ফোন করে ইংরেজিতে চাকরির অফার, প্রতারণার নতুন রূপ

গ্রাফিক্স: আনোয়ার সোহেল

অনলাইনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা দিনকে দিন বাড়ছে। মোবাইল কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট পাঠানোর পাশাপাশি ফোন করেও দেওয়া হচ্ছে 'ঘরে বসে আয় করার সুযোগ'।

অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেকে কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন, কথা বলেন ইংরেজিতে। কখনো কখনো আবার বাংলাদেশি কোনো ডিজিটাল এজেন্সি বা মার্কেটিং এজেন্সির কর্মী বলেও দাবি করেন।

সম্প্রতি এই ধরনের ফোন কল পাওয়া অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। যারা ফোন করছেন তারা কারা, তা জানতে অন্তত ১৫টি নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু চাকরিদাতা কারোরই খোঁজ মেলেনি।

১৫টি নম্বরের মধ্যে নয়টি বন্ধ পাওয়া গেছে। বাকি ছয়টি নম্বরে কল রিসিভ করে অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি বলেছেন, এই ধরনের কোনো চাকরির অফার তারা দেননি, এমনকি এ বিষয়ে তাদের কোনো ধারণাও নেই।

চাকরির অফার দিচ্ছে কারা

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মোবাইলে এমনই একটি চাকরির অফার পান লামিয়া (ছদ্মনাম)।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার কাছে একটা বাংলাদেশি নম্বর থেকে কল এসেছিল। নারীকণ্ঠের একজন ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। তিনি জানান, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কল করেছেন। আমি ঘরে বসে চাকরি করতে চাই কি না জানতে চান।'

লামিয়াকে বলা হয়, তিনি যদি তাদের পাঠানো দুটো ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করেন তাহলে তার ফোনে ৩০০ টাকা পাঠানো হবে।

তিনি বলেন, 'আমার কাছে কিছুটা খটকা লাগে। তখন আমি বাইরে ছিলাম। তাই কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দেই। কিন্তু আমার কাজের প্রয়োজন। তাই পরে আমি ওই নম্বরে কল করে কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু তখন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ বাংলাদেশি নারী ফোন ধরেন। আমি চাকরির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি রীতিমতো আকাশ থেকে পড়েন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে তিনি আমাকে কখনো কল করেননি এবং এ ধরনের কোনো চাকরির অফারও দেননি। অথচ আমার কাছে ওই নম্বর থেকেই কলটি এসেছিল।'

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতারকরা মূলত 'ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল' বা ভিওআইপি ব্যবহার করে এই কলগুলো করছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) উত্তরের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সহকারী কমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস (যেমন বিকাশ) প্রতারণাসহ এই ধরনের আর্থিক প্রতারণার সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা কিছু অ্যাপ ব্যবহার করে এই ফোনগুলো করে থাকে। এই সার্ভিসটাকে বলে ভিওআইপি।'

তিনি বলেন, 'যার কলটা আপনি রিসিভ করছেন, তিনি আসলে ভিওআইপি ব্যবহার করে অন্য কারো কলার আইডি ব্যবহার করে আপনাকে কল দিচ্ছে। এর মাঝে কয়েকটা ধাপ আছে। এই কলের ব্যাকএন্ডে গেলে কোন দেশ থেকে বা কোন অ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা জানা যায়।'

বিষয়টি নিয়ে আইটি বিশেষজ্ঞ তানভীর আহমেদ বলেন, 'ভয়েস ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে ভিওআইপি। এ প্রক্রিয়ায় ভয়েসকে ডিজিটাল সিগন্যালে রূপান্তর করে সেটা ইন্টারনেট প্রটোকলের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।'

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে টেলিকম অপারেটর ও আইপি টেলিসেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তসংযোগের ক্ষেত্রে বিটিআরসি অনুমোদিত ইন্টার কমিউনিকেশন এক্সচেঞ্জ বা আইসিএক্স প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেয়। যদি দেশের বাইরে থেকে কোনো ভয়েস আসে, সেটা পৌঁছে দিতে কাজ করে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে বা আইজিডব্লিউ।'

অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে কল এসেছে কি না সেটা বোঝার উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটা গ্রাহকের পক্ষে বোঝা সম্ভব না।'

লামিয়ার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তানভীর আহমেদ বলেন, 'কোনো মোবাইল নম্বর ক্লোন করে সেটা থেকে কল করা এখন প্রায় অসম্ভব। তবে নম্বর মাস্কিং (যার মাধ্যমে দুই পক্ষ একে অপরের কাছে প্রকৃত ফোন নম্বর প্রকাশ না করে কথা বলতে পারে) করার মাধ্যমে হয়তো এটা হতে পারে।'

