চট্টগ্রামের বেশিরভাগ আসনেই নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্ররা
রাত পোহালেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হবে। এর আগে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে ১২৫ জন প্রার্থী ভোটের প্রচারণা শেষ করেছেন শুক্রবার সকাল আটটায়। প্রচারণায় শেষ সময় পর্যন্ত তারা ব্যস্ত সময় পার করেছেন, যতটা সম্ভব ভোটারদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে মোট ভোটার ৬৩ লাখ ১৪ হাজার ৩৯৭ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ৩২ লাখ ৮৯ হাজার ৫৯০ এবং নারী ভোটার ৩০ লাখ ২৪ হাজার ৭৫১। এছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গ থেকে ৫৬ জন ভোটার রয়েছেন। জেলায় মোট ভোট কেন্দ্র রয়েছে ২ হাজার ২৩টি এবং বুথ রয়েছে ১৩ হাজার ৭৩২টি।
চট্টগ্রামে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হলেও পরবর্তীতে অনেক নির্বাচনী এলাকায় সহিংসতায় উৎসবের আমেজ নষ্ট করে দেয়। স্থানীয়দের মতে, প্রায় সবগুলো সহিংসতার ঘটনাই ঘটেছে নৌকার সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের সমর্থকদের মধ্যে।
সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম-১২ আসনে পটিয়া উপজেলার শান্তির হাট ও কুসুমপুরা এলাকায়। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচারণায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মীদের হামলার অন্তত ১০টি ঘটনার অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মীদের ওপর স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের হামলা ও বিভিন্ন জায়গায় নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্পে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ উঠেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের বিরুদ্ধে।
সেখানে নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রতিপক্ষের হামলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর ভাই ও বোনও আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতাকর্মীরা তার প্রচারণায় হামলা করেছে বলে শামসুল অভিযোগ করলেও মোতাহেরুল সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। মোতাহেরুলের অভিযোগ, সামশুলের লোকেরা তার কর্মীদের উপর হামলা ও বিভিন্ন জায়গায় নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করেছে।
চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই), চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ), চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা), চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) এবং চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) সহ আরও অনেক আসনে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ভোটাররা প্রাক-নির্বাচনী সহিংসতার মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের কৃষক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, 'প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াও।'
তবে চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি), চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড), চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী), চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান), চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া), চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও), চট্টগ্রাম-৯ (চট্টগ্রাম-৯) কোতোয়ালি-বাকলিয়া), চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-পাঁচলাইশ), চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী), চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনগুলোতে নির্বাচনী প্রচারণা তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ছিল।
অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগ বনাম স্বতন্ত্র
চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনে মোট ১৯টি দলের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও স্থানীয়দের মতে, বেশিরভাগ আসনেই মূলত আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
তবে চট্টগ্রাম-৫ ও চট্টগ্রাম-৮ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী না থাকায় ভোটযুদ্ধ থাকবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনী আসন সমঝোতার অংশ হিসেবে এই দুটি আসন থেকে প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয়। তবে এসব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
স্থানীয়দের মতে, চট্টগ্রাম-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহবুব-উর-রহমান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের মধ্যে ভোটের লড়াই থাকবে। গিয়াস চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও মিরসরাই উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
চট্টগ্রাম-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার সনি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের প্রার্থী সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির প্রার্থী সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদ মাইজভাণ্ডারী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হোসেন মো. আবু তৈয়ব প্রচারণায় বেশ ভালোই ছিলেন। তবে নজিবুল বশর ভোটের দুই দিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় এখন এই আসনে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
তাদের মধ্যে নজিবুল এই আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য এবং খাদিজাতুল সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। সাইফুদ্দিন বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান এবং তৈয়ব ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
