অপরাধ ও বিচার

ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আহ্বান এক মায়ের

'সত্যতা বিচার না করে কোনো মিথ্যাচার ছড়াবেন না এবং সুবিচার বাধাগ্রস্ত হয় এমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করবেন না'

প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুর ঘটনায় অবাধ, সুষ্ঠ, নির্মোহ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদঘাটন ও তার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের মা আনোয়ারা মাহবুব।

গতকাল বুধবার গণমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে মাগুরা জেলার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মাহাবুবুল হকের স্ত্রী আনোয়ারা মাহবুব ছেলের প্রতি ন্যায় বিচারেরও আহ্বান জানিয়েছেন।

'আমি তদন্তকারীর কাছে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাই। এরই সাথে বাংলাদেশের সব মিডিয়া হাউস এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে আবেদন জানাই যে আপনারা দয়া করে সঠিক উপায়ে তথ্য যাচাই-বাছাই এবং সত্যতা বিচার না করে কোনো মিথ্যাচার ছড়াবেন না এবং সুবিচার বাধাগ্রস্থ হয় এমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করবেন না।'

তিনি বলেন, 'আমি বাংলাদেশের আইনের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থাশীল এবং আমি বিশ্বাস করি এই মামলায় সবার জন্য সুবিচার আমরা পাবোই।'

বিবৃতিতে আনোয়ারা মাহবুব বলেন, 'আজ আমি আপনাদের সামনে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হাজির হয়েছি একটি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু (রাষ্ট্রপক্ষের মতে অবহেলাজনিত মৃত্যু) এবং তারপরে শুরু হওয়া গণমাধ্যমের অন্যায্য অনুমান, মিথ্যা প্রচার, তথ্যের বিকৃতি এবং সর্বোপরি ভুল ব্যাখ্যার ওপর আলোকপাত করার জন্য।'

গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহজাহান রোডে সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারের ফ্ল্যাট থেকে পড়ে যান বাসাটির অনিয়মিত গৃহকর্মী প্রীতি উরাং।

আনোয়ারা মাহবুব বলেন, 'এই মৃত্যু এক বিশাল ধাক্কা হিসাবে আসে আশফাক-তানিয়া দম্পতির জন্য, যারা দুর্ঘটনার সময় ঘুমিয়ে ছিল। পরবর্তিতে তারা দুজনেই আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আশফাক দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে পুলিশকে খবর দেয়। পরে এই দম্পতিকে ৩০৪ ক ধারা বাংলাদেশ পেনাল কোড ১৮৬০ এর অধীনে অবহেলাজনিত মৃত্যুর দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, যার তদন্ত এখনো চলছে এবং পুলিশ এখনও কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি।'

তিনি বলেন, গত ৭১ দিন ধরে আশফাক ও তানিয়াকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে।

গত ২ এপ্রিল প্রীতির মৃত্যু নিয়ে প্রকাশিত বাংলাদেশের ১১৭ জন নাগরিকের একটি বিবৃতির উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমি মনে করিয়ে দিতে চাই তদন্তের সময় এই বিবৃতিগুলি আদালত অবমাননার সমতুল্য কারণ এটি এখন বিচারের বিষয়।

'উক্ত বিবৃতি এই মামলায় "পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা"র নিন্দা করেছে।

'তথাকথিত "পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা" সম্পর্কে আমি বলতে চাই, দুর্ঘটনা ঘটার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমার ছেলে ও তার স্ত্রীকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়, পরের দিন দুপুর ২টার দিকে আদালতে হাজির করার আগে প্রায় ২৮ ঘণ্টা মোহাম্মদপুর থানায় আটকে রেখে পুলিশ তাদের একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে আদালত তাদের হাজতে পাঠায়,' বলেন তিনি।

পরে তাদের কারাগারের গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন আবার চার দিনের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

পরে মামলাটি পুলিশের গোয়েন্দা শাখার কাছে হস্তান্তর করা হয়। গোয়েন্দারা আশফাক ও তানিয়াকে তাদের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং পরবর্তীতে আদালতে হাজির করলে তাদেরকে কারাগারে পাঠায়।

