‘বিশ্বশক্তি’র পথে কতদূর ভারত
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ও চতুর্থ শীর্ষ সামরিক শক্তি ভারতের ইতিহাসে যোগ হতে যাচ্ছে নতুন তকমা। চীনে জনসংখ্যা কমতে থাকায় এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হতে যাচ্ছে এতদিন জনসংখ্যার বিচারে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারত।
সম্প্রতি চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর (এনবিএস) বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মনিং পোস্টসহ বিশ্ব গণমাধ্যম জানিয়েছে, গত ৬ দশকের মধ্যে ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো মহাচীনে জনসংখ্যা কমেছে। অর্থাৎ, দেশটিতে এখন জন্মহারের তুলনায় মৃত্যুহার বেশি।
এনবিএসের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে চীনের জনসংখ্যা ছিল ১৪১ কোটি ১৮ লাখ। এর আগের বছর তা ছিল ১৪১ কোটি ২৬ লাখ।
অন্যাদিকে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের বরাত দিয়ে গত ১৮ জানুয়ারি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, জনসংখ্যার দিকে থেকে ভারত হয়তো ইতোমধ্যে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে।
এখনো পর্যন্ত ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দেশটির জনসংখ্যার হালনাগাদ তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। তাই বেসরকারি জনজরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের বরাত দিয়ে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, ২০২২ সালের শেষে ভারতের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪১ কোটি ৭ লাখে।
জাতিসংঘের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মধ্যে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হবে।
ব্লুমবার্গের বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস আরও জানায়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্রোট্রেন্ডসের হিসাবে বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যা ১৪২ কোটি ৮ লাখ।
এতে আর বলা হয়, ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রতিবছর তুলনামূলকহারে কমলেও চীনের মতো এ দেশেও জন্মহারের তুলনায় মৃত্যুহার বাড়তে থাকবে ২০৫০ সালের পর থেকে।
জনসংখ্যা, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে 'বিশ্বশক্তি' হওয়ার স্বপ্ন দেখা ভারতের একদিকে যেমন আছে অপার সম্ভাবনা অন্যদিকে আছে অনেক চ্যালেঞ্জও। এখন দেশটির সরকারের সামগ্রিক ভূমিকার ওপর নির্ভর করবে বিশ্বমঞ্চে এর অবস্থান কতটা শক্তিশালী হবে।
'বিশ্বশক্তি' ভারত
আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত আন্তর্জাতিক মহলে বেশ সমাদৃত। জনসংখ্যার 'জোরে' এখন দেশটি 'বিশ্বশক্তি' হওয়ার বাসনা আরও জোরেশোরে প্রকাশ করতেই পারে।
ভারত দীর্ঘদিন থেকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে এই চেষ্টা এখন আরও জোরদার হতে পারে।
গত ২৫ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাট'র প্রতিবেদনে বলা হয়, 'হাজারো সমস্যা সত্ত্বেও ভারত এগিয়ে যাচ্ছে এর গতিশীলতা, চিন্তা, বৈচিত্র ও ক্রম পরিবর্তনশীলতা নিয়ে।'
অপর এক প্রতিবেদনে গণমাধ্যমটি জানায়, জি-২০র সভাপতি হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত ইতোমধ্যে বিশ্বমঞ্চে গুরুত্ব পেয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লি চীনের নেতৃত্বাধীন সাংহাই কোঅপারেশনের সভাপতি হয়েছিল। সেই মাসেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াডের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বৈঠকের আয়োজন করে।
সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন'র প্রতিবেদনে ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের চীনা জনসংখ্যাতত্ত্বের শিক্ষার্থী ই ফুক্সিয়ানের টুইট তুলে ধরা হয়েছে। ফুক্সিয়ান বলেন, চীনে জন্মহার কমতে থাকায় 'ভারত সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে'।
টুইটে তিনি আরও বলেন, 'এখন ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। একদিন দেশটির অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। তবে অনেকের আশঙ্কা ভারত তার জনগণের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না।'
ভারতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আলেক্সান্ডার ইলিসের বরাত দিয়ে গত ২৩ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যম এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই) জানিয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার বিষয়ে ভারতের ইচ্ছার প্রতি যুক্তরাজ্যের সমর্থন আছে।
এর আগে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো ভারতের এই ইচ্ছার প্রতি অপর স্থায়ী সদস্য ফ্রান্সের সমর্থনের কথা জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াও ভারতের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে।
এ ক্ষেত্রে এখন প্রয়োজন চীনের সমর্থন। দ্য ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদনে জানা যায়, এ ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা 'ইতিবাচক'ও না 'নেতিবাচক'ও না।
সম্ভাবনা
ভারত সবচেয়ে জনবহুল দেশ হলে বিশ্বে এর প্রভাব কী হবে—তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি শীর্ষ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
গত ২০ জানুয়ারি টাইম ম্যাগাজিনে 'ভারতের রেকর্ডসংখ্যক জনসংখ্যার বৈশ্বিক প্রভাব' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে ভারত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে নতুনরূপে আবির্ভূত হবে। একদিকে যেমন এই বাড়তি জনসংখ্যার বাড়তি চাহিদা মেটানো সরকারের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে, তা বিশাল সম্ভবনাও।
পপুলেশন ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার (পিএফআই) নির্বাহী পরিচালক পুনম মুখার্জি ম্যাগাজিনটিকে বলেছেন, 'জনগণকে সুখী-সুন্দর জীবন দিতে আমাদের সাফল্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে নতুনভাবে কর্মকৌশল সাজাতে হবে।'
প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতে এই জনসংখ্যার সবচেয়ে সুবিধাজনক দিক হলো—দেশটির এই বিশাল মানবসম্পদের প্রায় অর্ধেকের বয়স ২৫ বছরের নিচে। দেশটিতে তরুণদের সংখ্যা ২০৬৫ সাল পর্যন্ত বাড়তে থাকবে।
পুনম মুখার্জি মনে করেন, চীনের জনসংখ্যা হ্রাস থেকে ভারতকে শিক্ষা নিতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ভারত যেন চীনের মতো কোনো 'নীতি' বেঁধে না দেয়।
তার মতে, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হওয়ার 'তকমা' ভারতের উন্নয়ন ভাবনায় 'মৌলিক পরির্তন' আনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। কেননা, তরুণ প্রজন্ম একটি দেশের অর্থনীতি গড়ে তোলার সম্ভাবনাও নিয়ে আসে।
'দ্য পপুলেশন মিথ: ইসলাম, ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যান্ড পলিটিক্স ইন ইডিয়া' বইয়ের লেখক এসওয়াই কুরাইশি টাইম ম্যাগাজিনকে জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ধারণাগুলো এখন বদলাচ্ছে। ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে এই জনসংখ্যা 'সংকট' নয়, 'সম্পদ' হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বলেও মনে করেন তিনি।
কুরাইশি বলেন, 'সারা পৃথিবী থেকে ভারতীয় সিইওরা নিজ দেশে ৯০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স হিসেবে পাঠিয়েছেন।'
তিনি মনে করেন, ইউরোপ-আমেরিকায় দক্ষ জনশক্তি কমায় ভারতের তরুণরা 'বৈশ্বিক সম্পদ' হয়ে দাঁড়াতে পারেন। 'সবাই হয়তো ভারতকে অপছন্দ করেন কিন্তু, দিন শেষে দেখা যায় সবাই এর বাজারকে ভালোবাসছেন,' যোগ করেন কুরাইশি।
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ শ্রুতি রাজগোপালনন টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, 'ভারতের তরুণ প্রজন্ম হবে সবচেয়ে বড় ভোক্তা ও শ্রমের জোগানদাতা।'
চ্যালেঞ্জ
ভারতের বিশাল জনসংখ্যাকে 'সম্পদ' বা 'সম্ভাবনা'—যাই আখ্যা দেওয়া হোক না কেন, তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে 'সংকট' সৃষ্টি হতে পারে—তা বলাই বাহুল্য।
টাইম ম্যাগাজিনে আরও বলা হয়েছে, চাকরি নিয়ে লাখ লাখ ভারতীয়ের মনে 'ক্ষোভ' আছে। যদিও তাদের অনেকের সামনে অনেক সুযোগ। এমনকি, মা-বাবার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়েও অনেকে চলতে পারেন।
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির হিসাবে, ২০২২ সালে ভারতে বেকারত্বের হার আগের বছর থেকে বেড়ে হয়েছে ৭-৮ শতাংশ। ২০২১ সালে তা ছিল ৫-৬ শতাংশ।
২০২০ সালে ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতকে অ-কৃষিক্ষেত্রে নতুন করে অন্তত ৯ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারত সরকারকে 'সময়ের সঙ্গে তাল রেখে' তরুণদের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে তারা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারেন। দেশটির রাজনীতির কেন্দ্রে তরুণদের স্থান দিতে হবে। এ ছাড়াও, নারীদের সমতা নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সরকারকে কাজ করতে হবে।
ভারতের বাড়তি জনসংখ্যার প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয়, এই জনপ্রবৃদ্ধি দেশটির সম্পদের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে। এর প্রভাব বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়বে।
এতে আরও বলা হয়, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতে ইতোমধ্যে পানীয় জলের সংকট চরমে। ভবিয্যৎ প্রজন্মকে এই সংকট আরও প্রকটভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
ভৌগলিক বৈচিত্র্য ছাড়াও, সামগ্রিক উন্নয়নের বিবেচনায় ভারত উত্তর ও দক্ষিণ অংশে বিভক্ত। দেশটির জনবহুল উত্তরাঞ্চলের তুলনায় কম জনচাপে থাকা দক্ষিণাঞ্চল আর্থিকভাবে বেশি সমৃদ্ধ। ফলে পুরো দেশে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব।
ভারতের প্রায় ৬৭ শতাংশ মানুষ গ্রামে থাকলেও ৩৩ শতাংশ জনগোষ্ঠী নিয়ে দেশটির শহরগুলো 'জনগণের ভার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে'। ২ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে রাজধানী হিসেবে দিল্লি এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও সবচেয়ে জনবহুল নগরী।
সংবাদ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারতের শহরগুলো বৈশ্বিক বিবেচনায় এখন 'জনভারে ভারাক্রান্ত'। আগামী দিনগুলোয় সেই 'ভার' আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
এসব বিবেচনায় এখন প্রশ্ন, এত সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে 'বিশ্বশক্তি'র পথে ভারত প্রকৃতি অর্থে কত দূর এগিয়ে?
Comments