ড. ইউনূস সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার: প্রধানমন্ত্রীকে ৪০ বিশ্বনেতার খোলা চিঠি

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো 'একজন অনবদ্য পরিশুদ্ধ মানুষ এবং তার কার্যক্রমগুলো বাংলাদেশ সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং বারবার হয়রানি ও তদন্তের মধ্যে পড়ছে'। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে 'গভীর উদ্বেগ' প্রকাশ করেছেন ৪০ জন বিশ্বনেতা।

বিষয়টিকে 'বেদনাদায়ক' উল্লেখ করে তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন। চিঠিটি গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত হয়েছে।

ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত চিঠি এবং এতে স্বাক্ষরকারীদের তালিকা

'নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে যা হচ্ছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,

আমরা বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আপনাকে লিখছি, যারা আপনার দেশের জনগণের সাহস ও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করে। আমরা বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং সমাজসেবী। বিশ্বের কোটি মানুষের মতোই আমরাও বাংলাদেশে বিকশিত ও সারা বিশ্বে অনুসরণ করা উদ্ভাবনের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছি। আপনার দেশের প্রতি এই গভীর শ্রদ্ধা থেকেই আপনাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের মহান অবদানের পাশে থাকতে ও স্বীকৃতির জন্য ইতিবাচক ব্যবস্থা নিতে আপনাকে অনুরোধ জানিয়ে লিখছি।

অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বে মানবিক উন্নয়নে যে অবদান রেখে চলেছেন তা অব্যাহত রাখতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে আমাদের গভীর উদ্বেগ রয়েছে। আমরা নিশ্চিত আপনি জানেন যে বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের অবদান, বিশেষ করে অতি দরিদ্র ও সবচেয়ে বিপদাপন্ন মানুষদের জন্য তার অবদান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং সম্মানিত।

যেমন:

-ইতিহাসে ইউএস প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং ইউএস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পাওয়া ৭ জন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, মাদার তেরেসা এবং এলি উইজেল। এই তালিকায় অধ্যাপক ড. ইউনূসও আছেন।

-তিনি ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন এবং এটিকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন, যার ঋণগ্রহীতা ৯০ লাখ এবং তাদের ৯৭ শতাংশ নারী। প্রতিষ্ঠানটি লাখো মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছেন এবং সারা বিশ্বের অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির জন্য একটি মডেল তৈরি করেছে।

-১৯৮০'র দশকের মাঝামাঝি গ্রামীণ ব্যাংক ২০০-৫০০ মার্কিন ডলারের গৃহনির্মাণ ঋণ দেওয়া শুরু করে, যা দিয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজারের বেশি গ্রামীণ পরিবার বাড়ি নির্মাণ করেছে।

-অধ্যাপক ইউনূসের প্রতিষ্ঠা করা গ্রামীণ শক্তি ১৮ লাখের বেশি বাড়িতে সোলার হোম সিস্টেম ইনস্টল করেছে এবং হাজার হাজার গ্রামীণ নারীকে এই সিস্টেম ইনস্টল ও মেরামতের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

-তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমের গ্রামীণফোনে করা বিনিয়োগটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিনিয়োগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, যা সারা দেশে সামাজিক উদ্ভাবন বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে। যেমন: গ্রামীণ ক্যালেডোনিয়ান কলেজ অব নার্সিং দেশের বৃহত্তম বেসরকারি নার্সিং কলেজ, দেশের দরিদ্রদের জন্য ৪টি চক্ষু হাসপাতাল, ১৫০টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক এবং আরও অনেক কিছু।

-২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিম্নআয়ের জনগণকে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের জন্য তিনি গ্রামীণ আমেরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। এর বেশিরভাগ ঋণই ২ হাজার ৫০০ ডলারের নিচে। এটি ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণের মাইলফলক অতিক্রম করতে চলেছে এবং এসব ঋণের পরিশোধের হার ৯৯ শতাংশ।

মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ টেলিকম বা গ্রামীণফোন থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হননি। বরং তিনি যেসব সংগঠন গড়ে তুলেছেন সেগুলোর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এবং ঢাকায় সাদামাটাভাবে বসবাস করছেন।  ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন অনবদ্য পরিশুদ্ধ মানুষ এবং তার কার্যক্রমগুলো আপনার সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং বারবার হয়রানি ও তদন্তের মধ্যে পড়ছে—এমনটা দেখতে পাওয়া বেদনাদায়ক।

