মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: একই ঘেরাটোপে বন্দি জনগণ

নির্বাচনে তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলেছে চীন ও ভারত। পর্যটনের লীলাভূমি এই দ্বীপরাষ্ট্রটির ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার নিয়ে সক্রিয় উভয় দেশই।
রয়টার্স ফাইল ছবি

গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ফল ঘোষণা থেকে দেখা গেছে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি কেউই। তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহ ও তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মোহাম্মদ মুইজুর ভেতর হয়েছে কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অনেককে অবাক করে দিয়ে প্রায় ৪৬ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন মুইজু। সোলিহ পেয়েছেন ৩৯ শতাংশ ভোট। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা (কমপক্ষে ৫০ ভাগ ভোট) কেউই না পাওয়ায় নির্বাচন গড়াচ্ছে দ্বিতীয় ধাপে। 

নির্বাচনে দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট ৮ জন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদে লড়ছেন। ভোটে প্রাপ্ত ফল থেকে দেখা যাচ্ছে, ১ লাখ ১ হাজার ৬৩৫ ভোট পেয়ে প্রথম স্থানে রয়েছেন পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেসের মোহাম্মদ মুইজু। শতকরা হিসেবে যা ৪৬.০৬ ভাগ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ পেয়েছেন ৮৬ হাজার ১ শত ৩১ ভোট। মালদ্বীভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সলিহ পেয়েছেন শতকরা ৩৯.০৫ ভাগ ভোট। ভোটে বাকি ছয় জন প্রার্থী রয়েছেন বেশ পিছিয়ে। দ্য ডেমোক্র‍্যাটস থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হুসাইন আমর পেয়েছেন ১৫ হাজার ৮ শত ৩৯ ভোট। শতকরা হিসেবে যা প্রদত্ত ভোটের ৭.১৮ ভাগ। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানো মাজ সালিম পেয়েছেন ৬ হাজার ৩ শত ৪৩ ভোট, যা প্রদত্ত ভোটের শতকরা ২.৮৭ ভাগ। এরপর রয়েছেন জমহুর পার্টির আমীন ইব্রাহিম। তিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৪ শত ৬০ তথা শতকরা ২.৪৭ ভাগ ভোট। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল সাত্তার ইউসুফ পেয়েছেন ২ হাজার ৯ শত ৭৯ ভোট, শতকরা হিসেবে যা ১.৩৫ শতাংশ। মালভিদস ন্যাশনাল পার্টি থেকে দাঁড়ানো আহমেদ আদিল নাসের পেয়েছেন ১ হাজার ৯ শত ০৭ ভোট, যা প্রদত্ত ভোটের ০.৮৬ ভাগ। স্বতন্ত্র প্রার্থী মারিয়াম আলীম পেয়েছেন ৩ শত ২৭ ভোট তথা ০.১৫ শতাংশ ভোট।

বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহ এবার দ্বিতীয়বারের মতো লড়ছেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। তার বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা আবদুল্লাহ ইয়ামিন। গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর দুর্নীতির অভিযোগে ১১ বছরের কারাদণ্ড হয় তার। এতে সংবিধানের ১০৯ (ফ) ধারা অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারান তিনি। এরপর এ বছরের আগস্টে উচ্চ আদালত নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত বহাল রাখলে ইয়ামিনের পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। 

ইয়ামিনের পরিবর্তে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন মুইজু। ইয়ামিন প্রথমে নির্বাচন বয়কটের কথা বললেও পরবর্তীতে প্রগ্রেসিভ পার্টি অব মালদ্বীপ (পিপিএম) ও পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস (পিএনসি) নিয়ে গঠিত বিরোধীদের জোটের হয়ে ইয়ামিনের পরিবর্তে নির্বাচনে অংশ নেন মুইজু।  মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে এই দুজনের ভেতরই। প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৮৫ ভাগ পেয়েছেন এই দুজন। বাকি ৬ জন প্রার্থী মিলে পেয়েছেন অবশিষ্ট ১৫ ভাগ ভোট। 

পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকে সলিহ ও মুইজুর অবস্থান বিপরীত দুই মেরুতে। ইব্রাহিম সলিহ চান দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে। গত ৫ বছরে তার গৃহীতে নীতিতে প্রাধান্য পেয়েছে ভারত। সলিহর ভারত অভিমুখী পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে মুইজুর পররাষ্ট্রনীতি চীন ঘেঁষা। 'ইন্ডিয়া আউট' নামে প্রচারণা চালাচ্ছে তার নেতৃত্বাধীন বিরোধীদের জোট। মালদ্বীপে নজরদারি করতে থাকা ভারতীয় বিমান ও ৭৫ জনের মতো ভারতীয় সৈন্যকে দেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলা হয়েছে বিরোধী জোটের তরফে। 

১৮৭ টি দ্বীপে ৫৭০টি পোলিং স্টেশনে সংগ্রহ করা হয়েছে ভোট। এর বাইরে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন ও আবু ধাবিতেও ছিলো ভোটকেন্দ্র। 

প্রথম দফার ভোটের সময় রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ফুয়াদ তৌফিক বলেন, 'আমরা ভেবেছিলাম শুরুতে ভোটারের সংখ্যা কম হবে। কিন্তু আমাদের একেবারে অবাক করে দিয়ে সকাল থেকেই বহু লোক ভোটকেন্দ্রে জড়ো হতে থাকেন। এ পর্যন্ত সবকিছু খুব ভালোভাবেই এগোচ্ছে, কোনো বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি।' 

এই নির্বাচনে তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলেছে চীন ও ভারত। পর্যটনের লীলাভূমি এই দ্বীপরাষ্ট্রটির ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার নিয়ে সক্রিয় উভয় দেশই।

