যে জীবন পথশিশুদের

কমলাপুর রেলস্টেশনে পথশিশু শামসুল আলম,আকাশ ও লিমন। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

ঘড়িতে তখন রাত ১২টার কাঁটা পেরিয়েছে। নগরীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ'র আড়ংয়ের সামনের সিগন্যালে গাড়িগুলো তখন ছুটছে। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়তেই ফুটপাত ও সড়ক বিভাজক থেকে ফুল ও বেলুন হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালো কয়েকজন শিশু। সিগন্যালে দাঁড়ানো ব্যক্তিগত গাড়ির জানালা ঘেঁষে তাদের কোমল কণ্ঠে একটাই আকুতি `ছ্যার ফুল লাগবো, নেননা ফুল। বাড়িত যামু গা।'

তাদের মধ্যে বিশেষ করে চোখে পড়ে একটি শিশুকে। বয়স আর কতো হবে; বড়জোর বছর ৬ কিংবা ৭। হাত ভর্তি এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে সে ধর্না দেয় গাড়ির জানালায়। কিন্তু ততক্ষণ সিগন্যাল ছেড়ে দেওয়ায় ফের গাড়ি ছুটতে থাকে। সড়ক বিভাজকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে আবার কখন থামবে গাড়ি। কিছুক্ষণ পরে গাড়ি থামতেই বিক্রি করতে পারে দুটো গোলাপ। অতঃপর মুখে স্বস্তির হাসি। টাকা দিয়ে আরও দুটি গোলাপ কিনে নেওয়ার বিনিময়ে পাওয়া যায় আড্ডার অধিকার।

নাম তার জিসান। ৩ বছর আগে এই শহরে বাবাকে যখন হারায় তখন বয়স ছিল তার মাত্র ৫ বছর। সিএনজি চালক বাবার আয় দিয়ে ভালোই চলছিল। কিন্তু ৩ বছর আগে এক রাতে ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারায় তার বাবা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির প্রস্থানে সংসার চালানোর জন্য উপার্জনের তাগিদে মায়ের সঙ্গে পথে নামতে হয় ৮ বছর বয়সী জিসানকে।

পথশিশু জিসা। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

 

দিনভর তার মা ফুলের মালা বানিয়ে বিক্রি করে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ সিগন্যালে। রাত ১১টার কাঁটা পেরোতেই পুলিশের ঝক্কি ঝামেলা কমে আসে কিছুটা। এরপর গাড়ির পিছু ছুটে ছোট্ট জিসান। গলায় তখন ফুল কিনে নেওয়ার আকুতি।

'কোথায় থাকো?' জিজ্ঞেস করতেই জানায় আদাবর ট্রাকস্ট্যান্ডের ফুটপাতের একাংশে পলিথিনের এক ছাপড়ায় মায়ের সঙ্গে থাকে সে। বাবার মৃত্যুর মাস তিনেক আগে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল জিসান। বাবার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে পড়ারও ইতি তার।

ঢাকা শহরে এক জিসানের চিত্র এটি। তবে জিসান একাই নয়, ঢাকা শহরে জিসানের মতো এমন পথশিশু আরও অনেক।

শৈত্যপ্রবাহ থেকে বাঁচতে এক মা তাঁর সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন প্লাস্টিকের ত্রিপলের নিচে। এই ছবিটি ঢাকায় বাস করা ৭ লাখেরও বেশি পথশিশুর বাস্তব প্রমাণ। সম্প্রতি ঢাকার বাংলামোটর এলাকা থেকে তোলা। ছবি - আনিসুর রহমান/ স্টার

কমলাপুর স্টেশনে দেখা মিলে জিসানের মতোই পথশিশু শামসুল আলম, আকাশ ও লিমনের। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করতেই শামসুল আলম জানায় তার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জে। 'কি করে এলে কমলাপুরে?' প্রশ্নের জবাবে বলে, 'সিলেট থেইকা আইছি ৪ দিন আগে। কাইল আবার যামুগা।'

পড়াশোনা করে কিনা জিজ্ঞেস করতেই তার তৎক্ষণাৎ জবাব 'পড়ালেহা কইরা করমু কী?' জানালো সিলেট স্টেশনেই থাকে সে। খাবারের পয়সা জোগাড় করে ভিক্ষার মাধ্যমে। মাঝে মাঝে সিলেট থেকে ট্রেনে করেই এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে চলে যায়। এভাবে ভবঘুরের মতোই জীবন কেটে যায় তাদের। স্টেশনের প্লাটফর্মই রাত্রিযাপনের আশ্রয়স্থল।

শামসুল আলমের সঙ্গে থাকা আকাশ ও লিমনের বাড়ি যথাক্রমে কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে। তারা থাকে কমলাপুর রেলস্টেশনেই। রাতে ঘুমায় রেল স্টেশনের টিকেট কাউন্টারের পাশের খোলা জায়গায়।

এই দুজন অবশ্য পড়ার সুযোগ পেয়েছে। লিডো বাংলাদেশের উদ্যোগে সপ্তাহে সোম থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ২৫ জন পথশিশুকে কমলাপুর রেলস্টেশনে অস্থায়ী স্কুলের মাধ্যমে ২ ঘণ্টা পাঠদান করা হয়। পড়ার বিনিময়ে দুপুরের খাবার ও দিয়ে থাকে লিডো বাংলাদেশ। তবে সপ্তাহের বাকি দিনগুলো এবং রাতের খাবার জোগাড়ের জন্য তাদের মানুষের কাছে হাত পাততে হয়।

