অল্পের জন্য ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে ফেরা

২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার রারাই গ্রামে গভীর রাতে হাত বাঁধা অবস্থায় ব্যবসায়ী আব্দুল বাসিতকে পুলিশ ভ্যান থেকে নামতে বাধ্য করা হয়।

গাড়ি থেকে নামানোর পর জকিগঞ্জ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর আবদুন নাসের ও এসআই মিজানুর রহমান সরকার তাকে বলেন পালাতে।

ঠিক তখনই বাসিত সামনে টর্চের আলো দেখে চিৎকার করে ওঠেন, 'বাঁচান, আমাকে বাঁচান'।

আলো হাতে ভারত সীমান্তে টহলরত বিজিবি সদস্যরা হুইসেল বাজাতে বাজাতে তার দিকে ছুটে আসেন। হৈচৈ আর কান্নার শব্দে কিছুক্ষণের মধ্যে স্থানীয় কিছু লোকজনও সেখানে জড়ো হয়ে যান।

ঘটনার একদিন পর সিলেট রেঞ্জের তৎকালীন উপ-মহাপরিদর্শক বরাবর দায়ের করা অভিযোগে বাসিতের স্ত্রী  এই কথাগুলো উল্লেখ করেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়, দৌড়ে পালাতে গেলেই বাসিতকে গুলি করে হত্যার 'ক্রসফায়ার নাটক' মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা ছিল পুলিশের।

জকিগঞ্জের খাশেরা গ্রামের বাসিন্দা বাসিত গত ২২ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টারকে সে রাতে কী ঘটেছিল তার বর্ণনা দেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ঘটনাটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নজরে আনে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠাতে বলেছে।

২০২১ সালের ৩ জুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে লেখা চিঠিতে ওই বছরের ১৮ মে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদন সংযুক্ত করে মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওসি আবদুন নাসের ও এসআই মিজানুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। পরে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, অপর এসআই সম্রাজ মিয়ার বিরুদ্ধেও অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

তদন্ত এখনও শেষ হয়নি

আড়াই বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো কর্মকর্তাকে শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা, বিভাগীয় মামলার তদন্ত এখনও শেষ করতে পারেনি পুলিশ সদর দপ্তর।

এরই মধ্যে কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অন্তত ছয়টি চিঠি লিখে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম শেষ করে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানাতে বলেছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গত বছরের এপ্রিল, মে ও আগস্ট মাসে এবং চলতি বছরের ১ এপ্রিল তিন বার সময়সীমা বেঁধে দিলেও কোনো লাভ হয়নি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চিঠির জবাবে সিনিয়র সচিবের দপ্তর থেকে প্রতিবার বলা হয়েছে, পুলিশের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং বিভাগীয় মামলার কার্যক্রম চলছে।

২০২২ সালের ২০ মার্চ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে লেখা এক চিঠিতে এসআই মিজান ও এসআই সম্রাজের বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভাগীয় মামলায় ৫০ জন সাক্ষীকে শনাক্ত এবং ১৫ জন সাক্ষীর বক্তব্য রেকর্ড করার কথা বলা হয়।

চিঠিতে বলা হয়, জকিগঞ্জের সাবেক ওসি আবদুন নাসেরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।

এই সংবাদদাতা গত ৮ মে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ২০ মে'র মধ্যে তদন্ত শেষ করার অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানান।

জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে ঢিলেমি করা হয়েছে, তবে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি পেতে হবে।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাঝে মাঝে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অনুরোধে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে দায়ীদের শাস্তি দেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের দেশে এখনও গড়ে ওঠেনি।'

পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ইস্যুতে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমিরুল ইসলাম বলেন, ওই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাগুলো তদন্তাধীন।

বাসিতের বর্ণনায় সেদিনের ঘটনা

ডেইলি স্টারকে বাসিত বলেন, সেদিন তাকে 'ক্রসফায়ারে' হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে ওসি স্থানীয়দের তার বিরুদ্ধে ডাকাতির চেষ্টা মামলা করতে বলেছিলেন, কিন্তু কেউ তার সেই নির্দেশ মানেনি।

এরপর ওসি তাকে জকিগঞ্জ থানায় নিয়ে আসেন এবং অপরাধী হিসেবে বাসিতের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাসিত জানান, ঘটনার আগের দিন রাত ৮টার দিকে ওসি নাসের তার মোবাইল ফোনে ফোন করে দেখা করতে বলেন।

তিনি বলেন, 'আমি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি স্থানীয় মানিকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহাতাব উদ্দিন ও পার্শ্ববর্তী কসকনকপুর ইউপি চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিনকে জানাই।'

তাদের পরামর্শে তিনি ইউনিয়ন অফিস বাজারে ওসির সঙ্গে দেখা করেন। যেখান থেকে তাকে কাছাকাছি একটি চেকপোস্ট এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পুলিশ তাকে আটক করে হাতকড়া পরিয়ে দেয়।

'আমি বার বার আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাদের কাছে কাকুতি-মিনতি করি। কিন্তু তারা আমার কোনো কথাই শোনে না,' বলেন বাসিত।

এরপর নাসের তাকে একটি পুলিশ ভ্যানে ওঠান। তার কাছে থাকা পাঁচ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোনও নিয়ে নেওয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরির পর তাকে নিয়ে রারাই গ্রামে আসে পুলিশ। যেখানে তাকে পুলিশের গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে পালাতে বলা হয়।

বাসিত বলেন, কিছু প্রভাবশালী প্রতিবেশী, যাদের সঙ্গে তার জমি নিয়ে বিরোধ ছিল, তারা তাকে 'হত্যা করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করে থাকতে পারে'।

তিনি বলেন, এর আগে ছিনতাই ও মাদক পাচারের অভিযোগে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে দুটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসায়।

বাসিত আরও বলেন, 'ঘটনার একদিন পর পুলিশ আমার এবং আরও চার জনের বিরুদ্ধে ডাকাতি চেষ্টার মামলা করায় আমার পরিবারকে ভয়ংকর খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।'

হাইকোর্টের আদেশে ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি বাসিল জামিনে মুক্তি পান।

সম্প্রতি যোগাযোগ করা হলে মানিকপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাহাতাব উদ্দিন জানান, জেলা ডিবিতে কর্মরত থাকাকালে ওসি নাসেরের সঙ্গে বাসিতের সুসম্পর্ক ছিল। নাসের জকিগঞ্জের ওসি হওয়ার পর বাসিত চেয়ারম্যানকে ডেকে ওসির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

বর্তমানে সিলেটের এসপি কার্যালয়ে পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত নাসের নিজেকে ও অন্য কর্মকর্তারা নির্দোষ বলে দাবি করেন।

তিনি বলেন, যেহেতু অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে, তাই আমি কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের দোষী সাব্যস্ত করে তাহলে হয়তো ব্যবস্থা নেবে। আর সেই কর্মকাণ্ডে সংক্ষুব্ধ হলে আমরা আদালতে যেতে পারি।

তিনি আরও বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে ১০টি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন এবং প্রতিবেদনে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।

এ বিষয়ে কথা বলতে মিজান ও সম্রাজের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

Comments

The Daily Star  | English

Tax-free income limit may rise to Tk 3.75 lakh

The government is planning a series of measures in the upcoming national budget to alleviate the tax pressure on individuals and businesses, including raising the tax-free income threshold and relaxing certain compliance requirements.

12h ago