ঢাকায় ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন অনুমোদন দেয় কে
গুলিস্তানে মঙ্গলবার একটি ভবন বিস্ফোরণে ২২ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন শতাধিক। বেজমেন্টে বিস্ফোরণে ৭তলা ওই ভবনটির ২৪টি কলামের ৯টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে রাজউক । ভবনটিকে ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বলেও ঘোষণা করা হয়েছে।
ভবনটির কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসকে উদ্ধার অভিযানে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে। সবগুলো মরদেহ উদ্ধারেই সময় লেগেছে প্রায় ২ দিন। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় ভবিষ্যতে ঢাকায় এরকম দুর্ঘটনা বা ভূমিকম্প হলে মানবিক বিপর্যয় হবে।
কোনো ভবনের নকশায় যদি প্রকৌশলগত ত্রুটি থাকে, রাজউক সেটা বলতেও পারবে না, ভেরিফাইও করতে পারবে না। তাদের এই সক্ষমতা নেই। স্ট্রাকচারাল ড্রয়িংই তারা নেয় না এখন পর্যন্ত। স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং কারও কাছ থেকে অনুমোদন করাতে হয় না।
যে কোনো দুর্ঘটনায় বা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে একটি বহুতল ভবন দাঁড়িয়ে থাকে কাঠামোগত (স্ট্রাকচারাল) সক্ষমতায়। আর এটি নির্ধারিত হয় ভবন নির্মাণের আগেই এর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করার সময়।
ঢাকায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক। অথচ অনুমোদনের সময় ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন জমা দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থাৎ ভবনের কাঠামোগত সক্ষমতা নির্ভর করছে শুধুই ভবন মালিকের নিয়োগ করা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের দেওয়া নকশার ওপর।
তাহলে ঢাকার ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন তদারকি করবে কে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবন নির্মাণের অনুমোদনের জন্য বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের কথা। আর রাজউক বলছে, শিগগির তারা স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের অনুমোদনের ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থপতি ইকবাল হাবিব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাজধানীর ভবন নির্মাণের অনুমোদন রাজউক নিলেও পরবর্তী দেখভালের দায়িত্ব নেয় না। সেই অনুমোদন দেওয়া হয় আবার শুধু স্থাপত্য ড্রয়িংয়ের। স্ট্রাকচারাল ও মেকানিক্যাল ড্রয়িংয়ের না। দীর্ঘদিন ধরে বলা সত্ত্বেও এটার সক্ষমতা রাজউকের নেই।'
তিনি বলেন, 'রাজউককে আমরা একটা ব্যুরোক্রেটিক প্রতিষ্ঠান বানিয়েছি। যদিও এটার হওয়ার কথা ছিল ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট ও পরিকল্পনাবিদদের প্রতিষ্ঠান, একটি টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান।'
ইকবাল হাবিব আরও বলেন, 'রাজউকের ব্যর্থতা-অপারগতা জিইয়ে রাখার জন্য আমরা প্রত্যেকে দায়ী। আমরা সবাই চাই ঘুষ দিয়ে ভবনের নকশা অনুমোদন করিয়ে নিই, রাজউক আমাকে কিছু বলবে না। রাজউকের এই নিষ্ক্রিয়তার জন্য আমরা সবাই দায়ী। একইসঙ্গে ব্যক্তি, কমিউনিটি এবং সরকারের সব সংস্থা এই অবহেলাজনিত মৃত্যুর জন্য দায়ী।'
ভবনের প্রকৌশলগত ত্রুটি দেখভালের বিষয়ে রাজউকের ভূমিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই স্থপতি বলেন, 'কোনো ভবনের নকশায় যদি প্রকৌশলগত ত্রুটি থাকে, রাজউক সেটা বলতেও পারবে না, ভেরিফাইও করতে পারবে না। তাদের এই সক্ষমতা নেই। স্ট্রাকচারাল ড্রয়িংই তারা নেয় না এখন পর্যন্ত। স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং কারও কাছ থেকে অনুমোদন করাতে হয় না।'