'বাকিদিনগুলোতে খাবার কোথায় পাও?' জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, বিক্রির পর হোটেলের অতিরিক্ত খাবার খায় তারা। একই সঙ্গে তারা বেছে নিয়েছে ভিক্ষাবৃত্তিকেও।

গভীর রাতে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে গিয়েও দেখা মেলে এমন চিত্রের। টার্মিনালের গেটের সামনে সিমেন্টের বস্তা পেতে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে পথশিশুরা। কোনো কোনো শিশু তখন রাতের খাবারের বিনিময়ে হোটেলের ময়লা সাফ করছে। সদররঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ছেলে পথশিশুদের মতো দেখা যায় মেয়ে পথশিশুদেরও। জানা যায় তাদের মধ্যে কোনো কোনো পথশিশু পূর্বে  যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, '৭৯ শতাংশ পথশিশু জীবনের কোনো একপর্যায়ে মানসিক, শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এছাড়া শুধু শারীরিক নির্যাতনেরই শিকার হয়েছে ৬২ শতাংশ পথশিশু।'

সম্প্রতি মধ্যরাতে ফার্মগেটের ফুটপাতে পলিথিনে বিছিয়ে খাবার খেতে দেখা যায় ২ পথশিশুকে। অদূরেই রাস্তার উপর  ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ময়লার স্তুপ। পলিথিনে থাকা খাবার খেয়েই তারা ফের ময়লা থেকে প্লাস্টিক ও কাগজ সরিয়ে নেওয়ার কাজে মনোনিবেশ করে।

'কী কাজ কর?'  জিজ্ঞেস করতেই তারা জানায় সিটি কর্পোরেশনের ময়লা পরিষ্কারের কাজ। একই সঙ্গে জানায় দুজনে দৈনিক ৫০ টাকার চুক্তিতে অন্যজনের হয়ে সিটি কর্পোরেশনের ময়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে।  'খাবারের কোথায় পেলে' জিজ্ঞেস করতেই জানায় রেস্টুরেন্টের ফেলে দেওয়া খাবারই খাচ্ছে ওরা।

ফার্মগেটের ফুটপাতে হোটেলের ফেলে দেওয়া খাবার খাচ্ছে দুই পথশিশু। দিনপ্রতি মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে তারা কাজ করে সিটি কর্পোরেশনের ময়লা শ্রমিকের বদলি হিসেবে। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

রাতে থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করলে জানায়, রাত ৩টা পর্যন্ত কাজ করে তারা; এরপর  ফুটপাতেই রাত কাটে তাদের। আর  দিনভর ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমেই খাবারের জোগান করে থাকে তারা।

গত দু'দিনে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় পথশিশুরা অধিকাংশই ঘুমায় রাস্তার ধারের ফুটপাতে, বাসস্ট্যান্ডে, রেলস্টেশন, শপিং মলের সামনে, পার্ক কিংবা লঞ্চ ঘাটে। বেশিরভাগ পথশিশুই ভিক্ষাবৃত্তি এবং শিশুশ্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

২০১৬ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) থেকে পথশিশুদের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার পথশিশুদের মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ শিশুর রাতে ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪০ শতাংশ শিশু প্রতিদিন গোসলহীন অবস্থায় থাকে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার মতো কোনো স্বজন নেই, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে ও ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থতায় ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারে না।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় পথশিশুদের সামাজিক সুরক্ষা ও পরিবারে পুনঃএকীকরণ প্রকল্পের আওতায় মাত্র দুটি ড্রপ- ইন-সেন্টার ও রাতে থাকার জন্য একটি ইমার্জেন্সি নাইট শেল্টার বা রাত্রি আবাস রয়েছে। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপর্যাপ্ত।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন, কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশন, লিডো, গ্রাম বাংলা উন্নয়ন কমিটি ও আহসানিয়া মিশনের এক সমন্বিত গবেষণায় বলা হয় '৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশুই পুরোপুরিভাবে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ক্ষুধার তাগিদে তারা গড়ে ১০ ঘণ্টা কাজ করে এবং ৩৫ শতাংশ পথশিশু ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকার বিষয়ক সুশাসন বিষয়ক পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন,  'শিশুরা যত ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে, তার সবই আছে পথশিশুদের৷  বিশেষ করে তাদের অধিকারের জায়গা থেকে, বঞ্চনার জায়গা থেকে, সব ধরনের ঝুঁকিতে থাকা শিশুরাই পথশিশু এটাই আমরা মনে করি৷  একটি শিশুর সবার আগে বাসস্থানের অধিকার রয়েছে, নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে, খাদ্যের অধিকার রয়েছে, শিক্ষার অধিকার রয়েছে৷ এসব কিছুই কিন্তু পথশিশুদের জন্য প্রযোজ্য৷ এর কোনো অধিকারই তারা পাচ্ছে না৷ তার ওপর শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি থাকছে রাস্তা-ঘাটে৷ তাদের ওপর অর্থনৈতিক নিপীড়ন থাকছে এবং এর চেয়েও বেশি পরিমাণে যেটা, সেটা হচ্ছে মাদক এবং নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে শিশুদের জাড়ানো হচ্ছে৷ ফলে সার্বিকভাবেই ভয়াবহ থেকেও ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে পথশিশুরা।'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

6h ago