'পিগ বুচারিং ফ্রড'

পুলিশ বলছে, আকর্ষণীয় বেতনে ঘরে বসে পার্টটাইম ও ফুলটাইম চাকরির প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ১০-১২ লাখ টাকাও হারিয়েছেন এই ধরনের অভিযোগ তারা নিয়মিত পেয়ে থাকেন।

চক্রগুলো সাধারণত প্রথমে অল্প পরিমাণ টাকা দিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে। তারা তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে অতিরিক্ত সুদসহ অর্থ ফেরত দেবে, বড় অঙ্ক পাঠালে বেশি সুদ পাওয়া যাবে—এমন প্রলোভন দেখিয়ে তারা অর্থ হাতিয়ে নেয়।

এমনই একটি অভিজ্ঞতা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশি একটি নম্বর থেকে আমার কাছে কল আসে। নারীকণ্ঠের একজন ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। তিনি নিজেকে "স্ন্যাপটেক ডিজিটাল"র কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। বলেন, তার একটি কন্টাক্ট থেকে আমার নম্বর পেয়েছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে পারব কি না। তার কাছে একটি জব অফার আছে।'

'আমি বিস্তারিত জানতে চাই। তিনি বলেন, আমরা আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপে নক দিচ্ছি। পরে আমাকে সালমা সুলতানা নামে একজন একটি দেশি নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট পাঠান।'

'আমাকে শুরুতে দুটি ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে বলা হয়। সাবস্ক্রাইব করে তাদেরকে স্ক্রিনশট পাঠানোর পর তারা আমার ফোনে ৩০০ টাকা পাঠায়। পরে আমাকে একটি টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ করা হয়। ওই চ্যানেলে আরও ৭০-৮০ জন ছিলেন। সেখানে আমাদের টাস্ক দেওয়া হতো। সবাই টাস্ক শেষ করে স্ক্রিনশট পাঠাত।'

'পরে একটা ওয়েলফেয়ার সেশন নেওয়া হতো। সেখানে দুই হাজার টাকা থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত তারা চাইত। বলা হয়েছিল, মার্চেন্টের ক্রিপ্টোকারেন্সির অনুমান ঠিক প্রমাণের জন্য আমাদেরকে একটি অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে হবে। সেখানে বলা হয়েছে—দুই হাজার টাকা পাঠালে দুই হাজার ৬০০, পাঁচ হাজার পাঠালে সাত হাজার, নয় হাজার পাঠালে ১২ হাজার ৬০০, ১৫ হাজার পাঠালে ২১ হাজার, ৩০ হাজার পাঠালে ৪২ হাজার টাকা ফেরত পাঠানো হবে।'

'টেলিগ্রাম গ্রুপটিতে থাকা অনেকেই দুই হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত ওই নম্বরে পাঠিয়ে স্ক্রিনশট দিতে থাকেন। আমি তাদেরকে টাকা পাঠাইনি। পরে আমাকে গ্রুপ থেকে বের করে দেয়,' বলেন আশিকুর।

'স্ন্যাপটেক ডিজিটাল'র বিষয়ে খোঁজ করে একটি লিংকডইন প্রোফাইল পাওয়া গেছে। সেখানে বলা হয়েছে, এটি কানাডার একটি প্রতিষ্ঠান। তারা মূলত ডিজিটাল মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কাজ করেন।

লিংকডইনে দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট লিংকে ক্লিক করলে সেটি সচল পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ওই লিংকডইন প্রোফাইলে যোগাযোগ করলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

আশিকুর যে ধরনের প্রতারণার বর্ণনা দিয়েছেন, ইন্টারপোলের প্রতিবেদন অনুযায়ী একে বলা হয় 'পিগ বুচারিং ফ্রড'। এটি এক ধরনের 'ইনভেস্টমেন্ট ফ্রড' বা বিনিয়োগ প্রতারণা।

এক্ষেত্রে প্রতারকরা শুরুতে কিছু অর্থ ফেরত দিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে পরবর্তীতে বিনিয়োগ করতে বলে। অনেক ক্ষেত্রে শুরুর দিকে বিনিয়োগ করলে অর্থ ফেরতও পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতারকদের মূল উদ্দেশ্য হলো বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া।

ইন্টারপোল বলছে, এশিয়াতে যত ধরনের আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত 'পিগ বুচারিং ফ্রড'। এটি শুরু হয় ২০১৯ সালে এবং করোনা মহামারির সময় মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ে।

বিশেষ করে এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোতে অপরাধমূলক সংগঠনগুলো এই ধরনের প্রতারণার জন্য রীতিমতো একটি ব্যবসায়িক কাঠামো দাঁড় করিয়েছে বলেও ইন্টারপোলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

