সোনারগাঁয়ে ৪ জনের মৃত্যু

মসজিদের মাইকে ঘোষণার পর গণপিটুনিতে অংশ নেয় কয়েকশ গ্রামবাসী

পুলিশ পাহারায় নিয়ে যাওয়া হয় গণপিটুনিতে নিহতদের মরদেহ। ছবি: স্টার

গ্রামে ডাকাত পড়েছে—মসজিদের মাইকে এই ঘোষণার পর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে গণপিটুনিতে চার জন নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় গুরুতর আহত একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

সোনারগাঁয়ে বিস্তীর্ণ 'বড়বিল' এলাকায় গতরাতে এ ঘটনা ঘটে। কয়েকশ একর আয়তনের এই বিলের চারপাশে তিনটি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম আছে। রাতে স্থানীয় একাধিক মসজিদের মাইক থেকে ডাকাত প্রতিরোধের জন্য মাইক থেকে লোকজনকে লোক জড়ো করা হয়।

আজ সোমবার স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

নিহতদের মধ্যে তিন জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারা হলেন সোনারগাঁয়ের রাজাপুর শেখেরহাট গ্রামের জাকির হোসেন (৩৬), আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের শামসুল হকের ছেলে আব্দুর রহিম (৪৮), একই উপজেলার জালাকান্দী গ্রামের মজিদ হোসেনের ছেলে নবী হোসেন(৩৫)। আব্দুর রহিম গত বছরের মার্চে ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। নবী হোসেনের বিরুদ্ধেও ডাকাতির মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

নিহত আরেক জনের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। নিহতদের মধ্যে জাকিরের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আছে। আহত মোহাম্মদ আলীকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) ভর্তি করা হয়েছে।

সোনারগাঁ থানা পুলিশ জানায়, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির খবর আসে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ('খ' সার্কেল) বিল্লাল হোসেনের নেতৃত্বে বড়বিলে গিয়ে বাঘরী গ্রাম থেকে একজনকে মৃত এবং দুইজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। আহতদের মধ্যে একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। পরে সকালে বিলের সুখেরটেক গ্রামে আরও দুজনের লাশ পাওয়া যায়।

স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে কাজরদী গ্রামে এক বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতরা এক জনকে কুপিয়ে আহত করে। এই ঘটনার পর থেকে গ্রামবাসী ক্ষুব্ধ ছিল। রোববার রাতে কয়েকজনকে বিলে ঘোরাফেরা করতে দেখে আশেপাশের একাধিক গ্রামের মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে গ্রামবাসী ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে ধাওয়া দিয়ে কয়েকজনকে পিটুনি দেয়।

সুরতহাল প্রতিবেদনে হতাহতদের শরীরে শাবল, টেঁটাসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে ঘটনাস্থল থেকে কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় একটি স্টিল মিলের শ্রমিক বলেন, রাত সোয়া ১০টার দিকে মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা শুনে তিনি বিলে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন কয়েকশ গ্রামবাসী বিলের মধ্যে 'ডাকাতদলের' সদস্যদের খুঁজছে। একজনকে খুঁজে পেয়ে লোকজন মারধর করে। বিলের অন্যপাশেও আরও কয়েকজনকে পেয়ে মারধর করে গ্রামবাসী।

তিনি বলেন, 'গ্রামবাসী যে যা পাইছে তা হাতে নিয়া বিলে নামছে। ওইগুলা দিয়াই মারছে। ওরা (গণপিটুনির শিকার) খালি গায়ে ছিল, পরনে শুধু হাফপ্যান্ট ছিল। তাগো হাতে কোনো অস্ত্র দেখি নাই।'

