নরসিংদী

নিয়োগ বাণিজ্যের দায় স্বীকার, তবুও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি

ইছাখালী ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা ও অধ্যক্ষ আ ক ম রেজাউল করীম (ইনসেট)। ছবি: সংগৃহীত

নরসিংদী পলাশ উপজেলার ইছাখালী ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসায় নিয়োগ নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলেও, এ বিষয়ে গত দুই মাসে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি বিতর্কিত পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা মাদ্রাসায় যোগদান করে নিয়মিত চাকরি করছেন।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ওই মাদ্রাসার নিয়োগ পরীক্ষার আগে প্রার্থীর সঙ্গে ফোনে কথোপকথন, প্রশ্ন সরবরাহ ও নিয়োগ বাণিজ্য ছাড়াও অধ্যক্ষ আ ক ম রেজাউল করীমের বিরুদ্ধে মাদ্রাসার এতিমখানায় জেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ চাল ও দোকান ভাড়া আত্মসাৎসহ আরও অনিয়মের অভিযোগ আছে। 

রেজাউল করিম ২০০০ সালে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন।

মাদ্রাসার সভাপতি ও ঘোড়াশাল পৌরসভার মেয়র আল মুজাহিদ হোসেন তুষার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অধ্যক্ষ রেজাউল করিম অপরাধ করলেও, সবাইকে ম্যানেজ করে চলেন। তাই পার পেয়ে যান। মূলত তার অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণেই মাদ্রাসাটির এখন বেহাল দশা। অধ্যক্ষ তার চাকরির মেয়াদ তিন বছর আছে জানিয়ে আমাকে বলেছেন যে, তাকে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি স্ট্রোক করতে পারেন। স্ট্রোক করলে আমাকে দায়ভার নিতে হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আগের সভাপতিদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করে পদ ছাড়তে বাধ্য করার অভিযোগ আছে। আমি তার বিভিন্ন অপকর্মের নথিপত্র সংগ্রহ করেছি, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

মাদ্রাসা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ ডিসেম্বর তিনটি শূন্য পদের বিপরীতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। বিজ্ঞপ্তিতে ইবতেদায়ী শাখার প্রধান, কম্পিউটার অপারেটর ও ল্যাব সহকারী পদের জন্য আবেদন চাওয়া হয়।

২৩ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেদিন বিকেলে কম্পিউটার অপারেটর পদে পলাশ উপজেলার তানভীর আহমেদ ও ল্যাব সহকারী পদে শিবপুর সাধারচর এলাকার ইতি আক্তারকে নির্বাচিত করা হয়।

নিয়োগ পরীক্ষার দুই দিন আগে ল্যাব সহকারী পদে এক আবেদনকারীর সঙ্গে অভিযুক্ত অধ্যক্ষের ফোনে কথোপকথন ফাঁস হয়, যেখানে অধ্যক্ষ টাকার বিনিময়ে ওই প্রার্থীকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেন।

পরে ২৯ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসন ওই নিয়োগ কমিটির সভাপতি আবু কাউছারকে অভিযুক্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।

নোটিশে বলা হয় যে, 'নিয়োগ পরীক্ষায় কম্পিউটার অপারেটর ও ল্যাব সহকারী পদে প্রার্থীকে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, যা প্রকাশিত অডিও ক্লিপের কথোপকথনের মধ্যে সুস্পষ্ট।'

একইদিন দ্য ডেইলি স্টারের বাংলা অনলাইনে 'নরসিংদীতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ' শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর আরও ৪ চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে অধ্যক্ষের ঘুষ লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।

তাদের মধ্যে চাকরিপ্রার্থী মো. আশরাফ আলীকে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৮ লাখ টাকা নেন অধ্যক্ষ। পরে, চাকরি দিতে না পারায় অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ফেরতও দেন।

আশরাফ আলীর অগ্রণী ব্যাংকের স্টেটমেন্ট থেকে জানা যায়, তার অ্যাকাউন্টে রেজাউল করিম ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে ৪ ধাপে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন।

জানতে চাইলে আশরাফ আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অধ্যক্ষ চাকরি দিতে না পারায় আমার দেওয়া ৮ লাখ টাকার মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা নগদ দেন এবং বাকি ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দিয়েছেন।'

অপর তিন প্রার্থীর কাছ থেকে অধ্যক্ষ নগদ টাকা নিয়েছেন এবং চাকরি না হওয়ায় ফেরত দিয়েছেন বলেও জানান তারা।

শিক্ষক বহিষ্কারের অভিযোগ

ওই মাদ্রাসার ২ শিক্ষককে নিয়ম বহির্ভূতভাবে বহিষ্কারের অভিযোগও আছে অধ্যক্ষ রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে।

ভুক্তভোগী শিক্ষক কুতুব উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একই অভিযোগে আমিসহ দুই শিক্ষককে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু আমি অধ্যক্ষের বিরাগভাজন হওয়ায় এবং তার দাবিকৃত এক লাখ টাকা দিতে না পারায় আমাকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু অপরজনের বহিষ্কারাদেশ ছয় মাসের মধ্যে প্রত্যাহার করা হয়।'

এ সংক্রান্ত নথিপত্র থেকে জানা যায়, হাইকোর্ট থেকে গত বছর বহিষ্কৃত শিক্ষককে পুনর্বহালের নির্দেশনা দেওয়া হলেও গত এক বছর ৪ মাসেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও গত এক বছরে প্রতিবেদন তৈরি হয়নি।

তদন্ত কমিটির সদস্য ও মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য কারিউল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সহকারী শিক্ষক কুতুব উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি মাদ্রাসার সাবেক সভাপতির সই জাল করে সার্টিফিকেট মাদ্রাসা অধিদপ্তরে জমা দিয়েছেন। আমরা মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কাছে এ বিষয়ে ডকুমেন্ট চাইলে অধ্যক্ষ একটি ফটোকপির পাতা দেন, যার মধ্যে কারও সই ও স্মারক নেই। তাই ফটোকপির ওপর ভিত্তি করে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে কুতুব উদ্দিন আদৌ সই জালিয়াতি করেছেন কিনা আমরা নিশ্চিত নই।'

জানতে চাইলে নরসিংদী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোবারুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলা প্রশাসন থেকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল। তার অপরাধ অনেকটাই প্রমাণিত ছিল। শাস্তি না হয়ে থাকলে আমরা অবশ্যই তাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।'

অভিযুক্ত অধ্যক্ষ আ ক ম রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আশরাফ চাকরির জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে কোনো টাকা লেনদেন হয়নি। কোনো প্রার্থীর কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয়নি।'

'চাকরিপ্রার্থী উম্মে হাফসাকে যে প্রশ্ন দেওয়া হয়েছিল, সে প্রশ্নে পরীক্ষা হয়নি। তাছাড়া তিনি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেননি। আমার হয়তো তার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল, এটা আমার ভুল হয়েছে,' বলেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম বলেন, 'নিয়োগ বাণিজ্যের কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর নানা নাটকীয়তায় মাদ্রাসার সভাপতি আবু কাউছার পদত্যাগ করেছেন। নতুন সভাপতিকে এ বিষয়ে আবারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সভায় অবশ্যই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Tax authority to split. Will it bring the desired outcome?

Touted as a historic overhaul, the move has ignited debate over whether it will drive meaningful reform or merely deepen the layers of bureaucracy, given the NBR's persistent failure to meet its targets.

14h ago