ডিবি হেফাজতে থাকাকালীন ‘সরানো হয়’ ফ্রিল্যান্সারের কোটি টাকার বিটকয়েন

‘ডিবির একটি টিমের সদস্যের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তে একটি অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখানে কারও সংশ্লিষ্টতা থাকলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সিএমপির লোগো

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে কোটি টাকার বিট কয়েন (অনলাইন বা ভার্চুয়াল মুদ্রা) হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

এ অবস্থায় ভুক্তভোগী ফ্রিল্যান্সার ও সোর্সের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে পুলিশ ঘটনা ভিন্নখাতে নিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তবে পুলিশের করা এজাহার, নন-এফআইআর প্রসিকিউশন রিপোর্ট ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিবি পুলিশের হেফাজতে থাকা ফ্রিল্যান্সারের মোবাইল ফোন থেকেই তিন কোটি টাকা সমমূল্যের বিটকয়েন সরানো হয়েছে।

এ ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির কাজও শেষ পর্যায়ে। কমিটি ইতোমধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ এবং অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ শেষ করেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তারা সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়ের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

ভুক্তভোগী আবু বক্কর সিদ্দিক সরকারি নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার। বন্দরনগরীর অক্সিজেন এলাকায় তার বাসা। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে গুলবাগ আবাসিক এলাকা থেকে তাকে ও বন্ধু ফয়জুল আমিনকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি উত্তর দক্ষিণের পরিদর্শক মো. রুহুল আমিনের নেতৃত্বে একটি দল।

সেখান থেকে তাকে নগরীর গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে অনলাইনে জুয়া খেলার অভিযোগে আবু বক্কর ও ফয়জুলকে নন-এফআইআর প্রসিকিউশনের মাধ্যমে আদালতে হাজির করা হয়।

পরে ২৯ ফেব্রুয়ারি আবু বক্কর অভিযোগ করেন, তার মোবাইল ফোনে তার হাতের ছাপ নিয়ে অনলাইন অ্যাপসের মাধ্যমে ডিবি পুলিশের সদস্যরা কোটি টাকার বিট কয়েন সরিয়ে নিয়েছে অন্য কোনো অ্যাকাউন্টে।

অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা হলেন—ডিবির পরিদর্শক রুহুল আমিন, উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আলমগীর হোসেন ও মৃদুল কান্তি দে, এএসআই বাবুল মিয়া, শাহ পরান জান্নাত ও মো. মাইনুল হোসেন এবং কনস্টেবল মমিনুল হক ও কনস্টেবল আব্দুর রহমান।

তাদের সবাইকে ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে।

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তড়িঘড়ি করে ঘটনার পাঁচ দিন পর ২ মার্চ আবু বক্কর ও গোয়েন্দা পুলিশের দুই সোর্সসহ তিনজনকে আসামি করে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানায় ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের অভিযোগে মামলা করে ডিবি।

বায়েজিদ থানায় ডিবির এসআই মো. আলমগীর হোসেনের করা ওই মামলায় আবু বক্কর ছাড়াও পুলিশের সোর্স মো. কাউসার আহম্মদ (৩৫) ও শাহাদাত হোসেনকে (৩৫) আসামি করা হয়।

ফ্রিল্যান্সার আবু বক্করকে পলাতক দেখিয়ে এবং সোর্স কাউসারকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান করে ডিবি।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ফ্রিল্যান্সারের বিরুদ্ধে আদালতে পাঠানো নন-এফআইআর প্রসিকিউশনও দাখিল করেছিলেন এসআই আলমগীর। সেখানে তিনি বলেছেন, আবু বক্করের মোবাইল ফোন যাচাই করে অনলাইন জুয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

তখন ক্রিপ্টোকারেন্সির বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

তবে মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, আসামি কাউসার আহম্মদ জানিয়েছেন যে দুই নম্বর পলাতক আসামি আবু বক্কর সিদ্দিক (৩৮) তার পূর্বপরিচিত হওয়ায় তার অনলাইন জুয়া ও ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের বিষয়ে তিনি জানতেন।

এজাহারে আরও বলা হয়, ২৬ ফেব্রুয়ারি আসামি আবু বক্কর অনলাইন জুয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ায় আসামি কাউসার আহম্মদ ও শাহাদাত হোসেন আবু বক্করেরই নির্দেশনা অনুযায়ী একইদিন রাত ১১টা থেকে রাত ১১টা ৫৫ মিনিটের মধ্যে বিটকয়েন সরিয়ে নেয়, যার বাজার মূল্য প্রায় দুই লাখ ৪৮ হাজার ৬৮৯ মার্কিন ডলার।

