গুলিতে নিহত ঢাকায়, আসামি বাদীর এলাকার লোকজন

কোটা সংস্কার আন্দোলনে গত ১৯ জুলাইয়ে সাভার থেকে তোলা ছবি। ছবি: স্টার

গত ৫ আগস্ট সকালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় রাজধানীর উত্তরায় গুলিতে নিহত হন লাভলু মিয়া নামে এক ব্যক্তি।

এর এক মাস পর লাভলুর চাচাতো ভাই রিকশাচালক দুখু মিয়া ২২১ জনকে আসামি করে উত্তরা পূর্ব থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। যাদের মধ্যে ২১০ জনের বাড়িই রংপুরে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুখু ও লাভলুর বাড়িও সেখানেই।

রংপুরের আসামিদের বেশিরভাগই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। মামলায় আরও ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং আরও বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আরও কয়েকজন মন্ত্রীর নির্দেশে ৪১ বছর বয়সী লাভলুকে হত্যা করা হয়েছে।

আগস্টের প্রথম দিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উত্তরা পূর্ব ও যাত্রাবাড়ী থানায় করা আরও পাঁচটি মামলার সন্ধান পেয়েছে দ্যা ডেইলি স্টার।

এসব হত্যা রাজধানীতে সংঘটিত হলেও প্রতিটি মামলায় অভিযুক্তরা নিহতদের নিজ জেলার বাসিন্দা।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলাগুলোর পেছনে অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে এবং এতে অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হবে।

এ ধরনের মামলা নেওয়ার সময় সময় পুলিশদের সতর্ক থাকা দরকার ছিল।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মানুষকে হয়রানির জন্য মামলা করা হলে প্রকৃত ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অসম্ভব।'

এই পত্রিকার বিশ্লেষণ করা ছয়টি মামলার বাকি আসামিদের মধ্যে আছেন শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান খান ও হাছান মাহমুদসহ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা।

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলেও একইভাবে বিএনপি-জামায়াতের শত শত নেতা-কর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের হয়রানির জন্য অসংখ্য মামলায় আসামি করা হয়েছে। এসবের বিচার প্রক্রিয়ায় অভিযোগ প্রমাণের চেয়ে তাদের কারাগারে ঢোকানোই ছিল মূল লক্ষ্য।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিরোধীদলের সদস্যদের বিরুদ্ধে এমন অপরাধের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে যা সংঘটিতও হয়নি। মৃত ব্যক্তি বা বিদেশে বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগও আনা হয়েছে।

দুখু নামে যে ব্যক্তি তার চাচাতো ভাই লাভলু হত্যার ঘটনায় মামলা করেছেন বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ডেইলি স্টারের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।

মামলার আসামি রংপুরের স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, 'গত ৫ আগস্ট আমি পীরগঞ্জে ছিলাম। ঢাকার একটি হত্যাকাণ্ডে আমি কীভাবে অংশ নিতে পারি? তখন যাতায়াতের কোনো উপায় ছিল না। আমার মনে হয় তারা আমাকে শুধুমাত্র হয়রানির জন্যই আসামি করেছে।'

জুলাই এর ২০ তারিখে, রাজধানীর শনিরআখড়ায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির অঙ্গসংগঠন গণতান্ত্রিক স্বেচ্ছাসেবক দলের কদমতলী শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মদ হাবিব (৪৫) নিহত হন। তার স্ত্রী আয়েশা বেগমের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে পুলিশের সাথে আওয়ামী লীগ কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

এ ঘটনায় ২৮ আগস্ট কুমিল্লার চান্দিনার ৫৭ জনকে আসামি করে যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে, চার সন্তানের মা আয়েশা বলেন, 'আমি শুধু অভিযোগপত্রে সই করেছি। কাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে তা আমার জানা ছিল না। আমার স্বামীর এক বন্ধু, যিনি তার দলের নেতাও ছিলেন, অভিযুক্তদের তালিকা তৈরি করেছিলেন। ওই ব্যক্তি কুমিল্লার বাসিন্দা। আমি শুধু আমার স্বামী হত্যার  ন্যায়বিচার চাই।'

গত ৫ আগস্ট তার ভাই ফজলুল করিমকে হত্যার ঘটনায় জামালপুরের বকশীগঞ্জের আনোয়ার হোসেন আয়নাল বাদী হয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ৩৯ আসামির মধ্যে ২৪ জন তার নিজ গ্রামের বাসিন্দা।

এ বিষয়ে আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। 

আসামিরা জামালপুরের কেন জানতে চাইলে তার ছোট ভাই বলেন, 'তাদের অনেকে হয়তো ঢাকায় ছিল, কেউ হয়তো গ্রামে ছিল। আমরা তদন্ত কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেছি যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন তাদের নাম বাদ দিতে'।

একই থানায় বকশীগঞ্জের আরেক ব্যক্তি আক্তার হোসেন বাদী হয়ে ১৭ জনের বিরুদ্ধে ৫ আগস্ট একটি হত্যা মামলা করেন। আসামিদের মধ্যে ১১ জনের বাড়ি বকশীগঞ্জ উপজেলায়।

আক্তার বলেন, সেদিন বিজয় মিছিলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজন গুলি চালালে তার ছোট ভাই রিপন নিহত হয়।

তিনি বলেন, 'ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানতে পারি যে হত্যাকাণ্ডের সময় আমার উপজেলার লোকজন সেখানে ছিল।'

৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন মিরাজুল ইসলাম (২১)। তিন দিন পর মারা যান তিনি।

এ ঘটনায় গত ২৪ আগস্ট তার বাবা লালমনিরহাটের বাসিন্দা আব্দুস সালাম বাদী হয়ে জেলার তিন সাবেক সংসদ সদস্যসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন। সেদিন ওই এলাকায় যেসব পুলিশ ও ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীদের স্থানীয়রা গুলি চালাতে দেখেছিল তাদের কাউকে এই মামলায় আসামি করা হয়নি।

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ খুরশীদ আলম খান বলেন, 'এটা স্পষ্ট যে এই ধরনের মামলা হয়রানির জন্য করা হচ্ছে। পুলিশের সতর্ক হওয়া উচিত।'

'তাছাড়া, অভিযোগকারীরা এই ধরনের মামলা দায়েরের জন্য আইনি সমস্যায় পড়তে পারেন।'

এসব ঘটনায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানি করা হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

গত ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যায়নি তাদের নাম বাদ দিতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

জেড আই খান বলেন, 'সরকারের উচিত সন্দেহজনক মামলার একটি তালিকা তৈরি করা এবং কোনো নিরপরাধ মানুষ যাতে ভোগান্তির শিকার না হয় তা নিশ্চিত করা। সুপ্রিম কোর্টও সরকারের কাছে এসব মামলার তালিকা চেয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারে।'

Comments

The Daily Star  | English

100 days of govt: Major steps taken towards a ‘new Bangladesh’

Despite numerous challenges, the interim government over the last 100 days has taken many timely and significant steps that align with the vision of building a “new Bangladesh”, observed Transparency International Bangladesh yesterday.

6h ago