'আশফাকের মা হিসাবে, আমি উক্ত ১১৭ জনের বিবৃতিতে করা দাবিটি স্পষ্টভাবে অস্বীকার করি যে আশফাক এবং তানিয়া তাদের গৃহকর্মীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিল। কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ, কোনো তদন্তকারী এবং এমনকি প্রীতি উরাং এর পরিবারের দায়ের করা মামলাটিও এই ধরনের দাবি করেনি। সুতরাং, কে উক্ত নাগরিকদের কাছে এবং কোন প্রমাণের ভিত্তিতে এই ধরনের অভিযোগ করেছে তা স্পষ্ট নয়,' বলেন আনোয়ারা মাহবুব।

'আমি জানতে চাই যে উক্ত ১১৭ জন নাগরিকের কাছে এমন কোন প্রমাণ আছে যা নিশ্চিত করে যে প্রীতি ওই ফ্ল্যাট থেকে পড়ে যাওয়ার আগে প্রায় ১৩ মিনিট ধরে গ্রিল থেকে ঝুলছিল।'

'কীসের ভিত্তিতে উক্ত বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে যে আশফাকের বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজটি হারিয়ে গেছে তাও স্পষ্ট নয়,' বলেন তিনি।

আনোয়ারা মাহবুব বলেন, 'আশফাক ও তানিয়া তাদের বাড়ি থেকে মোবাইল ফোনে সরাসরি সম্প্রচারের জন্য শুধুমাত্র চাইনিজ একটি ক্যামেরা ব্যবহার করতেন যেমনটি আজকাল অনেক পরিবার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে।'

'যেহেতু এটি একটি লাইভ ক্যামেরা এবং কোনো ডিভাইস বা মেমোরি কার্ডে কোনো সংরক্ষিত ফুটেজ ছিল না, তাই এই ফুটেজ হারিয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না', বলেন তিনি।

২০২৩ সালের আগস্টে সৈয়দ আশফাকের বাড়ি থেকে সাত বছর বয়সী ফেরদৌসি পড়ে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হলে ওই ১১৭ জনের বিবৃতিতে সেটি নিয়ে কল্পিত তথ্য দেওয়া হয় বলেন আনোয়ারা মাহবুব।

'ওই বিবৃতিতে দাবি করা হয় ফেরদৌসির প্রজনন অঙ্গে ৩ সেমি X ৩ সেমি X ৩ সে.মি পরিমাপের একটি ক্ষত হয়েছে। এই দাবিটি তীব্র আপত্তিকর।'

২০২৩ সালের ৪ আগস্ট দুর্ঘটনার পর ফেরদৌসিকে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয় তখন সেখানকার ডাক্তাররা তার আঘাতটি এইভাবে রেকর্ড করেছেন: "ল্যাবিয়া মিনোরা থেকে এনাল স্ফিংক্টর পর্যন্ত মাঝখানে ৩ সেমি X ২ সেমি X ২ সেমি পরিমাপের একটি ক্ষত"। "ল্যাবিয়া মিনোরা" শব্দটির সঙ্গে পরিচিত যে কেউ জানবেন যে ল্যাবিয়া মিনোরা হলো দুটি ছোট এবং পাতলা ত্বকের টিস্যু যা মহিলা প্রজনন অঙ্গের বাইরে অবস্থিত এবং এটি গভীরে অবস্থিত নয়।'

'আমি বিস্মিত যে, এই ১১৭ জন নাগরিক, যাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষা, সাংবাদিকতা, গবেষণা, ফৌজদারি তদন্ত এবং আইনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সম্মানিত এবং দক্ষ, এই ধরনের সংবেদনশীল বিষয়ে তারা কীভাবে এই ধরনের ভুল দাবি করলেন, বিশেষ করে যখন পুলিশের তদন্ত চলছে,' বলেন আনোয়ারা মাহবুব।

