পরিকল্পনা কমিশন-ইআরডির গাফিলতিতেই প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বাড়ে
বাংলাদেশে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময় ও প্রাথমিক বাজেট অনুযায়ী শেষ হয় না বললেই চলে। এ বিষয়টি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য।
বিদেশি সহায়তায় পরিচালিত প্রকল্পগুলোতে কীভাবে সুশাসনের চর্চা করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনার জন্য আয়োজিত একটি বিশেষ কর্মশালা থেকে এ ধরনের প্রবণতা চলতে থাকার নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেছে।
আলোচনায় কারণ হিসেবে দুর্নীতি, খামখেয়ালিপনা, অযোগ্যতা ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে অপারগতার বিষয়গুলো উঠে এসেছে। আবার কখনো কখনো সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও, দীর্ঘদিনের অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে এসব সমস্যা দেখা দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, যেকোনো বিদেশি ঋণের আলোচনায় অংশ নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি)। কিন্তু, এই সংস্থার কাছে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পন্ন করার মতো প্রয়োজনীয় জনবলই নেই।
ইআরডি কর্মকর্তারা বিদেশি ঋণদাতার সঙ্গে আলোচনার পর ঋণের চুক্তিটি পরীক্ষা করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠান। ইআরডির আইন বিষয়ক উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখলেও তার কাছ থেকে এসব ব্যাপারে কোনো মতামত নেওয়া হয় না।
ফলে, চুক্তিতে এমন কিছু ধারা যোগ করে দেওয়া হয়, যেগুলো সবসময় বাংলাদেশের পক্ষে যায় না। এমনকি এগুলো ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব কনসালটেন্টস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্সের (এফআইডিআইসি) আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। উল্লেখ্য, এফআইডিআইসি হচ্ছে আন্তর্জাতিক নির্মাণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ২ পক্ষের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের জন্য প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ড।
দেশের জন্য সুবিধাজনক নয়, এরকম শর্তের মধ্যে আছে ঋণদাতার পক্ষ থেকে সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়ন এবং চুক্তিদাতা ও উপদেষ্টা একই হওয়া।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সেতু বিভাগে কর্মরত থাকাকালীন পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী সুরঙ্গ ও ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বেশ কিছু প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, 'এখানে স্বার্থের সংঘাত রয়েছে।'
আন্তর্জাতিক চুক্তি আইন ও এফআইডিআইসি আইন অনুযায়ী, যে পক্ষ প্রকল্পের প্রস্তাব দেবে, তারা সেটির অর্থায়ন করতে পারবে না। অথবা, তারা যদি অর্থায়ন করে, তবে ভিন্ন কোনো পক্ষকে সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নের কাজ করতে হবে।
ঠিকাদাররা একইসঙ্গে উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করতে পারবে না।
সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম আরও জানান, ঠিকাদার ও উপদেষ্টার মধ্যে কোনো ধরনের রক্ত সম্পর্ক, প্রশাসনিক, আর্থিক বা অন্য কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকতে পারবে না।
তারপরও, দেশের অসংখ্য প্রকল্পে এ ধরনের অনিয়ম দেখা যায়।
ইআরডির দায়িত্বে থাকার পরেও কেন এ ধরনের বিষয়গুলো বারবার হচ্ছে, সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সেতু বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব।
তিনি দাবি করেন, পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী সুরঙ্গ প্রকল্পে এ ধরনের কোনো অনিয়ম হয়নি।
তিনি ইআরডির কর্মকর্তাদের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের সাহায্য নেওয়ার উপদেশ দেন। তিনি জানান, এই বিভাগে চুক্তি আলোচনা করার জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন করা একটি প্রকল্পের উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশের ২২তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম আরও বলেন, 'চুক্তিতে ত্রুটি থাকলে কিছু করার থাকে না।'
তিনি জানান, এই প্রকল্পে একটি সড়কের ১ দশমিক ১ কিলোমিটার অংশ সম্প্রসারণের জন্য অনুমোদিত প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা প্রায় ১০০ কোটি ডলারের সমান।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের মোট বাজেট ১৪০ কোটি ডলার। এই প্রকল্পে ৪টি লেন ও ২টি সার্ভিস লেন রয়েছে, যার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটারের মতো। এ ছাড়াও, ঠিকাদার ১০০ বছরের গ্যারান্টিও দিচ্ছে। তাহলে কীভাবে সড়ক সম্প্রসারণের ওই প্রকল্পের খরচ এত বেশি হয়?'
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, এসব সমস্যা দূর করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে তারা একটি আইন সেল ও আর্থিক বিশ্লেষক নিয়োগ দেবেন। এই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা বাইরে থেকে এসব সেবা গ্রহণ করা অব্যাহত রাখবেন।
কর্মশালায় পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা দাবি করেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে তাদের ওপর প্রকল্প সংস্কারের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়।
উত্তরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, 'এটা ঠিক না।'
তবে তিনি স্বীকার করেন, কিছু ঠিকাদার মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অযাচিত প্রভাব বিস্তার করে থাকেন।
'একবার এক ঠিকাদার তার প্রকল্প অনুমোদনের জন্য স্বয়ং একনেকের এক বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলেন', যোগ করেন তিনি।
কর্মশালায় আলোচিত আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, অনেক মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্ধারিত মধ্যমেয়াদি বরাদ্দ শেষ হয়ে গেলেও তারা নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠাতে থাকে।
মধ্যমমেয়াদে আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, বরাদ্দের উপযোগিতা বৃদ্ধি ও সম্পদের প্রাপ্যতা সম্পর্কে অগ্রিম তথ্য দেওয়ার জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে একটি মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো (এমটিবিএফ) দেওয়া হয়, যেটি একটি বহুবার্ষিক রোলিং ব্যয় পরিকল্পনা।
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমটিবিএফ কোটা নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ হয়ে যায়। এর অর্থ হচ্ছে পরবর্তী ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে নতুন কোনো পরিকল্পনা শুরু করা যাবে না।
'মন্ত্রণালয় হলফ করে জানায় যে, এটি এমটিবিএফের সর্বোচ্চ সীমার মধ্যেই রয়েছে। এটি একটি বড় ধরনের মিথ্যে। এটা প্রতারণা। কীভাবে আপনারা এ ধরনের ভুয়া সনদ দিয়ে থাকেন?', প্রশ্ন তোলেন খন্দকার আনোয়ারুল।
সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে পুরো প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন Project delay, cost overrun: Ills lie deep in ERD, Planning Commission
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments