যেভাবে চলছে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের সংসার

বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের চিত্র। ছবি: সুমন আলী/স্টার

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দোকানে দোকানে ঘুরছেন এক মধ্য বয়সী নারী। জিজ্ঞেস করছেন বিভিন্ন মাছের দাম। ৪টি দোকান ঘুরে ৫ নম্বর দোকানে গিয়ে কিনলেন ১ কেজি টেংরা মাছ। দোকানদারকে ১ হাজার টাকার নোট দিলে তিনি ফেরত দেন ২৫০ টাকা।

পরে আরও ৪টি দোকান ঘুরে ১ কেজি ইলিশ ও ২ কেজি রুই মাছ কেনেন ওই নারী। এবার যান মাংসের দোকানে। সেখানে ৭০০ টাকা দিয়ে ১ কেজি গরুর মাংস কেনেন।

মাংসের দোকানের সামনে ওই নারীর সঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়।

তার নাম কল্পনা আক্তার। বাড়ি নরসিংদীতে। ২ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন ফার্মগেট এলাকায়। ছেলে অষ্টম এবং মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।

তিনি জানান, প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পুরো মাসের জন্য মাছ-মাংস কেনেন। তার স্বামী একজন সরকারি কর্মকর্তা। বেতন পান প্রায় ৪০ হাজার টাকা। যার প্রায় অর্ধেক খরচ হয় বাসা ভাড়ায়। তারা ৩ রুমের বাসায় থাকতেন। খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত জানুয়ারি থেকে ১টি রুম সাবলেট দিয়েছেন।

কল্পনা আক্তার বলেন, 'যতই সমস্যা হোক, ছেলেমেয়েদের কিছু তো খাওয়াতে হবে। গত বছর যে পরিমাণ মাছ-মাংস কিনতে পারতাম, এ বছর তা পারি না। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ, বাড়ি ভাড়াসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। আমার স্বামীর বেতনের পুরো টাকা শেষ হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়াসহ সাংসারিক বিভিন্ন কাজে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই কোনো চাকরি করতে পারি না। তবে এ বছর অনলাইনে কিছু ব্যবসা শুরু করেছি। সেখান থেকে প্রতি মাসে অল্প কিছু টাকা আসে। এভাবেই চলছি।'

তিনি বলেন, 'বাজারের এই অবস্থা চলতে থাকলে গ্রামে চলে যাব। সেখানেই ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো। আর তাদের বাবা ঢাকায় থাকবেন। কারণ এখন তো ১ টাকাও জমা করতে পারি না। যা কিছু জমা ছিল, সেগুলোও শেষ হয়ে গেছে। উল্টো কিছু টাকা ঋণ হয়েছে। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য কী রেখে যাব? শুধুই ঋণের বোঝা?'

কারওয়ান বাজারে কথা হয় মো. রহিমের সঙ্গে। বয়স ৪০ বছর। তিনি এখানে কুলির কাজ করেন, থাকেন রাজধানীর নাখালপাড়ায়। পরিবারে স্ত্রী-সন্তানসহ সদস্য সংখ্যা ৬।

আগে একাই কাজ করতেন। এখন বাধ্য হয়ে ১৯ বছরের বড় ছেলেকেও নিয়ে এসেছেন কুলির পেশায়। বাবা-ছেলে মিলে প্রতি মাসে আয় করেন প্রায় ২০ হাজার টাকা। সেখান থেকে ১২ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিতে হয়। বাকি টাকায় চলে সংসার।

মো. রহিম বলেন, 'বাজারে সব কিছুর যে দাম, এত অল্প টাকায় তো সবাই খেতেই পারব না। আমার বউ ওএমএসর দোকান থেকে চাল ও আটা কিনে আনে। এর জন্য তাকে প্রতিদিন ভোরে গিয়ে লাইন ধরতে হয়। কারওয়ান বাজারে রাতের দিকে সস্তায় কিছু সবজি ও মাছ পাওয়া যায়। আগে মাছ কিনতাম, এখন সেটাও পারি না। শুধু সবজি কিনি। সপ্তাহে ১ দিন ডিম কিনি। আগে ডিমের হালি ছিল ২৫-৩০ টাকা। তখন ছেলমেয়েদের সপ্তাহে ১টা করে ডিম খাওয়াতে পারতাম। এখন ডিমের হালি ৪৫ টাকা। অর্ধেক ডিম খাওয়াই। এভাবেই চলছে সংসার।'