বাঘরী গ্রামের লেবুরটেক জামে মসজিদের ইমাম জহিরুল ইসলাম বলেন, 'তারাবির নামাজ শেষ হওয়ার পর আমি তখন মসজিদেই ছিলাম। গ্রামবাসী এসে এই ডাকাত পড়েছে বলে মসজিদের মাইকে অ্যানাউন্স করে। এর আগে আরও দুই-তিনটা মসজিদ থেকে ডাকাতের বিষয়ে মাইকে বলে। লোকজন তখন ডাকাত খুঁজতে বিলে নামে।'

রাতে লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশের সঙ্গে ছিলেন কাচপুর ইউনিয়ন পরিষদের নয় নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, 'আহত অবস্থায় ডাকাতদলের এক সদস্য পুলিশের কাছে ভিডিও জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি জানান, 'মদনপুরের নাজিম উদ্দীন ভূঁইয়া কলেজের সামনে দিয়ে বিলে যান তারা। বানিয়াবাড়ি গ্রামের একটি বাড়ি তাদের টার্গেট ছিল। এইজন্য বিলের ভেতর উঁচু একটি জায়গায় তারা প্রায় সাতজন জড়ো হয়েছিলেন। আরও কয়েকজনের আসার কথা ছিল। এরমধ্যেই মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা শুনে গ্রামবাসী বিলে নেমে পড়লে তারা দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করেন।'

'মাইরের ঘটনার সময় বিলের মধ্যে বানিয়াবাড়ি, বাঘরী, কাজরদী, সুখেরটেকসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ ছিল। কিন্তু যখন পুলিশ বিলে যায় তখন কেউই ছিল না', যোগ করেন জাকির।

এদিকে, নিহতদের মধ্যে জাকির হোসেনের নানাবাড়ি কাচপুর ইউনিয়নের সুখেরটেক গ্রামে। বড়বিল থেকে তার নানাবাড়ি দুই কিলোমিটার দূরে।

দুপুরে সুখেরটেক গ্রামে জাকিরের নানাবাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। নানা ও নানি মারা গেছেন কয়েক বছর আগে, ছোটমামার ঘরটিও ছিল তালাবদ্ধ।

প্রতিবেশীরা জানান, জাকির নানাবাড়িতেই বড় হয়েছিলেন। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পরে তিনি এই গ্রামে আর থাকতেন না। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে আড়াইহাজার উপজেলায় থাকতেন। জাকিরের বিরুদ্ধে আগেও ডাকাতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ শুনেছেন বলে জানান স্থানীয়রা।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রাথমিক তদন্তের বরাতে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ('খ' সার্কেল) শেখ বিল্লাল হোসেন জানান, জাকির সোনারগাঁয়ের ডাকাতদলের সর্দার। তার এক মামাও পুলিশের তালিকাভুক্ত ডাকাতদলের সদস্য। চিকিৎসাধীন মোহাম্মদ আলীর জবানবন্দি ও প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে জাকির হোসেনের নেতৃত্বে রোববার রাতে তারা কয়েকজন ডাকাতির উদ্দেশ্যে ওই বিলে জড়ো হয়েছিলেন।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এর আগে ২০২২ সালের ৩ মার্চ উপজেলার সাদীপুরের নানাখী গ্রামে ডাকাতি করতে গিয়ে দুই সঙ্গীসহ গণপিটুনির শিকার হন জাকির। গত বছর উপজেলার মহজমপুর গ্রামে এক পুলিশ পরিদর্শকের বাড়িতে ডাকাতি করার পর গ্রেপ্তার হন তিনি। ২০১৬ সালেও ওই বিলে ডাকাত সন্দেহে গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে এক ব্যক্তি নিহত হন।

বিল্লাল হোসেন বলেন, পিটুনিতে চারজনের মৃত্যু এবং একজন আহত হওয়ার ঘটনাটি তদন্ত করছে পুলিশ। এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুপুরে বাঘরদী গ্রামে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দলকে দেখা যায়। তারা এই ঘটনার ছায়াতদন্ত করছে বলে জানান সিআইডির নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের পুলিশ সুপার হুমায়ূন কবির।

তবে, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত গণপিটুনির ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

7h ago