আমরা বিশ্বাস করি, সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হচ্ছে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে চিরায়ত ও সামাজিক উদ্যোক্তারা প্রস্ফুটিত হতে পারেন।

আমরা আশা করব, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে একটি প্রাণবন্ত সুশীল সমাজকে লালন করার মধ্য দিয়ে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি মডেল হিসেবে বাংলাদেশ তার ভূমিকায় ফিরে আসবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম একটি ভালো উদ্যোগ হওয়া উচিত অধ্যাপক ইউনূসের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাকে নিজ নিরাপত্তায় ব্যস্ত রাখার পরিবর্তে দেশ ও বিশ্বের জন্য আরও ভালো কিছু করতে তার শক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেওয়া।

আমরা এবং বিশ্বের কোটি মানুষ আশা করি, আপনি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবেন।'

প্রধানমন্ত্রীকে লেখা খোলা চিঠিতে সইকারী ৪০ জন। ছবি: সংগৃহীত

চিঠিতে সই করেছেন-সংগীতশিল্পী ও অ্যাকটিভিস্ট বোনো, ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন, ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট লর্ড মার্ক ম্যালোক ব্রাউন, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, রেজাল্টস অ্যান্ড সিভিক কারেজের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ডালি হ্যারিস, ড্যালেয়ার ইনস্টিটিউট ফর চিলড্রেন, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির প্রতিষ্ঠাতা লে. জে. (অব.) রোমিও ডালাইরা, এমেরিটা চিলড্রেন'স ডিফেন্স ফান্ডের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট মারিয়ান রিট এডেলমান, মেক্সিকোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিসেন্তে ফক্স, সংগীতশিল্পী পিটার গ্যাব্রিয়েল, নাসার সাবেক মহাকাশচারী রন গারেন, ইউনিসেফের সাবেক উপ-নির্বাহী পরিচালক ও জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব কুল গৌতম, গ্লাসগো ক্যালেডিনিয়ান ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর এবং এমিরেটাস অধ্যাপক পামেলা গিলিস, রকফেলার ফাউন্ডেশন ও ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনের সিইও পিটার সি. গোল্ডমার্ক জুনিয়র, প্রাইমাটোলজিস্ট ও অ্যাকটিভিস্ট জেন গুডাল, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর, রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সিইও জন হেওকো, সমাজসেবী ও উদ্যোক্তা মো. ইব্রাহিম, যুক্তরাজ্যের হাউজ অব লর্ডসের কেসি সদস্য ব্যারোনেস হেলেনা কেনেডি, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি ও টেড কেনেডি জুনিয়র, ভেনচার ক্যাপিটালিস্ট ভিনোড খোসলা, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, সংগীতশিল্পী ও অ্যাক্টিভিস্ট অ্যানি লেনক্স, মার্কিন সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক প্রধান আর্থার লেভিট, সাবেক মার্কিন কম্পট্রোলার অব দ্য কারেন্সি ও স্প্রিং হারবার হোল্ডিংসের জেন লাডউইগ, ভিএমওয়্যারের সাবেক সিইও পল মারিজ, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব শিকাগোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সিইও মাইকেল এইচ মস্কো, ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি, চ্যাথাম হাউজের সাবেক প্রধান নির্বাহী স্যার রবিন নিবলেট, বিশ্বব্যাংকের সাবেক ইউএস বোর্ড ডিরেক্টর ও সাউদার্ন ব্যানকরপোরেশনের উপদেষ্টা জ্যান পিয়ারসি, ইয়েল ল স্কুলের স্টার্লিং প্রফেসর অব ল রবার্ট পোস্ট, মিশিগানের সাবেক মার্কিন সিনেটর ও ব্যাংকিং, হাউজিং এবং নগর উন্নয়ন সংক্রান্ত সিনেট কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান ডোনাল্ড রিগেল, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, এলেন সিডম্যান, অভিনেত্রী ইয়ার্ডলি স্মিথ, শ্যারন স্টোন, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার প্রফেসর ইমেরিটাস ড. ডেভিড সুজুকি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাইড স্কুল অব বিজনেসের সাবেক ডিন পিটার তুফানো, বৈশ্বিক নারী বিষয়ক সাবেক মার্কিন অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ মিলেন ভারভির এবং উইকিপিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা জিমি ওয়েলস।

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Session delays, irregularities, and lack of central planning cited as reasons

11h ago