পুলিশ বলছে, এই ধরনের প্রতারণা মূলত বিদেশি একটি চক্র করে থাকে। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছে বাংলাদেশের কিছু অসাধু নাগরিক। এ ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে ইতোমধ্যেই কয়েকজন চীনা ও বাংলাদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এডিসি জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, 'এটা ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম—মূলত বিদেশিদের দ্বারা পরিচালিত। তারা টাকা সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশিদের ব্যবহার করে। আমরা প্রায়ই অভিযান চালাচ্ছি, গ্রেপ্তার করছি। কিন্তু যাদেরকে ধরছি তারা মূলত সহযোগী। আমাদের দেশে অবস্থান করে এই ধরনের প্রতারণায় জড়িত কয়েকজন চীনা নাগরিককেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।'

কয়েক ধাপে লেনদেন, অভিযুক্তরাও ভুক্তভোগী

প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কয়েক লাখ টাকা হারানোর ঘটনায় নিয়মিত অভিযোগ, অভিযান ও গ্রেপ্তার হলেও এখন পর্যন্ত টাকা ফেরত আনার উদাহরণ খুবই কম। কারণ, প্রতারকরা খুবই সুচতুরভাবে টাকাটা সরিয়ে নেয়। তাদের প্রতারণার মডেলটি এমনভাবে ডিজাইন করা যে অনেক সময় দেখা যায়, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি নিজেও একজন ভুক্তভোগী।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এডিসি জুনায়েদ আলম বলেন, 'অনেকে আমাদের বলেন যে ১০-১২ লাখ, ১৪ লাখ টাকা হারিয়েছেন। কিন্তু তাদের টাকা উদ্ধার করাটা খুবই জটিল প্রক্রিয়া। কারণ যে মডেলে প্রতারণা হয়ে থাকে সেখানে ভিক্টিমদেরও অনেক সময় ভিক্টিমাইজ করা হয়।'

'ধরেন আপনাকে তারা টার্গেট করল, বলল যে তাদের কাছে রেজিস্ট্রেশন করলে ৩০০ টাকা পাবেন। ওই টাকা যে নম্বর থেকে আসছে সেই নম্বরটাও দেখা যায় আরেকজন ভিক্টিমের। ওই ৩০০ টাকা ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে পাঠিয়েছে।'

'এখন যে নম্বরে আমি টাকা পাঠালাম সেই নম্বরের মালিকের নামেই তো মামলা করব, অভিযোগ করব। কিন্তু ওই নম্বরটাও কোনো একজন ভুক্তভোগীর। এটা খুবই জটিল চক্র। এখানে কয়েক স্তরে অর্থ লেনদেন হয়, যাতে মূল অপরাধীকে ধরা না যায়।'

'প্রতারকরা এমনভাবে এটা ডিজাইন করেছে যে, করিম বিনিয়োগ হিসেবে টাকা পাঠালে সেটা রহিমের কাছে আয় হিসেবে যাবে, রহিম বিনিয়োগ হিসেবে টাকা পাঠালে সেটা লিজার কাছে আয় হিসেবে যাবে এবং একপর্যায়ে পুরো টাকাটা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হবে।'

অনলাইনে কাজের অফারসহ অপরিচিত নম্বরে যেকোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও আইটি বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, অনেকে না বুঝে এই ধরনের প্রতারণার শিকার হন, আবার অনেকে লোভে পড়ে সর্বস্ব হারান। তাই এই ধরনের কোনো কাজের অফার পেলে সবার আগে যাচাই করুন। যেই প্রতিষ্ঠানের নাম বলা হচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠানের আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে কি না খোঁজ নিন।

তাদের ভাষ্য, এ ধরনের কল পেলে নিশ্চিতভাবে ধরে নিন যে প্রতারক চক্রের কেউ আপনাকে টার্গেট করেছে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকুন এবং এ ধরনের কোনো প্রতারণার শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানান।

তানভীর আহমেদ বলেন, 'এ ধরনের কল পেলে পরবর্তীতে ওই নম্বরে কল ব্যাক করা ঠিক হবে না। যে নম্বর থেকে আপনার কাছে এ ধরনের অফার দেওয়া হবে, ওই নম্বরটি বাংলাদেশের যে মোবাইল অপারেটরের, তাদের কাস্টমার কেয়ারে কল করে বিষয়টি জানিয়ে রাখতে পারেন এবং যে নম্বর থেকে কল এসেছে সেটি তাদের দিয়ে রাখতে পারেন। এতে করে ওই অপারেটর এ বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।'

Comments

The Daily Star  | English

New uniform, monogram sans boat on the cards for police

According to police sources, a new monogram for the Bangladesh Police has already been determined. It will no longer feature a boat

6h ago