অভিযোগে বলা হয়, এই বিটকয়েন প্রথমে শাহাদাতের অ্যাকাউন্টে যায় বলে আসামি কাউসার আহম্মদ স্বীকার করেছেন। পরে আসামি শাহাদাত বিটকয়েনকে মার্কিন ডলারে রূপান্তর করে কাউসারের অ্যাকাউন্টে দুই লাখ পাঁচ হাজার ৩৮০ ডলার মূল্যের ক্রিপ্টোকারেন্সি স্থানান্তর করে।

আসামি কাউসারের মোবাইল ফোনের বাইন্যান্স অ্যাপসে দেখা যায়, সেখানে তার অ্যাকাউন্টে সমপরিমাণ (দুই লাখ পাঁচ হাজার ৩৮০ ডলার) ব্যালেন্স আছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু প্রসিকিউশন প্রতিবেদনে এসআই আলমগীর বলেছেন, ওইদিন রাত সোয়া ৮টায় আবু বক্কর সিদ্দিকের মোবাইল জব্দ করে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে হেফাজতে নেয়।

নিয়ম অনুযায়ী, আবু বক্কর ও তার মোবাইল তখন থেকেই ডিবি পুলিশের হেফাজতে ছিল। সেই হিসেবে পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়েই আবু বক্করের মোবাইল ফোন থেকে টাকা সরানো হয়েছে।

মোবাইলে লেনদেনের নোটিফিকেশন অনুযায়ী রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১১টার মধ্যেই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, যখন আবু বক্কর ডিবি পুলিশের হেফাজতেই ছিলেন। এর স্ত্রিনশটও জমা দেওয়া হয়েছে তদন্ত কমিটির কাছে।

আবু বক্করের অভিযোগ, তাকে তুলে নেওয়ার পর পুলিশ তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে মোট দশ লাখ টাকা সরিয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ৩টা ৪১ মিনিটে একটি এবং ৩টা ৫০ মিনিটে আরেকটি লেনদেন করা হয় দুই অ্যাকাউন্টে।

তবে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত এবং সেই স্ক্রিনশট দ্য ডেইলি স্টার স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।

এ ছাড়া মামলার এজাহারে পুলিশ বলছে, আসামি কাউসার ও শাহাদাতের তথ্যের ভিত্তিতে আবু বক্করকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি এবং জিজ্ঞাসাবাদে কাউসার বিটকয়েন সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, পুলিশ হেফাজতে থাকার সময় পুলিশের সোর্সের মোবাইলে টাকা লেনদেন হলো কীভাবে।

মামলায় অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের কথা বললেও, আবু বক্করকে শুধু অনলাইনে জুয়া খেলার দায়ে আদালতে চালান করায় ডিবি পুলিশের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ডিবি পুলিশের একাধিক সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, ঘটনার পর টাকা ফেরত দিয়ে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করেন অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু, নিরাপত্তার খাতিরে আবু বক্কর তখন তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি।

এরপর পুলিশ মামলা করলে তিনি উচ্চ আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করেন।

আবু বক্করকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগে গত ৫ মার্চ আট পুলিশ সদস্যসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন আবু বক্করের স্ত্রী হুসনুম মামুরাত লুবাবা।

আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তভার দিয়েছেন।

ঘটনাটি নিয়ে বর্তমানে কেউ সরাসরি কথা বলছেন না।

তদন্ত কমিটির প্রধান কাউন্টার টেররিজম বিভাগের এডিসি আসিফ মহিউদ্দিনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি 'তদন্তের স্বার্থে' কিছু বলতে চাননি।

এ বিষয়ে জানতে ডিবি উত্তর-দক্ষিণের উপকমিশনার সাদিরা খাতুনকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

তবে সিএমপির জনসংযোগ বিভাগের এডিসি স্পিনা রানী প্রামানিকের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, 'মো. আবু বক্কর ছিদ্দিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বক্তব্য দিলেও, প্রাথমিক তদন্তে তার অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া গেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির (বিটকয়েন/ইউএসডিটি) লেনদেন বাংলাদেশে প্রচলিত আইনের পরিপন্থি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।'

'ডিবির একটি টিমের সদস্যের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখানে কারও সংশ্লিষ্টতা থাকলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে', বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago