মানিকগঞ্জ-২: নৌকার মমতাজের প্রতিপক্ষ আ. লীগের ৪ স্বতন্ত্র প্রার্থী
মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মমতাজ বেগমের প্রতিদ্বন্দ্বী নিজ দলের হেভিওয়েট চার নেতা। জয়ের ব্যাপারে মমতাজ আশাবাদী হলেও ছেড়ে কথা বলছেন না তার প্রতিদ্বন্দ্বী-আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও।
তারা বলছেন, গত ১৫ বছরে সারাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও এই নির্বাচনী এলাকায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। এবারের নির্বাচনে তাই জয়ের ব্যাপারে তারাও আশাবাদী।
জাতীয় সংসদের ১৬৯ এবং মানিকগঞ্জ-২ আসনটি গঠিত হয়েছে সিংগাইর পৌরসভা, সিংগাইর ও হরিরামপুর উপজেলা এবং মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নসহ মোট ২৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌর এলাকা নিয়ে।
এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন তিন বারের সংসদ সদস্য, সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। এবারের নির্বাচনে তার বিপক্ষে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন নিজ দলের চার স্বতন্ত্র প্রার্থী। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, সিংগাইর উপজেলা পরিষদের দুই বারের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মুশফিকুর রহমান খাঁন হান্নান, জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু ও স্বেচ্ছাসেবকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহাবুদ্দিন আহমেদ চঞ্চল।
জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মমতাজ বেগম বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বীতায় এই আসনে সংসদ সদস্য হন। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মঈনুল ইসলাম খান শান্তকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে তিনি সংসদ সদস্য হন। এরআগে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য হন। গত ১৫ বছরে হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর-মানিকগঞ্জ ও হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর-হরিরামপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ, শতভাগ বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ, ভূমিহীন ও গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, নদীভাঙনরোধে বাঁধ নির্মাণসহ এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি এই উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে আবারও নৌকায় ভোট চান।
মমতাজ বেগম বলেন, 'নৌকা এদেশের উন্নয়নের প্রতীক। নৌকা জিতলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবেন। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষুর, কেচি, আর বদনা মার্কা জিতলে শেখ হাসিনার কোনো কাজেই আসবে না। তাই জনগণ ভুল করবে না। তারা আমাকে ভালবাসে। আমাকেই নৌকা প্রতীকে ভোট দেবে। জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।'
তবে, ভিন্ন কথা বলছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
কেটলি প্রতীকের প্রার্থী মুশফিকুর রহমান খান হান্নান বলেন, 'আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী। বিগত সময়ে আমি দলীয় মনোনয়ন চেয়েছি। কিন্তু পাইনি। নেত্রী যখন যাকে মনোনয়ন দিয়েছে তার হয়ে কাজ করেছি। এবার সুযোগ হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার হয়েছি। আমি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি দুই বার সিংগাইর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। অন্য প্রার্থীরা সবাই মিলে যে ভোট পেয়েছে। আমি একাই তার চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছি। একবার কয়েকশ ভোটের কারণে জয়ী হতে পারিনি। ২০০১ সালে বিএনপির মন্ত্রী শামসুল ইসলাম খান মারা যাওয়ার পর এই আসনের উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে ৬৪ হাজার ভোট পেয়ে জয়ী হই। কিন্তু আমাকে ৬১ হাজার ভোট দেখিয়ে মন্ত্রীর ছেলে মঈনুল ইসলাম খান শান্তকে ৬৪ হাজার দেখানো হয়। এবারের নির্বাচনেও আমি জিতব আশা করি।'
তিনি বলেন, 'ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলাম। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। এবারের নির্বাচনের জন্য আমি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়েছি।'
এই আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এবং একজন শিল্পপতি। ট্রাক প্রতীক নিয়ে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনিও জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।
তিনি বলেন, 'ঢাকার পাশের আসন হিসেবে এখানে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। মমতাজ বেগম সংগীত জগতের জন্য সেরা। কিন্তু রাজনীতির মাঠের জন্য যোগ্য নয়। তিনি কিছুই করতে পারেননি এলাকার জন্য। এখানে অনেক কিছু করার আছে। আমি জয়ী হলে সেসব করব।'
এই আসনে আরেক প্রার্থী আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফীন টুটুল। সাবেক জাতীয় ফুটবলার টুটুল ২০০১ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপির প্রয়াত শিল্পমন্ত্রী শামসুল ইসলাম খানের কাছে হেরে যান। ২০০৮ সালে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো দলীয় মনোনয়ন পান। কিন্তু জাতীয় পার্টির সাথে আসন ভাগাভাগির জন্য এস এম আব্দুল মান্নানকে এই আসনটি ছেড়ে দিতে হয়। লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে এস এম আব্দুল মান্নান এই আসনে সংসদ সদস্য হন। তারপর প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি দলীয় মনোনয়ন চেয়েছেন। কিন্তু পাননি। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার সুযোগ থাকায় তিনিও প্রার্থী হয়েছেন। মোড়া প্রতীক নিয়ে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি ট্রাক প্রতীকের প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলুর আপন চাচাতো ভাই।
তিনি বলেন, 'একটি আদর্শ নিয়ে চলছি। ক্রীড়া ও ক্রীড়া সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। যা আজও বিরল। আমি ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ দুটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ে সেরা হতে পারেনি। অনেক অর্জন আছে। ভয় কিসের। দেখা যাক।'
এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে তরুণ প্রার্থী হলেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ চঞ্চল। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি। তিনি এই আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য শামসুদ্দিন আহমেদের ছেলে। শামসুদ্দিন ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নৌকা, ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীদের পরাজিত করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
চঞ্চল স্বেচ্ছাসেবকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সাবেক এই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা বলেন, আমি আমার উপজেলার একক প্রার্থী। আর তারা নয়জন রয়েছেন একটি উপজেলার। এছাড়া, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন কখনও প্রতিনিধি পায়নি। আমরা বঞ্চিত। আমাদের ভোট নিয়ে সিংগাইরের নেতারা এমপি হয়। আমার মনে হয়, আমার এলাকার জনগণ এবার বুঝে শুনেই ভোট দেবে। আমি আশাবাদী।'
নৌকা প্রতীক ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রসহ এই পাঁচ প্রার্থী ছাড়া আরও রয়েছেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের ফেরদৌস আহমেদ আসিফ, বিএনএমের এ কে এম ইকবাল, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির এ কে নাহিদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের তানভীর রহমান ও বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী জাকির হোসেন। তারা সবাই তাদের দলীয় প্রতীক নিয়ে এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এই আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৯৮৯।
Comments