'একটি 'স্পট ভিজিটের' কথা উল্লেখ করে, উক্ত বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে যে ফেরদৌসি পরে যাওয়ার আগেই আঘাত পেয়েছিল যার ফলে সে নিজের জীবন নিজেই কেড়ে নেবার চেষ্টা করেছিল'

'এই ধরনের গুরুতর দাবি কি কেবল কোনো জায়গায় গিয়ে এবং বস্তুগত প্রমাণ ছাড়াই প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে? মাসব্যাপী চলা তদন্তে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ আমার ছেলের কোনো অসঙ্গতি খুঁজে পায়নি এবং পরবর্তীতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়, যা পরে ফেরদৌসির পরিবার এবং ঢাকার সিএমএম আদালত উভয়ই গ্রহণ করে। এরপর আদালত আশফাক ও তানিয়াকে খালাস করে দেয়,' বলেন আনোয়ারা মাহবুব।

ফেরদৌসী এবং তার পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, 'এটি কখনই আদালতের বাইরে করা কোনো নিষ্পত্তি ছিল না। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, ট্রেজারি চালান নং ৩১০ এর মাধ্যমে শিশু আইন, ২০১৩ এর অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিচার বিভাগীয় অ্যাকাউন্টে সবার সম্মতিতে একটি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ নভেম্বর ১, ২০২৩ এ  জমা দেয়া হয়।'

বিবৃতিতে করা সমস্ত মিথ্যা দাবি এবং ইঙ্গিত প্রত্যাখ্যান করে সৈয়দ আশফাকুল হকের মা বলেন, 'এই ধরনের ধারাবাহিক অপপ্রচার কেবল সমাজকেই কলঙ্কিত করে না, বরং এই বিষয়ে তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিকেও প্রভাবিত করে।'

তিনি বলেন, সৈয়দ আশফাকুল হকের স্ত্রী তানিয়া খন্দকারও একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। তানিয়া ভোলা জেলার ভাষাসৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম খন্দকার আব্দুল মান্নানের মুক্তিযুদ্ধের শক্তিতে বলিয়ান একজন সুযোগ্য নাতনি।

'আমি নিজে কৃষিতে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮০ এর দশকে প্রেসিডেন্ট পদকপ্রাপ্ত একজন কৃষিবিদ। আমার ছোট ছেলে আশফাক তার মুক্তিযোদ্ধা বাবার মতই জীবনে সবসময় নিয়ম, নীতি, নৈতিকতা ও আদর্শে আপোষহীন ছিল এবং এখনো আছে,' বলেন আনোয়ারা মাহবুব।

তিনি বলেন, 'আশফাক তার পেশাগত ৩৩ বছরের জীবনে বলিষ্ঠ ও নির্ভীক সাংবাদিকতার কারণে অনেকের হীন স্বার্থে আঘাতজনিত কারণে তার অনেক পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিপক্ষ ও শত্রু সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি ধারণা করছি।'

'তাই সেইসব স্বার্থান্বেষী মহলের ঈর্ষা, ক্ষোভ, রোষের শিকার স্বরূপ নানাবিধ অলীক, কল্পিত, নির্জলা মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের মাধ্যমে আশফাক-তানিয়া দম্পতিকে মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার বানানো হচ্ছে এবং প্রাপ্য ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিতকরণের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা বা অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে বলে আমি মনে করি।'

তিনি বলেন, 'নানাবিধ বানোয়াট এবং কুরুচিপূর্ণ অপপ্রচারের কারণে উভয় পরিবারেরই বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশুরা পর্যন্ত সামাজিক, মানসিক এবং দৈহিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন যা একটি  সুষ্ঠ বিচার ব্যবস্থার পরিপন্থী। তাই এসব কুরুচিপূর্ণ এবং উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাই।'

'আমার বয়স হয়েছে। ৮৫ বছর বয়সে এসে আমার ছেলে এবং তার স্ত্রীর প্রতি এই অন্যায় আমি আর সহ্য করতে পারছি না,' বলেন এই মা।

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

2h ago