২০১৩-১৮ সাল পর্যন্ত আবদুল্লাহ ইয়ামিন ছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদে। সে সময় তাদের 'প্রগ্রেসিভ পার্টি অব মালদ্বীপ' (পিপিএম) চীনের ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছিলো। বেইজিং এর 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পে যুক্ত করেছিলো নিজেদের। এর পাশাপাশি চীনা অর্থায়নে নিজেদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য কয়েকটি মিলিয়ন ডলার প্রোজেক্ট নিয়েছিল মালদ্বীপ।

তবে বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ঘটনা মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ২০১৮ এর নির্বাচনে জেতেন মালদিভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি)  ইব্রাহিম সলিহ। চীনের অর্থায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ থেকে বাঁক বদল করে মালদ্বীপকে ভারত অভিমুখী করতে শুরু করেন সলিহ। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য এবার ভারত থেকে আসতে থাকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। মালদ্বীপজুড়ে ইমারত, সেতু ও রাস্তাঘাট নির্মাণ শুরু হয় ভারতের অর্থায়নে। 

দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে থাকে এখানেও। ফলে পাঁচ বছর পর মালদ্বীপের জনগণের সমর্থনের পাল্লা আবারো ভারি হয়েছে বিরোধী জোটের দিকেই।

মুইজু ও সলিহর ভেতর 'রান-অফ' অনুষ্ঠিত হবার সম্ভাব্য সময় সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ। 

আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুইজু বলেছেন, 'আজ আমরা অনেক খুশি। জাতীয়তাবোধ নিয়ে ছুটে এসেছে মালদ্বীপের জনগণ। সরকারের চাপ ও অত্যাচার তাদের দমাতে পারেনি।' 

তিনি আরও বলেন, 'আমি খুব উৎসাহ পাচ্ছি। আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, অর্থনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। আগামী তিন সপ্তাহে আমরা সেদিকেই নজর দেব।' 

এদিকে আল জাজিরাকে সলিহ জানিয়েছেন দ্বিতীয় রাউন্ডের জন্য প্রস্তুত হবার কথা। তিনি তৃতীয় স্থানে থাকা প্রার্থীর সঙ্গে জোট করার ব্যাপারে ভাবছেন। 

'আমাদের জোট গঠন করতে হবে। আমার ধারণা, পিপিএমও সেই চেষ্টাই করবে। আমাদের তরফ থেকে (জেতার জন্য) যা যা করা সম্ভব, আমরা করব।'- আল জাজিরাকে এমনটাই জানিয়েছেন ইব্রাহিম সলিহ।

৭ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন ইলিয়াস লাবিব। এক সময় সলিহর এমডিপি থেকেই বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। লাবিব প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন 'দ্য ডেমোক্র‍্যাটস' পার্টির পক্ষে। দলটি গড়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ। 

মালদ্বীপের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও যুক্তরাজ্যের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমেদ শাহীদ এর মতে, 'নাশিদই মনে হয় আজকের দিনের সবচেয়ে বড় বিজেতা। তিনি এখন 'কিং মেকার' এর ভূমিকায়।'

শাহীদ মনে করেন, 'নাশিদ সলিহকে সমর্থন দিতে পারেন। সেজন্য সংবিধান ও সংসদের কিছু নীতিগত পরিবর্তন এবং সংসদ ও দল থেকে কিছু ব্যক্তিকে অপসারণ করতে হতে পারে সলিহকে। এ ছাড়া নাশিদ ভারত ঘেঁষা হওয়ায় এটিও তার সমর্থন দানের ক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে। তবে রান-অফে মূল নিয়ামক হবেন তারা, যারা এবার ভোট দেননি।' 

এবারে নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৭৫ শতাংশ। রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নির্বাচন কমিশন এ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও ২০০৮ পরবর্তী সময়ের সকল নির্বাচনের ভেতর এবার  ভোটারদের অংশগ্রহণ আনুপাতিকভাবে কম। পার্থে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রভাষক আজিম জহিরের মতে, 'এবারে ভোটার অংশগ্রহণ কমে যাবার ব্যাপারটি চোখে পড়ার মতো। এবারের নির্বাচনে ভোট পড়েছে শতকরা ৭৫ ভাগ, আগেরবার তা ছিল ৮৫ শতাংশ। এর কারণ হতে পারে প্রচলিত দলগুলোর ওপর থেকে তরুণদের মোহভঙ্গ ঘটছে।' 

একসময় যারা ইয়ামিনের পরিবর্তে সলিহকে ভোট  দিয়েছিলেন, তারা অনেকেই তার ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছেন। আগের সরকারের আমলে আল কায়েদার যোগসাজশে ঘটা হত্যাকাণ্ডগুলোর উপযুক্ত বিচার বিধান করতে পারেনি সলিহর নেতৃত্বাধীন সরকার। একই সঙ্গে তার পূর্বসূরির সময়ে ঘটা মালদ্বীপের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারেননি তিনি। এতে রাষ্ট্রীয় ভল্ট থেকেই চুরি হয়েছিল কয়েক মিলিয়ন ডলার। 

সাবেক সংসদ সদস্য ইব্রাহিম ইসমাইল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের এক পোস্টে লিখেছেন, 'ভোট কম পড়ার কারণ একটাই- মালদ্বীপের জনগণ ক্লান্ত, প্রতারিত ও আশাহত। ১৫ বছর ধরে তারা সাড়া দিয়ে গেছে, বিনিময়ে শুধু প্রতারিতই হয়েছে বারবার।'

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, রয়টার্স, এপিনিউজ 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh ranks 84th among 127 countries in Global Hunger Index

The level of hunger in Bangladesh this year has been categorised as "moderate"

1h ago