‘বাংলাদেশ’ শব্দটি যেভাবে আমাদের হলো
![‘বাংলাদেশ’ শব্দটি যেভাবে আমাদের হলো ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি যেভাবে আমাদের হলো](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/03/26/336655323_6247902705253554_8556363055178189261_n.jpg?itok=8etq4vMS×tamp=1679798031)
পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেওয়ার ৫৩ বছরে পা দিলো বাংলাদেশ। এই 'বাংলাদেশ' নামকরণের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস; আছে নানা ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ঘটনার সন্নিবেশ এবং পরম্পরা।
এখন খুঁজে দেখা যাক, আমাদের অস্তিত্বের পরিচয় বহনকারী এই 'বাংলাদেশ' শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো?
১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর দেশটির প্রথম সংবিধান প্রণয়ন ও গৃহীত হয়। সেখানে স্বাধীন এই দেশটির সাংবিধানিক নাম রাখা হয় 'বাংলাদেশ'।
স্বাধীনতার আগে এদেশের মুক্তিকামী মানুষ ও স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টাদের মুখে বারবার 'বাংলাদেশ' শব্দটি শোনা গেলেও কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় এ শব্দটি এসেছে তারও অনেক আগে।
তবে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন-সার্বভৌম এই ভূখণ্ডের নামকরণ 'বাংলাদেশ' করার দাবি উঠতে শুরু করে ১৯৬৫ সাল থেকে। এরপর ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের স্লোগানে 'বাংলাদেশ' নামটি আসে। একই বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে এ দেশের নাম 'বাংলাদেশ' করার প্রস্তাব রাখেন। পরে সত্তরের নির্বাচন ঘিরে এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতা দাবি করার পাশাপাশি এর নাম 'বাংলাদেশ' করার দাবি তীব্র হয়।
উনিশ শতকের সাহিত্যে অবিভক্ত বাংলাকে 'বঙ্গদেশ' বা 'বাংলাদেশ' বলা হতো।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে লেখা স্বদেশ পর্যায়ের একটি গানে বলেন, 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!'।
অবশ্য এর আগেই রবীন্দ্রনাথ তার গদ্যে বাংলাদেশ শব্দটা ব্যবহার করেছেন বহুবার।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার রবীন্দ্র রচনাবলীর একটি অনলাইন ভার্সন তৈরি করেছে। যেখানে 'বাংলাদেশ' শব্দটি সার্চ করলে ৩২ বার এই শব্দটি পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে দ্য ডেইলি ষ্টারের সঙ্গে আলাপকালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দে বলেন, 'আধুনিক বানানে যেভাবে বাংলাদেশ লেখা হয় সেটা প্রথম রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকেই আসে।'
এর আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাতেও 'বাংলাদেশ' শব্দটি এসেছে 'বঙ্গদেশ' হিসেবে। এছাড়া 'বঙ্গদেশের কৃষক' নামে বঙ্কিমচন্দ্রের একটি বইও আছে বলে জানান সৌমিত্র শেখর।
এই অধ্যাপক বলেন, 'রবীন্দ্রনাথ তার কবিতা, গান বা গদ্যে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির ছবির মতো বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশকে দেখিয়েছেন নদী-নালা দিয়ে ঘেরা সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা হিসাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ভূখণ্ডের একটি মনস্তাত্ত্বিক মানচিত্র এঁকেছেন তার লেখায় এবং বঙ্গবন্ধু সেই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক মানচিত্র দিয়েছেন।'
জীবনানন্দ দাশের চিঠি নিয়ে প্রভাতকুমার দাসের সম্পাদনায় রচিত গ্রন্থ 'পত্রালাপ' থেকে জানা যায়, বাংলা ১৩৩৫ সালে (১৯২৯) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা একটি চিঠিতে জীবনানন্দ দাশ 'বাংলাদেশ' শব্দটি ব্যবহার করেন।
ওই চিঠিতে জীবনানন্দ লেখেন, 'আজকালকার বাংলাদেশের নবীন লেখকদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য এই যে, তাদের মাথার ওপরে স্পষ্ট সূর্যালোকের মতো আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীকে তারা পেয়েছে।'
১৯৩২ সালে ৭১টি গান নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'বনগীতি' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেখানে একটি গানে নজরুল ইসলাম লেখেন, 'নমঃ নমঃ নমো বাঙলাদেশ মম/চির মনোরম চির মধুর'।
মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে প্রকাশিত সুকান্ত ভট্টাচার্যের 'পূর্বাভাস' কাব্যগ্রন্থের 'দূর্মর' শিরোনামের কবিতাতেও 'বাংলাদেশ' শব্দটি এসেছে। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো সুকান্ত লেখেন ১৯৩৭ সালের দিকে। কবিতাটি শুরু হয় এভাবে- 'হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ/কেঁপে কেঁপে উঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে'।
