২০১৮ সালে মেয়র আইভীর ওপর হামলা

আসামির হাতে পিস্তল, পিবিআইয়ের অভিযোগপত্রে অব্যাহতি

মামলার ২ আসামি নিয়াজুল ইসলাম খান ও শাহ নিজামের হাতে পিস্তল। ছবি: সংগৃহীত

ঘটনার সময় ধারণ করা ভিডিও পর্যবেক্ষণে ২ আসামির হাতে পিস্তল দেখা যায়। একজনের নামে লাইসেন্স থাকলেও অপরজনের ছিল না। তদন্তে এমনটা পেলেও অভিযোগপত্রে ২ আসামিকেই অস্ত্র আইনের ধারা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেছে তদন্তকারী সংস্থা।

অভিযোগপত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, পিস্তল জাতীয় আগ্নেয়াস্ত্র ভিডিও ফুটেজে দেখা গেলেও আসামি জামিনে থাকায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে না পারায় অস্ত্রটি উদ্ধার করা যায়নি। অপরজনের অস্ত্রটি তার নামে লাইসেন্স করা। এ কারণে তাদের অস্ত্র আইনের ধারা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।

২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে হামলার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর করা মামলার অভিযোগপত্রে এমনটাই উল্লেখ করেছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক আতাউর রহমান।

গত ২৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ অভিযোগপত্র দাখিল হয় বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান।

অস্ত্র আইনের ধারা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ায় অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দেবেন বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী।

তিনি বলেন, 'ভিডিও ফুটেজে অস্ত্র দেখা গেছে। এসব ফুটেজ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে সারা পৃথিবীর মানুষ তা দেখেছে। আসামি পক্ষের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে তদন্তকারী সংস্থা এমন অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে।'

২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর ওপর এ হামলা হয়। ছবি: সংগৃহীত

২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে হামলা হয়। এতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনায় সিটি মেয়র নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি অভিযোগ দিলে তা সাধারণ ডায়েরি হিসেবে রেকর্ড করা হয়। ঘটনার ২২ মাস পর আদালতের নির্দেশে এটিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করে পুলিশ। মেয়র আইভীর পক্ষে মামলার বাদী হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তা জিএম সাত্তার। ওই মামলায় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের অনুসারী ৯ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৯০০-১০০০ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। দীর্ঘসময় তদন্ত শেষে গত ২৩ নভেম্বর মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

অস্ত্র আইনের ধারা থেকে অব্যাহতি দিলেও হত্যাচেষ্টা, জখম, ভাঙচুর ও নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগে পেনাল কোডের একাধিক ধারায় ১২ জনকে অভিযোগপত্রে আসামি করেছে পিবিআই। এ ছাড়া, এজাহারে থাকা আসামির তালিকা থেকে ৭ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, যুবলীগ নেতা নিয়াজুল ইসলাম খান, হকার নেতা রহিম মুন্সি, আসাদুল ইসলাম ওরফে আসাদ, সায়মন, ইকবাল হোসেন, মাসুদ পাটোয়ারী ওরফে শুক্কুর, তোফাজ্জল, পলাশ মিয়া, মহসীন বেপারী, সালাউদ্দিন ওরফে সালাউদ্দিন গাজী এবং সাদেকুল ইসলামকে। তাদের মধ্যে কেবল শাহ নিজাম ও নিয়াজুল ইসলাম খান এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন। বাকিরা এজাহার বহির্ভূত আসামি।

আসামিরা সবাই নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী বলে জানিয়েছে মামলার বাদীপক্ষ।

এজাহারভুক্ত আসামি মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল, যুবলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া সাজনু, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি জুয়েল হোসেন, যুবলীগ নেতা জানে আলম বিপ্লব, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, যুবলীগকর্মী নাসির উদ্দিন ওরফে টুন্ডা নাসির ও চঞ্চল মাহমুদকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেছে পিবিআই। তাদের মধ্যে মিজানুর রহমান সুজন গত বছরের ৯ জানুয়ারি মারা গেছেন।

মামলার বাদী জিএম সাত্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শহরের ফুটপাত হকারমুক্ত করার উদ্যোগের একপর্যায়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান হকারদের পক্ষে অবস্থান নেন। তবে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ফুটপাত দখলমুক্ত করে দিতে নির্ধারিত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সময় পেরিয়ে গেলেও হকাররা ফুটপাত না ছাড়লে মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে চাষাঢ়ার সায়াম প্লাজার সামনে এলে হামলার শিকার হন। এসময় এক নম্বর আসামি নিয়াজুল ইসলাম খান ও ২ নম্বর আসামি শাহ নিজামসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীরা গুলি করেন। মেয়র আইভীকে মানবঢাল তৈরি করে রক্ষা করা হয়।'

এ ঘটনায় মামলার বাদী ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ১৪৩, ১৪৪, ১৪৯, ৩২৩, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩৪ এবং ১৯৭৮ সালের ১৯ (ক) ধারায় অভিযোগ করেন।

অভিযোগপত্রে পিবিআই উল্লেখ করেছে, মামলাটি শুরুতে সদর মডেল থানা পুলিশ তদন্ত করে। পরে তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। মামলার তদন্তে নিয়াজুল ইসলাম খান ও শাহ নিজামের হাতে ঘটনার দিন পৃথক দুটি আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলে জানা যায়। ঘটনাস্থলে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করেও আসামিদের হাতে পিস্তল দেখা যায়। তবে তদন্তে জানা যায়, নিয়াজুল ইসলাম খানের পিস্তলের লাইসেন্স রয়েছে। ঘটনার দিন ওই পিস্তলটি গুলিসহ খোয়া যায় বলে তার ভাই রিপন থানায় একটি জিডিও করেছিলেন। পরবর্তীতে ৭ দশমিক ৬ বোরের পিস্তলটি ঘটনাস্থলের অদূরে একটি ফুলের টবের ভেতর পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় ১০ রাউন্ড গুলিসহ উদ্ধার করে পুলিশ।

পিস্তলটির প্রকৃত মালিক নিয়াজুল ইসলাম খান হওয়ায় অস্ত্র আইনের ১৯ (ক) ধারায় তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছে পিবিআই।

শাহ নিজামের হাতে থাকা পিস্তলের বিষয়ে পিবিআই অভিযোগপত্রে জানিয়েছে, শাহ নিজামের নামে একটি বন্দুকের লাইসেন্স থাকলেও পিস্তলের লাইসেন্স নেই। ভিডিও ফুটেজে আসামি শাহ নিজামকে বিনা লাইসেন্সে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও পিস্তল জাতীয় আগ্নেয়াস্ত্র নিজ দখলে রাখতে দেখা গেলেও আসামি জামিনে থাকায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ওই অস্ত্র সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করাও সম্ভব হয়নি। তদন্তকালে অস্ত্রটি উদ্ধারও সম্ভব হয়নি। এ কারণে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনের ১৯ (ক) ধারায় অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি।

একইসঙ্গে মেয়র আইভীকে হত্যার উদ্দেশে ওই ২ আসামি গুলি করেছেন বলে এজাহারে উল্লেখ থাকলেও তদন্তে এ সংক্রান্ত কোনো আলামত ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি এবং পরবর্তীতেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পিবিআই।

মামলার তদন্তে এজাহারভুক্ত ২ জনকে অভিযুক্ত করে বাকি ৭ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। অজ্ঞাত এক হাজার আসামির মধ্যে ১০ জনকে চিহ্নিত করা গেছে বলেও অভিযোগপত্রে জানায় পিবিআই।

পিবিআই বলছে, ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তার আত্মীয়-স্বজনসহ শান্তিপূর্ণভাবে শহর প্রদক্ষিণ করার সময় বঙ্গবন্ধু সড়কের সায়াম প্লাজার সামনের রাস্তায় পৌঁছালে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। একইসঙ্গে এক নম্বর ও ২ নম্বর আসামি যথাক্রমে নিয়াজুল ইসলাম খান ও শাহ নিজাম তাদের কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র মেয়র আইভীর দিকে তাক করে প্রাণনাশের হুমকি দেন। আসামিরা সেদিন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র হাতে বাদীপক্ষের ওপর হামলা চালিয়ে ৮৪ জনকে মারাত্মকভাবে জখম করে। তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ১৪৩, ১৪৪, ১৪৯, ৩২৩, ৩০৭, ৫০৬ (২) ও ৩৪ ধারায় অপরাধ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

মামলার বাদী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তা জিএম সাত্তার বলেন, 'অস্ত্রের বিষয়টি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। অথচ অস্ত্র আইনের ধারা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আমরা নারাজি দেবো। আগামী ২৯ জানুয়ারি এই মামলার শুনানির তারিখ আছে। সেদিন আদালতে আমরা নারাজির আবেদন জানিয়ে মামলাটি পুনরায় সুষ্ঠু তদন্তের আবেদন জানাব।'

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই নারায়ণগঞ্জের পরিদর্শক আতাউর রহমান বলেন, 'ঘটনার তদন্তে যতটুকু পাওয়া গেছে সেটাই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। আসামি নিয়াজুল ইসলাম খানের কাছে থাকা অস্ত্রটি তার নামে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ছিল। ঘটনার দিন ওই অস্ত্র দিয়ে কাউকে আঘাত করা হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, শাহ নিজামের অস্ত্রটি ভিডিওতে দেখা গেলেও সেটি উদ্ধার করা যায়নি বলে অস্ত্র আইনের ধারায় তাকেও সংযুক্ত করা যায়নি। তবে আসামিদের বিরুদ্ধে হুমকি, হত্যাচেষ্টা, জখম, নাশকতা ও ভাঙচুরসহ অরাজকতার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।'

পিবিআই নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অস্ত্র মামলার ধারায় বলা আছে, অস্ত্র উদ্ধার মানে প্রদর্শনীয় থাকতে হবে। আমরা মামলার দায়িত্ব অনেক পরে পেয়েছি। ততক্ষণে আসামিরা জামিনে। এখন কোনো আসামি জামিনে থাকলে তাকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা, তারপর অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব নয়। মামলার আরেক আসামি নিয়াজুল ইসলামের বৈধ অস্ত্র। তার বৈধ অস্ত্র যদি অবৈধভাবে ব্যবহার হয় তাহলে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। ইতোমধ্যে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। তার অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে বলে জেনেছি।'

এ বিষয়ে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেদিন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ওপর সশস্ত্র হামলা করে শামীম ওসমানের অনুগত বাহিনী। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে অস্ত্রসহ হামলার ছবি ছাপা হওয়ায় সারাদেশের মানুষ তা দেখেছে। এমন অভিযোগপত্র ওসমান পরিবারের প্রতি পুলিশ এখনো অনুগত বলেই প্রমাণ করে। তারা একটি পরিবারের হয়ে কাজ করে বলেই এমন প্রতিবেদন দিয়েছে।'

হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে এই সংঘাতের ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় আসামিদের কাউকে শনাক্ত করা যায়নি উল্লেখ করে আগেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। একই ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি একাধিকবার মেয়াদ বাড়ালেও আলোর মুখ দেখেনি সেই তদন্ত প্রতিবেদনের। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তারা পর্যায়ক্রমে জেলা থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে যাওয়ার পর এ নিয়ে আর কোনো আলোচনাও হয়নি। যদিও এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল।

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

3h ago