দেওয়ানের পুল ভাঙা নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে না জানিয়ে গণশুনানি আয়োজন
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার মোঘল আমলে নির্মিত প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো 'দেওয়ানের পুল' ভেঙে নতুন সেতু নির্মাণ করা হবে কি না সে বিষয়ে জনমত জানতে আগামীকাল রোববার গণশুনানির আয়োজন করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দেওয়ানের পুল ভাঙার কাজ শুরু করে এলজিইডি। সেসময় প্রত্নতাত্ত্বিক এ নিদর্শন ভাঙা নিয়ে সমালোচনা হলে সেতুটি ভাঙা বন্ধ করতে চিঠি দেয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। স্থানীয় সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদও সেতুটি ভাঙার কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেন।
পরবর্তীতে ৪ জানুয়ারি স্থানীয় জনসাধারণের ব্যানারে একটি মানববন্ধন থেকে সেতুটি ভেঙে ফেলে দ্রুত নতুন সেতু নির্মাণের দাবি জানানো হয়।
এলজিইডি বলছে সেতুটি ভাঙা উচিত হবে কি না সে বিষয়ে জনমত জানতেই এ গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে না জানিয়ে গণশুনানির আয়োজন আবারও সমালোচনার সৃষ্টি করেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলনে সংশ্লিষ্টদের দাবি, সেতুটি ভাঙার উদ্দেশ্যেই গণশুনানির আয়োজন করছে এলজিইডি। নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে যারা ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়, তাদের ব্যবহার করে সেতু ভাঙার দাবি জোরদার করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য তাদের।
দেওয়ানের পুল সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়নে অবস্থিত। মোঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহ এর শাসনামলে (১৭১৯-৪৮) যখন বাংলার সুবাদার ছিলেন সুজা উদ্দিন খান। ১৭৪০ সালে সুবাদারের দেওয়ান (রাজস্ব কর্মকর্তা) হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সিলেট আসেন গোলাব রাম, মতান্তরে গোলাব রায়।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণে শ্রীচৈতন্যের পিতৃভূমি সম্পর্কে অবগত হয়ে গোলাব রায় সিলেট থেকে ঢাকাদক্ষিণ পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করেন যা দেওয়ানের সড়ক এবং এ সড়কের মধ্যবর্তী সেতুটি দেওয়ানের পুল নামে আজও পরিচিত।
গতবছর এই ১০ ফুট প্রস্থের সড়কটি ২৪ ফুট প্রস্থে উত্তীর্ণ করে পুননির্মাণের প্রকল্প নেয় এলজিইডি। এরই অংশ হিসেবে দেওয়ানের পুল অপসারণ করে এর স্থানে প্রশস্ত একটি পুল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে দেওয়ানের পুল ভাঙার কাজ শুরু করে এলজিইডির নিয়োগকৃত ঠিকাদার। ব্রিজটি অনেকটা ভাঙার পর বিষয়টি প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহ্য সংরক্ষক এবং স্থানীয় সচেতন মহলে নজরে এলে সমালোচনা শুরু হয়।
গত ২৮ তারিখ দ্য ডেইলি স্টারে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেদিনই দেওয়ানের পুল পরিদর্শনে প্রতিনিধি পাঠান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এছাড়াও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)র একটি প্রতিনিধিদলও ঘটনাস্থলে যান।
সেদিনই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এলজিইডি বরাবর প্রেরিত পত্রে ঐতিহাসিক এ স্থাপনা ভাঙা বন্ধে নির্দেশনা দেয়। এদিনই স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও দেওয়ানের পুল ভাঙা বন্ধ রাখতে নির্দেশনা প্রদান করেন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সেতুটি ভাঙা বন্ধ রাখা হলে ৪ জানুয়ারি সেতুটির পাশে মানববন্ধন করে দ্রুত সেতু ভেঙে নতুন ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানান স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত ১৫ জানুয়ারি সিলেট জেলা সমন্বয় সভার বৈঠকে আলোচনা শেষে সেদিনই গণশুনানির ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এনামুল কবীর।