১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের সময় জন্ম নেয় 'অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার' নামের নতুন একটি সংগঠন; সংক্ষেপে 'অপূর্ব সংসদ'। এই সংগঠনের লেখা বিভিন্ন ইশতেহার ও পুস্তিকায় সংগঠনের নাম হিসাবে লেখা হত অপু।
এই সংগঠন একটি সরকার কাঠামোও ঠিক করেছিল। সেখানে রাষ্ট্রপতি হিসাবে বেগম সুফিয়া কামাল এবং প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আবদুল আজিজ বাগমারের নাম ঠিক হয়েছিল।
অপু-১ এর ইশতেহার ১৯৬৩ সালের ২১ ডিসম্বর প্রকাশিত হয়। সেখানে পাকিস্তানের বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা দাবি করা হয়। অপু-২ ইশতেহার প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালের ১ জানুয়ারি এবং সেখানে শতাব্দী ধরে বাঙারি শোষন- বঞ্চনার কথা উল্লেখ করা হয়।
অপুর তৃতীয় ইশতেহার প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালের ১ অক্টোবর, যেখানে বাংলাদেশের চূড়ান্ত ঘোষনা প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক আহমেদ শরীফ লিখিত সেই ইশতেহারে বলা হয়, 'আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ'। ইশতেহার শেষ হয় রবীন্দ্রনাথের গান 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' দিয়ে।
১৯৬৯ সালে তৎকালীন সামরিক শাষক আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করে, যা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হিসেবে পরিচিত।
গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসির কারনে তৎকালীন সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে ওঠে।
১৯৬৯-এর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় পর্যন্ত 'তোমার দেশ আমার দেশ; বাংলাদেশ বাংলাদেশ', 'বীর বঙ্গালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'- এমন বিভিন্ন স্লোগানে 'বাংলাদেশ' শব্দটি ঘুরেফিরে এসেছে।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন 'বাংলাদেশ'।
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/03/26/mujib.jpg?itok=K29Fr0Nt×tamp=1679810304)
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর 'কারাগারের রোজনামচা' বইয়ে পাওয়া যায়, 'একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে "বাংলা" কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।...একমাত্র 'বঙ্গোপসাগর' ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে "বাংলা" কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। ...জনগনের পক্ষ হইতে আমি ঘোষনা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্থানের পূর্বাঞ্চীয় প্রদেশটির নাম "পূর্ব পাকিস্থান"-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র "বাংলাদেশ"।'
সত্তরের নির্বাচনের আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এবং সাধারন সম্পাদক শাজাহান সিরাজের নামে একটা প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছিল, যেটার শিরোনাম ছিল, 'নির্বাচন-বাংলাদেশ ও ছাত্রসমাজ'।
সেই প্রচারপত্রে সরাসরি বলা হয়েছিল, 'বর্তমানে পশ্চিমা শোষণ হতে মুক্তি এবং ইতিহাস-স্বীকৃত বাঙালির বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই আজ ৭ কোটি মানুষ "বাংলাদেশ" গঠন ও বাঙালি জাতি সৃষ্টির জন্য উদ্যোগী।'
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ এবং শ্রমিকলীগের যৌথ সমাবেশে বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন
সেই ইশতেহারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেও ২ বার 'বাংলাদেশ' শব্দটি উচ্চারণ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন রাত ১২টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই ঘোষনা দেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে পাঠানো হয়।
সেই ঘোষনা বঙ্গবন্ধু শুরু করে এভাবে- 'এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।'
পরে রাত ১ টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক মাসের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠন করা হয় অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমানে মুজিবনগর উপজেলা) হয় এই সরকারের শপথ গ্রহণ। মুজিবনগর সরকারের ঘোষনাপত্রে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়।
এভাবে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু প্রাণের বিনিময়ে একাত্তরের ১৬ ডিসম্বর বিজয় লাভ করে বাংলাদেশ।
এরপর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়, সে সময় দেশটির সাংবিধানিক নাম হয় 'বাংলাদেশ'।
Comments