যে বিরোধে চাচাতো ভাইদের হাতে খুন হলেন ২ সহোদর
'সামান্য জমিজমার ঝগড়া নিয়া আমার তাগড়া পোলা তিনডারে কোপাইয়া শ্যাষ কইরা দিল। আমার আসলাম, আমার রনি, ওরে আমার রফিকুল!'
মুহূর্তের মধ্যে হারিয়েছেন ২ ছেলেকে। আরেক ছেলে হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ছেলেদের শোকে এভাবেই কেঁদে চলেছেন জহুরা বেগম।
গত রোববার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার খাসপাড়ার পাঁচপাড়া এলাকায় জমির বিরোধে চাচাতো ভাইদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হন ব্যবসায়ী আসলাম সানি (৫০) ও তার ছোটভাই সফিকুল ইসলাম রনি (৩০)। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাদের আরেক ভাই রফিকুল ইসলাম (৪০)।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার পর থেকে নিহতদের চাচা মহিউদ্দিনের ছেলে অভিযুক্ত চাচাতো ভাই মো. মোস্তফা (৪০), মামুন হোসেন (৩৫), মফিজুল ইসলাম (২৫), মারুফ (১৮) পলাতক।
আজ সোমবার দুপুর ১টার দিকে নিহতদের বাড়িতে যান ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি নুরুল ইসলাম। তিনি নিহতদের স্বজনদের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতের আশ্বাস দেন।
কাঁচপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের খাসপাড়ার পাঁচপাড়া এলাকার ৩ তলা ভবনের নিচতলায় থাকতেন মৃত মো. সানাউল্লাহর স্ত্রী, ৩ ছেলে ও পরিবারের সদস্যরা। উপরের ২টি তলায় পোল্ট্রি ফার্ম। ফার্মটি চালাতেন রফিকুল ইসলাম ও তার ছোটভাই সফিকুল ইসলাম। আরেক ভাই আসলাম সানি এলাকায় বিয়ে অনুষ্ঠানের ডেকোরেটর সরঞ্জামের ব্যবসা করতেন। তাদের বাড়ি লাগোয়া পশ্চিম পাশের বাড়িটি চাচা মহিউদ্দিন ও চাচাতো ভাইদের।
স্থানীয়রা ও নিহতের স্বজনরা জানান, প্রয়াত ছমিরউদ্দিন বেপারীর ৩ ছেলের মধ্যে মেজো সানাউল্লাহ ও মহিউদ্দিনের মধ্যে জমি সংক্রান্ত বিরোধ দীর্ঘদিনের। বংশানুক্রমে এই দ্বন্দ্ব তাদের ছেলেদের মধ্যেও চলতে থাকে। জমি সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতে একাধিক দেওয়ানি মামলাও চলমান। স্থানীয়ভাবে একাধিকবার বিচার-সালিশও হয়েছে। এর আগেও একাধিকবার তাদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। ওই দ্বন্দ্বের জেরেই রোববার দুপুরে সরকারি ড্রেনের সঙ্গে একটি পাইপলাইন সংযুক্ত করাকে কেন্দ্র করে উভয়ের মধ্যে ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে চাচাতো ভাইরা প্রকাশ্যে রামদা, চাপাতি দিয়ে আসলাম ও তার ২ ভাইকে কোপান।
কাঁচপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হাছান খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২-৩ বছর আগেও আমরা ইউনিয়ন পরিষদে ২ পরিবারকে নিয়ে সালিশে বসেছিলাম। সালিশের পর তারা বাড়ির সীমানা প্রাচীর তৈরি করে। তারপর থেকে আমরা তেমন ঝগড়ার কথা শুনিনি। এরই মধ্যেই পুরনো এই ক্ষোভ এভাবে মাথাচাড়া দেবে, ২ জন মানুষকে খুন করবে তা আমরা ভাবতে পারিনি।'
নিহতদের বাড়িতে শোকের মাতম
সোমবার সকাল ১১টার দিকে নিহতের বাড়ির সামনে যেতেই কান্নার শব্দ কানে আসে। নিহতদের পরিবার ও স্বজনদের উপস্থিতিতে বাড়ির ভর্তি। একটি কক্ষে শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মুঠোফোনে নিজের ভাইকে স্বামী হারানোর কথা জানাচ্ছিলেন আসলামের স্ত্রী সোনিয়া।
