বিচারাধীন আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরানো ‘বেআইনি, শাস্তিযোগ্য অপরাধ’

স্টার বাংলা অনলাইন গ্রাফিক্স

মায়ের জানাজায় অংশ নিতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলী আজমকে গতকাল মঙ্গলবার ৩ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। এ সময় তাকে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়। ওই অবস্থায় তিনি মায়ের জানাজা নামাজ পড়ান।

এর আগে কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় গত ২৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলার অভিযোগে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলায় ২ ডিসেম্বর আলী আজমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আলী আজমকে যে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই মামলাটিও প্রশ্নবিদ্ধ। মামলার বাদী আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের অফিস সহকারী আবদুল মান্নান শেখ। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ঘটনা ও মামলার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

তিনি বলেন, 'কসম, আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। এখানে আলাউদ্দিন এসআই ছিল। ওই স্যার আমারে বারবার ফোন দিয়া অস্থির কইরা ফেলছে। আমি বলছি, স্যার, আমি দাওয়াতে আছি। আমি দাওয়াতে থাইক্যা মামলা করলাম কীভাবে? আমি ছিলামও না, দেখিও নাই। স্যারেগো আমি কইছিলাম, স্যার, আমারে আপনারা ঝামেলায় ফালাইয়েন না।'

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিচারাধীন মামলায় এমন একজন আসামিকে কোনোভাবেই ডান্ডাবেড়ি পরানো যায় না। এটি সম্পূর্ণ 'বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ'।

আলী আজমকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে মায়ের জানাজায় নেওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আলী আজম সাজাপ্রাপ্ত আসামি না। তাকে কোনোভাবেই ডান্ডাবেড়ি পরাতে পারে না। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। যারা পরিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের সাজা হওয়া উচিত। তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। এই ঘটনার পর কারা কর্তৃপক্ষ কিছুতেই পদে বহাল থাকতে পারেন না।'

ডান্ডাবেড়ি কখন পরানো যায় জানতে চাইলে এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, 'বলা হতো ফাঁসির আসামি, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানো হবে। পরবর্তীতে একটি মামলায় এই ডান্ডাবেড়ি পরানোর বিষয়টি নিষেধ করা হয়। বলা হয়, ডান্ডাবেড়ি পরানো যাবে না। কারণ এটি একটি নির্যাতন। এটি মধ্যযুগীয় অত্যাচার। কোনো সময়েই পরানো উচিত না।'

মানবাধিকার কর্মী মো. নূর খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যতটুকু জানি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্রে বা যাদের বড় ধরনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, তাদেরকে আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়। কিন্তু আমাদের সংবিধানের আলোকে কাউকে কষ্টের মধ্যে রাখা যাবে না। সংবিধান ও মানবাধিকারের আলোকে চিন্তা করলে, এ ধরনের ব্যবস্থা নিপীড়নমূলক এবং আইনে অচল।'

এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, 'যখন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের স্বাচ্ছন্দ্যে আনা হয়, এই বিধিনিষেধগুলো মানা হয় না, তখন এমন একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সংগঠককে, যাকে ৩ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়, এমন একজনকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আনতে হবে, এটি মানবিক ও প্রচলিত আইনে করার সুযোগ নেই। এটি আইনের ব্যত্যয় এবং যারা করেছেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত, জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। দুর্ভাগ্যজনক, বাংলাদেশে এই জবাবদিহিতার জায়গাটি প্রচণ্ড রকম দুর্বল হয়ে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যখন যিনি ক্ষমতায় থাকেন, তখন তিনি ইচ্ছে মতো এই বিষয়টি দেখেন। আলী আজমকে ডান্ডাবেড়ি পরানো চরম নিন্দনীয় এবং অপরাধমূলক কাজ হয়েছে বলে আমি মনে করি।'

'একজন বন্দির ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই না করে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তিনি নিরপরাধও হতে পারেন। তাছাড়া আলী আজমকে যে মামলায় ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়েছে, সেই মামলাটি নিয়ে সমালোচনা আছে। এমন একটি মামলায় এই ধরনের আচরণের মাধ্যমে একটি ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি করা হয়। মানুষ যাতে কোনোভাবে প্রতিবাদ করতে না পারে, সংগঠিত হতে না পারে, সেই চিন্তা থেকে এসব করা হয়। অতি উৎসাহী কেউ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। একজন মানুষ তার মায়ের জানাজায় শরীক হবেন, তার সঙ্গে এমন নিপীড়নমূলক আচরণ সমর্থন করার সুযোগ আইনেও নেই এবং মানবাধিকার কর্মী ও সাধারণ মানুষ এটিকে সমর্থন করবে বলে আমি মনে করি না,' তিনি যোগ করেন।

আলী আজমকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর কারণ জানতে চাইলে গাজীপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. বজলুর রশিদ আখন্দ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারাবিধি মোতাবেক নিরাপত্তার জন্য তাকে ডান্ডাবেড়ি দিয়েছি। সাধারণ বন্দি হিসেবে তাকে ডান্ডাবেড়ি দেইনি। তিনি একজন বিস্ফোরক মামলার আসামি। কে সাধারণ, কে অসাধারণ তা আমার কাছে লেখা নেই। আমার কাছে একটি কাস্টডি ওয়ারেন্ট আছে। তিনি বিস্ফোরক আইনে ৩, ৪, ৫ ধারায় বন্দি। মামলার ধারার ওপর আমরা ধরে নেই বন্দির চরিত্র কেমন। সাধারণ বন্দি হলেও পুলিশ যদি নিরাপত্তার জন্য ডান্ডাবেড়ি চায় আমরা দিতে বাধ্য। এটা জেল কোডে আছে।'

পুলিশ কি আলী আজমকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর কথা বলেছিল? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'হ্যাঁ, পুলিশ চেয়েছিল এবং আমি আমার নিজ দায়িত্বে তাকে ডান্ডাবেড়ি দিয়েছি।'

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

8h ago