২০১৫ সালের ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন ও তদারকির জন্য 'বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি' গঠন হওয়ার কথা ছিল উল্লেখ করে এই নগর বিশেষজ্ঞ বলেন, 'গত ৮ বছরে এখন পর্যন্ত এই অথরিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। সেই অথরিটির এই কাজ দেখভাল করার কথা। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে এই অথরিটি আমরা এখনো পাইনি।'
ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্ট্রাকচারাল ডিজাইন সার্টিফায়েড ইঞ্জিনিয়াররা করে থাকেন। তারা যে ড্রয়িং করে থাকেন, সেখানে তাদের আইডি নম্বর থাকে, নাম-ঠিকানা থাকে। তারা ঠিকমতো ডিজাইন করছেন কি না, করে না থাকলে সেটা আমরা ইঞ্জিনিয়ারদের সমিতি আইইবিতে রিপোর্ট করি। তারাই একটা তালিকা করেন যে কারা স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং করতে পারেন।'
ভবনের নকশা অনুমোদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমরা ১৯৮৫ সাল থেকে অনুমোদন দেওয়া শুরু করেছি। আমাদের ডিজিটাল শুরু হয়েছে ২০১৯ সাল থেকে। বিগত দিনেরগুলো আমরা ডিজিটাইজড করে আর্কাইভ করা শুরু করেছি।'
'আগামী ১ এপ্রিল থেকে ভবনের স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং রাজউক থেকে অনুমোদন করাতে হবে। আমরা গত সপ্তাহে এ ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতদিন আমরা শুধু আর্কিটেকচারাল ডিজাইন নিতাম। আর্কিটেকচারাল ডিজাইন অনুযায়ী ভবন হচ্ছে কি না, সেটা আমরা দেখতাম,' যোগ করেন তিনি।
এতদিন কেন স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না, এমন প্রশ্নের জবাবে তন্ময় দাস বলেন, 'দীর্ঘদিন এই বাধ্যবাধকতা ছিল না। আমার মনে হয় আগে এত হাইরাইজ ভবন ছিল না এবং ভবনের নকশার বিষয়ে আমরা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের ওপর বিশ্বাস রাখতাম যে তারা যে নকশাটা করছেন, সেটা সঠিকভাবেই করছেন। এখন হাইরাইজ ভবন বেড়েছে, ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে, সে কারণে বিষয়টা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ কারণে এখন থেকে আমরা আর্কিটেকচারাল ড্রয়িংয়ের পাশাপাশি স্ট্রাকচারাল, প্লাম্বিং ও ফায়ার সেফটি সব ডিজাইন নেওয়া শুরু করতে যাচ্ছি।'
এ বিষয়ক সক্ষমতা রাজউকের আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এখন এর প্রয়োজনীয়তার নিরিখে আমরা বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প নিয়েছি। এর মাধ্যমে আমরা ইতোমধ্যে আমাদের রাজউকের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে প্রায় ১ হাজার ২০০ ইঞ্জিনিয়ারকে ট্রেইনড আপ করছি।'
গুলিস্তানে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজউকের এই সদস্য বলেন, 'আমাদের একটা কমিটি হয়েছে। কমিটিতে আমাদের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক আছেন, মেম্বার ডেভেলপমেন্ট আছেন, বুয়েটের ২ জন এক্সপার্ট আছেন, ফায়ার সার্ভিসের সাবেক ডিজি আছেন। গতকাল তারা ভবনটি পরিদর্শন করেছেন। একটা খসড়া রিপোর্ট দিয়েছেন। এটা আমরা জানিয়ে দেবো যে ভবনটি রেট্রোফিটিং করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যাবে কি না বা ভেঙে ফেলা হবে কি না, সেটা ওই রিপোর্ট থেকে চলে আসবে।'
'ভবনটি নিয়মমাফিক হয়েছে কি না, সেটা আমরা নকশা পেলে বলতে পারব। ভবনটি কত তলার অনুমতি নিয়ে কত তলা নির্মাণ করেছে, সেটা জানতে পারব। আমরা নকশা পাওয়ার কাছাকাছি চলে এসেছি। ভবনটি বৈধ না অবৈধ, সেটা আমরা শিগগিরই জানাতে পারব,' যোগ করেন তিনি।
Comments