সলপের ঘোল: শত বছরেও স্বাদ অটুট

স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা দুধ নির্দিষ্ট সময় জ্বাল দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় সুস্বাদু একটি পানীয়। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ রেল স্টেশন এলাকায় তৈরি এই পানীয়টি খ্যাতি পেয়েছে ‘সলপের ঘোল’ হিসেবে।
সলপের ঘোল এখন শত বছরের ঐতিহ্য। ছবি: স্টার

স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা দুধ নির্দিষ্ট সময় জ্বাল দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় সুস্বাদু একটি পানীয়। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ রেল স্টেশন এলাকায় তৈরি এই পানীয়টি খ্যাতি পেয়েছে 'সলপের ঘোল' হিসেবে।

পানীয় হিসেবে বাঙালিদের কাছে ঘোল ও মাঠার এখনো ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সিরাজগঞ্জ ছাড়াও 'সলপের ঘোলের' স্বাদ নিচ্ছেন দেশের নানা জায়গার মানুষ। এই পানীয় বিক্রি করে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জীবন-জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছেন। 

সলপ রেল স্টেশন ঘিরে গড়ে ওঠা এই ব্যবসার পেছনের ইতিহাস শতবর্ষের। ছবি: স্টার

সলপ রেল স্টেশন ঘিরে গড়ে ওঠা এই ব্যবসার পেছনের ইতিহাস শতবর্ষের। ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতি বছর বৈশাখ মাসে এখানে আয়োজন করা হয় 'ঘোল উৎসব'।

স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা যায়, শত বছর আগে সলপ এলাকার মো. সাদেক আলী নামের এক ব্যক্তি কাজের খোঁজে রাজশাহী যান। সেখানে এক ঘোষের কাছ থেকে ঘোল ও মাঠা বানানো শিখে এসে ১৯২২ সালে সলপ রেল স্টেশন এলাকায় এর ব্যবসা শুরু করেন।

সাদেক আলী প্রথম দিকে বাড়িতে ঘোল ও মাঠা বানিয়ে স্টেশন এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করতেন। ধীরে ধীরে উল্লাপাড়া থেকে কলেজের শিক্ষার্থীরা এসে তার তৈরি এই পানীয়ের স্বাদ নিতে শুরু করেন। জমে ওঠে তার ব্যবসা। একসময় স্টেশনের কাছে একটি দোকান গড়ে তোলেন তিনি।

ঘোল ও মাঠা বিক্রিকে কেন্দ্র করে সলপ রেল স্টেশন এলাকায় গড়ে উঠেছে অনেকগুলো দোকান। ছবি: স্টার

সাদেক আলীর মৃত্যুর পর তার ছেলেরা এই ব্যবসার হাল ধরেন। তাদের হাতে গড়ে ওঠে আরও ৪টি দোকান। তাদের তৈরি ঘোলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়। দেখাদেখি আরও অনেকে এই ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হন।  

সাদেক আলীর নাতি মো. আব্দুল মালেকের ভাষ্য, ঘোল ও মাঠার ব্যবসা কেবল অর্থ উপার্জনের মাধ্যম নয়। এটি এখন এই অঞ্চলের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

মালেক বলেন, 'সলপ স্টেশনে একসময় বেশি ট্রেন দাঁড়াত না। অনেকটাই ফাঁকা থাকত স্টেশন এলাকা। কিন্তু শুধু ঘোলের ব্যবসা কেন্দ্র করে এখানকার চিত্রই পালটে গেছে।'

এখানকার বাসিন্দা মতিউর রহমান জানান, এখন এই এলাকার শতাধিক মানুষ ঘোল ও মাঠার ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত। কেউ কারখানায় কাজ করছেন, কেউ দুধের জোগান দিচ্ছেন, কেউ খড়ির ব্যবসা করছে।  সবই হচ্ছে  ঘোলের  ব্যবসাকে কেন্দ্র করে।

সলপের ঘোলের স্বাদ নিচ্ছেন দেশের নানা জায়গার মানুষ। ছবি: স্টার

তার হিসাবে প্রতিদিনি সলপ এলাকায় এক হাজার মণ দুধের ঘোল ও মাঠা তৈরি হয়। তবে রোজার মধ্যে এবং অতিরিক্ত গরমে উৎপাদন বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

সম্প্রতি সলপ এলাকার কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখা যায়, ঘোল-মাঠা তৈরির পাশাপাশি ঘোলের সঙ্গে মুড়কি মিশিয়ে এক ধরনের মজার খাবারও তৈরি করা হচ্ছে। এগুলোর স্বাদ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন রসনাবিলাসীরা।

বগুড়ার সান্তাহারের বাসিন্দা রাজিব হোসেন চাকরিসূত্রে সিরাজগঞ্জে থাকেন। সলপের ঘোল খাওয়ার জন্য উল্লাপাড়ায় এসেছিলেন তিনি। বলেন, 'এখানকার ঘোল ও মাঠার সুনাম অনেক শুনেছি। তাই এর স্বাদ নিতে এসেছি। নিজের ভালো লেগেছে। তাই পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের জন্যও কিছুটা নিয়ে যাচ্ছি।'

এখানকার ঘোল-মাঠা ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেনের দাবি, গুণগত মানের প্রশ্নে তারা কখনো আপস করেন না। তাই শতবর্ষেও সলপের ঘোলের স্বাদ অটুট আছে। আর যেহেতু এটা এখানকার একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, তাই এই সুনাম ধরে রাখার ব্যাপারেও তারা সচেষ্ট থাকেন।

সলপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত হোসেন জানান, সলপের ঘোলের ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতিবছর এখানে মেলার আয়োজন করা হয়।

সলপের ঘোলের স্বাদ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ঘোল ব্যবসায়ীদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার দাবিও জানান এই জনপ্রতিনিধি।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladeshi-Americans eager to help build new Bangladesh

July uprising and some thoughts of Bangladeshi-Americans

NRBs gathered in New Jersey showed eagerness to assist in the journey of the new Bangladesh forward.

12h ago