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি গিয়া দেখলাম, মাইরা ফালাইয়া থুইছে। একটুও মায়া নাই, দয়া হয় নাই। উনি (আসলাম) মনে হয় বাইতে আমার কোলেই মইরা গেছে। হাসপাতালে নিয়া কাজ হয় নাই।'
হত্যার বিচার দাবি করে সোনিয়া বলেন, 'আমার পোলাপানগুলোরে এতিম কইরা গেল। কেউরে যেন আর এতিম আর স্বামীহারা না হইতে হয় সেই বিচার আমি সবার কাছে চাই।'
পাশের কক্ষে নিঃশব্দে কাঁদছিলেন নিহতদের মা জহুরা বেগম। স্বজনরা তাকে ঘিরে রেখেছেন।
ছেলেদের প্রসঙ্গ তুলতেই দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'পোলারা যার যার ব্যবসা নিয়া ছিল। হেরা তো আর জানত না তাগোরে মারার লাইগা জম রেডি হইয়া আছে। আমার তিনডা পোলা, তিনডারেই শ্যাষ কইরা দিল।'
স্বান্তনায় মানছেন না নিহত সফিকুল ইসলাম রনির স্ত্রী সানজিদা আক্তার। শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন তিনিও।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রফিকুল ইসলামের স্ত্রী সাদিয়া ইসলাম মিথিলাও শঙ্কিত তার স্বামীর অবস্থা নিয়ে। তিনি বলেন, 'আইসিইউতে আছেন উনি। বাঁচবেন কি না জানি না।'
সাদিয়া বলেন, 'জমিজমা নিয়ে আমার স্বামী ও তার ভাইদের সঙ্গে তাদের চাচাতো ভাইদের ঝামেলা ছিল। বছরখানেক আগেই সবকিছু মিটমাট হইয়া গেছিল। কিন্তু চাপা ক্ষোভ রেখে দিছিল তারা। সেই ক্ষোভ থেকেই আমার স্বামীসহ ভাসুর, দেবরকে নির্মমভাবে কোপাইছে।'
আজ বিকেলে নিহত ২ ভাইয়ের মরদেহ ময়নাতদন্তের পর নিজ বাড়িতে আনা হয়। সন্ধ্যার পর স্থানীয় একটি কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয় বলে স্বজনরা জানান।
চাচা-চাচাতো ভাইদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার নেই
২ ভাইকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তাদের বোন শামসুন্নাহার বাদী হয়ে চাচা ও চাচাতো ভাইসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন। আজ বিকেল ৪টার দিকে মামলাটি রেকর্ড করা হয় বলে সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব আলম জানান।
তবে হত্যার ঘটনার ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে বলে জানান ওসি।
এদিকে সোমবার দুপুর ১টার দিকে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) চাইলাউ মারমাসহ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হতাহতদের বাড়িতে যান। ডিআইজির নেতৃত্বে পুলিশের দলটি ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করে।
পরে ডিআইজি নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'ঘটনার পর থেকেই পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) দোষীদের গ্রেপ্তারে তৎপরতা চালাচ্ছে। অভিযুক্তদের আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। শিগগির তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। আমরা চেষ্টা করব দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলার চার্জশিট দেওয়ার মাধ্যমে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে।'
এদিকে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিহতদের স্বজন ও এলাকাবাসী রোববার রাতে অভিযুক্তদের বাড়িঘরে আগুন দেয়। এতে কেউ হতাহত না হলেও অভিযুক্তদের বসতবাড়িসহ কয়েকটি ঘর পুড়ে যায়। এ ঘটনার পর রাত থেকেই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
Comments