কৃষি মার্কেটে আগুন

‘ছাই ছাড়া কিচ্ছু নাই’

আগুনে ভস্মীভূত দোকান। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

সকাল ১১টা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে ভোররাতে লাগা আগুন ততক্ষণে নিভে এসেছে। কিন্তু তখনো বাইরে অপেক্ষমান উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীদের অনেকের মধ্যে মার্কেটের ভেতরে ঢুকে জিনিসপত্র উদ্ধারের ব্যাপারে তেমন তৎপর হতে দেখা গেল না।

এর ভেতর মার্কেটের বাইরে উত্তর-পশ্চিম অংশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন এক ব্যবসায়ী। তাকে বলতে শোনা গেল, 'কিচ্ছু নাই। ছাই ছাড়া কিচ্ছু নাই।'

আগুন লাগার খবর শুনে সেই ভোররাতে ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে বাসা থেকে ছুটে এসেছিলেন তার স্ত্রীও। আগুন নেভার পর এক পর্যায়ে তিনি ধোঁয়াচ্ছন্ন মার্কেটের ভেতরে ঢুকতে উদ্যোগী হলে তার স্বামী তাকে থামিয়ে বলেন, 'যায়া কী করবা? ভিত্রে তো কিছুই পাইবা না।'

কাছাকাছি রাখা ছিল ভেতর থেকে উদ্ধার করে আনা আধপোড়া কিছু শাড়ি-কাপড়ের স্তূপ। সেই স্তূপের ওপর বিষন্ন হয়ে বসে থাকা আরেক ব্যবসায়ী বললেন, 'আগুনে ইট খইসা পড়ছেতে। বিম নাই হয়্যা গেছে। মাল কী থাকব?'

আগুন নেভার অনেক পর পর্যন্তও ধোঁয়াচ্ছন্ন ছিল পুরো এলাকা। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, এই মার্কেটে দোকানের সংখ্যা সাড়ে চারশর বেশি। মার্কেটে মুদি, স্টেশনারি, কনফেকশনারি, জুয়েলারি, প্লাস্টিকের সামগ্রী, চাল, মসলা, ক্রোকারিজ, কাপড় ও জুতার দোকান ছিল। প্লাস্টিকের দোকানে আগুন লাগায় তা দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে তারা কেউ ভেতরে ঢুকতে পারেননি। তাই ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় পর আগুন যতক্ষণে নিভেছে, ততক্ষণে ভেতরে উদ্ধার করে আনার মতো অবশিষ্ট কিছুই ছিল না।

তবে আগুনে মার্কেটের ৩ ভাগের ২ ভাগ পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে গেলেও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রক্ষা পেয়েছে পূর্বপ্রান্তের কাঁচাবাজার, মুরগির বাজার ও মাংসপট্টির দোকানগুলো।

কথা হয় মার্কেটের স্বর্ণ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। মার্কেটের কাছাকাছি তার বাসা। ভোরে চিৎকার চেচামেচি শুনে আরও অনেকের মতো তিনিও বের হয়ে আসেন। আগুন ততক্ষণে তীব্র আকার ধারণ করেছে। তাই ভেতরে ঢোকার মতো কোনো পরিস্থিতি তখন ছিল না।

নজরুল ইসলাম জানান, তার দোকানে ৫০ লাখ টাকার বেশি সোনা ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

কাপড় ব্যবসায়ী আজিজুল বিলাপ করে বলছিলেন, 'করোনার পর কোনোভাবে উইঠ্যা দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেছিলাম। গেল সপ্তাহেই দোকানে মাল তুলসি ১০ লাখ ট্যাকার। এইবার তো মাজাই (কোমর) ভাইঙ্গা গেল।'

বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার পর আগুনের সূত্রপাত হয় এই মার্কেটে। ভয়াবহ এ আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট যোগ দেয়। ফায়ার সার্ভিসকে সহায়তায় যোগ দেয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর বিশেষ দল। প্রায় ৫ ঘণ্টার চেষ্টায় আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

পরে পৌনে ১০টার দিকে কৃষি মার্কেটের সামনে তাৎক্ষণিক এক ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী মার্কেটটিকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করেন।

তিনি জানান, মার্কেটের একটি মুদিদোকান থেকে এই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট বা মশার কয়েল থেকে এই আগুন লাগতে পারে। এ ঘটনায় কেউ নিহত হয়নি, তবে আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মী সামান্য আহত হয়েছেন।

রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা আধপোড়া কাপড়। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

এদিকে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ২১৭টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। দুপুর ১২টার দিকে মার্কেটটি পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা।

তার ভাষ্য, এই মার্কেটে ডিএনসিসির বরাদ্দ দেওয়া দোকানের সংখ্যা ৩১৭টি। তবে মার্কেট-সংলগ্ন ফুটপাতে অনেক অবৈধ দোকান ছিল।

পরে ঢাকার জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করে সরকারের পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তার চেষ্টা করা হবে বলে জানান।

আর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মার্কেটে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। প্রাথমিক ফায়ার ফাইটিংয়েরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফুটপাত-সড়কে অবৈধ দোকান থাকাসহ উৎসুক মানুষের ভিড়ের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়েছে। আগুন নেভানোর পানি আনতে হয়েছে অন্য জায়গা থেকে।

Comments

The Daily Star  | English

Will protect investments of new entrepreneurs: Yunus

Yunus held a meeting with young entrepreneurs at the state guest house Jamuna where15 male and female entrepreneurs participated

5h ago