টিসিবির ট্রাকসেল পয়েন্টে মানুষের ভিড়। স্টার ফাইল ছবি

রিকশা চালক রাশেদ মিয়া বলেন, 'আগে সকালে ২০ টাকা দিয়ে ২ পরোটা ও সবজি পাওয়া যেত, এখন ৪০ টাকা লাগে। ভাতের প্লেট ১৫ টাকার নিচে নাই। বেশি ভাড়া চাইলে মানুষ দিতে চায় না। আয় তেমন একটা বাড়েনি। কিন্তু খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আমাদের কষ্ট দেখার মতো কেউ নেই। দেশের নাকি উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু আমাদের তো কষ্ট বাড়ছে।'

বেসরকারি চাকরিজীবী বাচ্চু মিয়া বলেন, 'প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো বেতন পাই। তারপরও কোনো রকমে টেনেটুনে সংসার চালাই। সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে গেছে। জিনিসপত্রের এমন দাম থাকলে বউ-বাচ্চাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।'

দেখা গেল, কারওয়ান বাজারে আকারভেদে প্রতি কেজি রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৫০০ টাকায়, শিং মাছ ৩৫০-৪০০ টাকায়, টেংরা মাছ ৭৫০-৮০০ টাকায়, রূপচাঁদা মাছ ৮০০-১০০০ টাকায়, চিংড়ি মাছ ৫০০-৫৬০ টাকায়, পাঙাশ ও তেলাপিয়া মাছ ১৮০-২০০ টাকায়। এ ছাড়া, ইলিশ মাছ ১ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মাছ বিক্রেতা মো. রোকন বলেন, 'প্রতি কেজি মাছের দাম কেজিতে ন্যূনতম ২০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাজারে মাছের সরবরাহ কম। অনেক মাছের আবার সিজন চলে গেছে। তাছাড়া পরিবহন খরচসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছের দাম বেড়েছে।'

এদিন কারওয়ান বাজারে সবজির দামও ছিল কিছুটা বাড়তি। প্রতি কেজি বেগুন ৫০-৬০ টাকায়, পটল ৮০ টাকায়, শিম ৫০ টাকায়, করলা ১২০ টাকায়, চিচিঙ্গা ৬০ টাকায়, পেঁপে ৩০ টাকায়, বরবটি ও কচুর লতি ১০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়।

সবজি বিক্রেতা মো. রফিকুল ইসলামের ভাষ্য, 'বাজারে সবজির সরবরাহ কম। এ কারণেই প্রতি কেজি সবজিতে ১০ থেকে ২০ টাকাও দাম বেড়েছে। তাছাড়া শীতের সিজনে অনেক সবজি বাজারে ছিল, তাই দামও কম ছিল। কারওয়ান বাজারে যেদিন সরবরাহ বেশি থাকে থাকে, সেদিন দাম কম হয়। আর সরবরাহ কম হলে দাম বেশি হয়।'

এর বাইরে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০ টাকা, আলু ২০ টাকা, আদা ১২০ টাকা, রসুন ১৪০ টাকা, ছোলা ৯০ টাকা, চিনি ১০৮ টাকা, খোলা ময়দা প্রতি কেজি ৬৫ টাকা এবং আটা ৬০ টাকা।

এ ছাড়া প্রতি হালি মুরগির ডিম (লাল) ১৩০ টাকা ও হাঁসের ডিম ১৯০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায় ঢাকার সবচেয়ে বড় এই পাইকারি বাজারে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ২৪০ টাকা এবং পাকিস্তানি মুরগি বিক্রি হচ্ছিল ৩৩০ টাকা দরে।

প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭০০ টাকা, ছাগলের মাংস ৯০০ টাকা এবং খাসির মাংসের দাম ছিল ১ হাজার ১০০ টাকা।

Comments

The Daily Star  | English

Public universities: Admission woes deepen for students

Admission seekers are set to face increased hassle with at least 10 public universities no longer participating in the cluster-based admission test system. They are holding entrance exams on their own.

10h ago