চট্টগ্রাম-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহফুজুর রহমান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জামাল উদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে ভোটের লড়াই হবে বলে স্থানীয়দের ধারণা। মাহফুজুর বর্তমান সংসদ সদস্য এবং জামাল আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের সভাপতি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক ভিপি।
চট্টগ্রাম-১০ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চু ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মনজুর আলমের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা। এদের মধ্যে বাচ্চু বর্তমান সংসদ সদস্য আর মনজুর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র।
চট্টগ্রাম-১১ আসনে ভোটের লড়াই হবে মূলত আওয়ামী লীগ প্রার্থী এম এ লতিফ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমনের মধ্যে। এদের মধ্যে লতিফ বর্তমান সংসদ সদস্য এবং সুমন চসিকের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বন্দরনগরীর দক্ষিণ হালিশহর এলাকায় ব্যারিস্টার সুলতান আহমেদ কলেজের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।
চট্টগ্রাম-১৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল জব্বার চৌধুরীর মধ্যে ভোটের লড়াই হবে। নজরুল বর্তমান সংসদ সদস্য এবং জব্বার চন্দনাইশ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
চট্টগ্রাম-১৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মোতালেবের মধ্যে ভোটের লড়াই হবে। এদের মধ্যে আবু রেজা বর্তমান সংসদ সদস্য এবং মোতালেব সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
চট্টগ্রাম ১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমানের মধ্যে ভোটের লড়াই হবে। এদের মধ্যে মুস্তাফিজুর বর্তমান সংসদ সদস্য এবং মুজিবুর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।
ভালো অবস্থানে মন্ত্রিসভার তিন সদস্য
দলের কোনো শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায় বর্তমান মন্ত্রিসভার তিন সদস্য ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী তাদের নিজ নিজ আসনে স্পষ্টতই সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন।
সাইফুজ্জামান চট্টগ্রাম-১৩ আসনে, হাছান চট্টগ্রাম-৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এবং মহিবুল চট্টগ্রাম-৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এদের মধ্যে, সাইফুজ্জামান এবং হাছান একটানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় চতুর্থবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মহিবুল ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মহিবুল চসিকের প্রয়াত মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বড় ছেলে।
চট্টগ্রাম-৪, চট্টগ্রাম-৬-এ আওয়ামী লীগের হিসাব-নিকাশ
চট্টগ্রাম-৪ আসনে ছয়টি দলের মোট সাতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী এসএম আল মামুন ভালো অবস্থানে রয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
সীতাকুণ্ড উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুন সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। দলীয় মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি।
সীতাকুণ্ডের স্থানীয় মিজানুর রহমান বলেন, 'মামুনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কে হবে তা আমরা জানি না কারণ আমরা অন্য প্রার্থীদের তেমন প্রচারণা দেখতে পাচ্ছি না।'
যোগাযোগ করা হলে মামুন বলেন, তিনি প্রত্যেক প্রার্থীকে শক্তিশালী মনে করেন তবে নিজের জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।
চট্টগ্রাম-৬ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। তিনি এই আসনে ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
এ আসনে একজন স্বতন্ত্রসহ তিনটি ভিন্ন দলের আরও চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও স্থানীয়রা জানান, নির্বাচনে করিমের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কে হবেন তা তারা জানেন না।
একই অবস্থা চট্টগ্রাম-৭, চট্টগ্রাম-৯ ও চট্টগ্রাম-১৩ আসনেও। স্থানীয়দের মতে, এসব আসনে আওয়ামী লীগের কোনো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাবেক ছয় উপজেলা চেয়ারম্যান
চট্টগ্রামে ছয়জন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ছয়টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে দুজন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন এবং বাকিরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এদের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন চট্টগ্রাম-১ আসনে গিয়াস উদ্দিন, চট্টগ্রাম-২ আসনে হোসেন আবু তৈয়ব, চট্টগ্রাম-১৪ আসনে আবদুল জব্বার এবং চট্টগ্রাম-১৫ আসনে আবদুল মোতালেব। তারা সবাই আওয়ামী লীগ মনোনয়ন চেয়েছিলেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন চট্টগ্রাম-৪ আসনে এস এম আল মামুন এবং চট্টগ্রাম-১২ আসনে মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী।
স্থানীয়দের মতে, এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং ওইসব প্রার্থীদের এলাকায় ব্যাপক প্রচার প্রচারণার কারণে ভোটাররা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ পাচ্ছেন।
সহিংসতা, পেশিশক্তির বিরুদ্ধে সিইসির হুঁশিয়ারি
গত ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সফরে আসেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে চট্টগ্রামের স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেন তিনি।
ভোটের দিন সহিংসতা ও পেশিশক্তির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন সিইসি। তিনি বলেন, ভোটকেন্দ্রের ভেতরে কেউ পেশিশক্তির চর্চা করলে ভোট স্থগিত করা হবে।
Comments