর করতে হলে আমাদেরকে সমাজে নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে, প্রচলিত ধ্যান-ধারণা দূর করতে হবে, আগে কখনো ঘটেনি এমন জিনিস চিন্তা করতে হবে এবং সামাজিক ফিকশন রচনা করতে হবে।'

এরপর প্রফেসর ইউনূস 'পাওয়ারড যুয়া বাইক্স' নামের একটি সামাজিক ব্যবসা পরিদর্শন করেন, যা সাধারণ বাইসাইকেলকে সোলার চালিত ই-বাইকে রূপান্তরিত করে। সামাজিক ব্যবসাটি ইউনূস এনভায়রনমেন্টাল হাবের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত। প্রফেসর ইউনূস তরুণ আফ্রিকান উদ্যোক্তাদেরকে কীভাবে তাদের ব্যবসা বড় করতে হবে এবং আরও কার্যকর আর্থ-সামাজিক অভিঘাতের জন্য কীভাবে তাদের ব্যবসায়িক মডেলকে আরও সফল ও উন্নত করতে হবে, এ বিষয়ে পরামর্শ দেন। এ ছাড়াও তিনি একটি স্থানীয় মরিঙ্গা স্কুলে বক্তৃতা দেন, যা আফ্রিকান তরুণদের প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

সফরকালে প্রফেসর ইউনূস ক্রীড়া, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ক্যাবিনেট সেক্রেটারি মিস আমিনা মোহামেদ, কঙ্গোর ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্কের ওয়ার্ডেন মি. ইম্যানুয়েল ডি মেরো, গ্রিনবেল্ট মুভমেন্টের পরিচালক ও নোবেল লরিয়েট ওয়াংগারি মাতাইয়ের মেয়ে ওয়ানজিরা মাতাই এবং ইউএন-হাবিট্যাটের (জাতিসংঘ হিউম্যান সেটলমেন্ট প্রোগ্রাম) নির্বাহী পরিচালক ড. মাইমুনাহ মোহামেদ শরিফের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেন।

Comments

The Daily Star  | English
What is Indian media’s gain in branding us as a Hindu-hating country?

What is Indian media’s gain in branding us as a Hindu-hating country?

What has shocked me is their refusal to fact-check what they are writing, broadcasting or televising—a basic duty of any journalist.

13h ago