গণবিজ্ঞপ্তিতে দেওয়ানের পুলের ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিষয়টির কোনো উল্লেখ না করে এটিকে 'পুরাতন ব্রিজ' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সাথে ব্রিজটি না ভাঙার বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, স্থানীয় সংসদ সদস্য, ঐতিহ্য গবেষক ও স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিদের অনাপত্তির বিষয় উল্লেখ না করে লেখা হয় কয়েকটি পত্রিকা ব্রিজটি না ভাঙার অনুরোধ করেছে।
এছাড়াও বিজ্ঞপ্তিটির অনুলিপি সিলেটের জেলা প্রশাসক, স্থানীয় প্রশাসন ও পরিষদকে পাঠানো হলেও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে কোন অনুলিপি প্রেরণ করা হয়নি।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক একেএম সাইফুর রহমান বলেন, 'গণশুনানি আহ্বানের বিষয়টি এলজিইডি আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি, আমরা অন্যভাবে জানতে পেরেছি। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।'
তিনি বলেন, 'দেওয়ানের পুল ভাঙা বন্ধে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠিয়েছি। তারপর স্থাপনাটি পরিদর্শন করে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রস্তুত করে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর পরবর্তী নির্দেশনার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। এ অবস্থায় গণশুনানির আয়োজন বোধগম্য নয়।'
সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের নির্বাহী পরিচালক আব্দুল হাই আল-হাদী বলেন, '১৯৬৮ সালে পুরাতত্ত্ব আইন অনুযায়ী যে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা, তা সংরক্ষিত ঘোষিত হোক বা না হোক, তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। কিন্তু দেওয়ানের পুল ভাঙার সিদ্ধান্ত এলজিইডি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তোয়াক্কা না করেই নিয়েছিল। এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে না জানিয়ে গণশুনানি আয়োজন করছে।'
তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'মূলত ঠিকাদারদের সুবিধা দিতে এবং প্রকল্প হাতছাড়া হওয়ার ভয়েই এলজিইডি তাড়াহুড়ো করে গণশুনানি আয়োজন করছে।
দেওয়ানের পুল ভাঙার কাজ শুরুর আগে এলজিইডি এই পুলের ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব সম্পর্কে জানত না বলে স্বীকার করেছেন এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এনামুল কবীর।
তিনি বলেন, 'যেহেতু একপক্ষ সেতুটি ভাঙার বিপক্ষে এবং আরেকপক্ষ সেতুটি ভেঙে নতুন সেতু নির্মাণের পক্ষে, তাই দুইপক্ষের কথা শুনতেই গণশুনানির আয়োজন। এখানে হ্যাঁ-না ভোটের মতো কোনো বিষয় নেই। কেবলমাত্র দুই পক্ষের কথা নথিভুক্ত রেখে সরকারকে অবগত করাই গণশুনানির মূল উদ্দেশ্য।'
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে অবহিত না করার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, 'তারা তাদের দিক থেকে চিঠি দিয়েছেন বলে কাজ বন্ধ আছে। আমরা এখন শুধু সাধারণ মানুষের কথা শুনতে চাচ্ছি। তাই তাদেরকে (প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর) অবহিত করা হয়নি।'
এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, 'সেতুটি ইতিমধ্যেই যতটা ভাঙা হয়ে গেছে, তাতে আর তা সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে না। তাছাড়াও সেতুটি এই স্থানে রেখে দিয়ে পাশে নতুন সেতু নির্মাণ করা হলে তা পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করবে এবং এই এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করবে। তবে সরকার শেষ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত নেবে, তাই হবে।'
সার্বিক বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, 'স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজ বন্ধ রাখার জন্য বলেছেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরও ওখানে গিয়ে দেখে এসেছেন এবং কাজ বন্ধ রাখার জন্য বলেছেন। তারা চেষ্টা করছেন স্থাপনাটি সংরক্ষণ করার জন্য। ওরা (এলজিইডি) গণশুনানি করছে, করুক। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর যদি মনে করে এটি সংরক্ষণ করতে হবে, তবে সেভাবেই তা সংরক্ষণ করা হবে।'
Comments