শতবর্ষে কাফকার দ্য ট্রায়াল : প্রসঙ্গ ন্যায় বিচার 

ছবি: সংগৃহীত

"কিন্তু আমি তো দোষী নই," কে বলল। "একটা ভুল হয়েছে। কারও পক্ষে দোষী হওয়া কী করে সম্ভব? আমরা সবাই এখানে মানুষ। একে অপরের মতো ।" পুরোহিত বললেন, "কিন্তু দোষীরা এভাবেই কথা বলে।"

ফ্রানৎস কাফকার দ্য ট্রায়াল (ডে প্রসেজ) সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর একটি বলে গণ্য হয়ে আসছে। কাফকার মৃত্যুর এক বছর পর ১৯২৫ সালের ২৬ এপ্রিল বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯১৪ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে লেখা হয়েছিল বইটি, যখন কাফকার বয়স ত্রিশের কোঠার প্রথম দিকে। তার অন্য দুটি উপন্যাস আমেরিকা যেটি 'দ্য ম্যান হু ডিসঅ্যাপিয়ার্ড' নামেও পরিচিত, আর দ্য ক্যাসেলের মতো এটিও ছিল অসমাপ্ত। কাফকা ছিলেন একজন নিখুঁত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন লেখক।তাঁর ডায়েরি থেকে জানা যায় শৈল্পিক অর্থমূল্য নিয়ে তিনি সংগ্রাম করে গেছেন সারাজীবন।

জীবদ্দশায় কাফকার খুব কম লেখাই প্রকাশ পেয়েছিল — দুটি ছোট গল্পের সংগ্রহ, গল্পের কিছু অংশ ও তাঁর ক্ষুদ্র উপন্যাস মেটামরফোসিস, যেগুলো প্রায় দৃষ্টির আড়ালেই থেকে গিয়েছিল। প্রকাশের এক শতাব্দী পরও এই উপন্যাস তেমনি বিভ্রান্তিকর, অস্বস্তি জাগানিয়া ও শ্বাসরুদ্ধকর —আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্ধকার বিবরে মানুষের অসহায়ত্বের প্রতীক।শত বছরে রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন ব্যবস্থা ও সমাজ কাঠামো পরিবর্তিত হলেও দ্য ট্রায়ালের মর্মবাণী আজও গুরুত্বপূর্ণ।

দ্য ট্রায়ালের প্রথম বাক্যটি ছিল একটা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার শোবার ঘরে অদ্ভুত দুজন লোকের দেখা পায় উপন্যাসের প্রোটাগোনিস্ট কে। কথা নেই বার্তা নেই, গ্রেফতারি পরোয়ানা নেই তাকে আটক করে বসে তারা। কী তার অপরাধ কের জানা নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে অজানা এই অপরাধের কারণে তাকে দণ্ড দেন এক বিচারক। দণ্ডপ্রাপ্ত জোসেফ কে পর্যন্ত ওই বিচারককে দেখেনি।

জোসেফ কের ভয়াবহ পরিণতি ঘটে একটি অজ্ঞাতনামা শহরে। সম্ভবত প্রাগে অবস্থিত তার বাড়িতে। পরিবেশটিও চেনা লাগে। অস্ট্রো- হাঙ্গেরিও সাজসজ্জায় সমৃদ্ধ একেবারে খোলামেলা ও উন্মুক্ত। ধূলিধূসরিত পুরনো বাড়ি, দীর্ঘ অলিগলি, গোপন দপ্তর, ধোঁয়াটে অফিস কক্ষ, সব মিলিয়ে এক অস্থির দমনমূলক ও ভয়াবহ এক আবহ সৃষ্টি করে। সময়টিও নির্দিষ্ট করে বলা নেই। ওই শহরটি যেন একটি আদালত যেখানে দরজা শুনানি- কক্ষ, প্রতিটি সিঁড়ি যেন এক নতুন বিন্যাসের বিচার ব্যবস্থার দিকে ধাবিত। কক্ষগুলোতে হতভাগ্য কের চারপাশে বিভিন্ন ধরনের চরিত্র ঘুরে বেড়ায়। প্রত্যেকেই তার ভাগ্যের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে— তার বাড়িওয়ালা, ব্যাংকের সহকর্মী, চাচা আর অভিভাবক। সেখানে থাকে ছোট কর্মকর্তা, তার আইনজীবী, চিত্রশিল্পী আর পুরোহিত।

উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে দুজন অচেনা মানুষ শহরের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাকে গলা কেটে হত্যা করে। মৃত্যুর আগে কের করুণ আর্তি : এভাবেই কি একজন নির্দোষ মানুষের মৃত্যু ঘটে? কিন্তু তার এই প্রশ্ন বাতাসে মিলিয়ে যায়, কোনো উত্তর আসে না। বুঝতে কষ্ট হয়না এই মৃত্যু ছিল পূর্ব নির্ধারিত — রাষ্ট্র-প্রদত্ত একটি আদেশ। কাফকার মৃত্যুর পর ট্রায়ালই প্রথম প্রকাশিত কোনো লেখা। এ কথা সবারই জানা ১৯২৪ সালের সালের ৩ জুন যক্ষ্মায়  মারা যান কাফকা। মৃত্যুর আগে তাঁর যাবতীয় পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলার জন্য বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে অনুরোধ করে গিয়েছিলেন তিনি। ব্রড তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করেছিলেন বলেই তাঁর বিপুল সাহিত্যকর্ম ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল, আর পৃথিবী লাভ করেছিল উঁচু মানের সব লেখাজোকা যার সংখ্যা চল্লিশের মতো । জীবদ্দশায় নিজেও কিছু লেখা ও নোটবুক ধ্বংস করে গেছেন কাফকা যার সঠিক সংখ্যা এখনও জানা যায়নি।

কাফকা সম্পর্কে যে বিষয়গুলো জানা যায় তা হচ্ছে : জীবদ্দশায় তিনি অপরিচিত থেকে গিয়েছিলেন , কারণ প্রকাশের ব্যাপারে তাঁর কুণ্ঠা ও লজ্জাবোধ ছিল; পিতার ভয়ে সদা তটস্থ থাকতেন; আমলাতান্ত্রিক এক চাকরির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন যা তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে শেষ পর্যন্ত ; নারীদের ব্যাপারে তার ব্যর্থতার বিষয়ে খুব বেশি সৎ ছিলেন; প্রাগের জার্মান ইহুদী হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁকে ; তাঁর রচনাগুলো ইহুদি অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা ; আশ্চর্যজনকভাবে অশউৎজ বন্দি শিবিরের পূর্বাভাস দিয়েছেন ; তাঁর লেখা নাৎসিরা পুড়িয়ে দিয়েছিল।

এই তথ্যগুলোকে কাফকা মিথ বলে সমালোচকেরা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, এসব একেবারেই বাজে কথা। তবে তাঁরা স্বীকার করেছেন কাফকার জীবন সম্পর্কে যত কম জানা যাবে তাঁর অবিস্মরণীয় লেখাগুলো উপভোগ করা ততো সহজ হবে। দ্য ট্রায়ালে বর্ণিত জোসেফ কের বিচারের কাহিনি নিছক গল্প নয়, আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের নাজুক অবস্থারই প্রতীক। কাফকা কোনো বিশেষ রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক শাসনের সমালোচনায় মুখর ছিলেন না।তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে অদৃশ্য, অস্পষ্ট আর নির্বিকার কাঠামো মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করে আর ব্যক্তির ন্যায়বোধ গ্রাস করে নেয়।

আজ 'কাফকায়েস্ক' শব্দটি ইংরেজি ভাষায় একটি পরিচিত অভিধা যার মানে অর্থহীন বিভ্রান্তিকর ভীতিকর ও বিপজ্জনক জটিলতা: যেমন কাফকায়েস্ক আমলাতন্ত্র, পরাপরাবাস্তব বিকৃতিতে ভরা, আর প্রায়শই আগাম বিপদ ও নৈরাজ্যের বোধ- জাগানো অনুভূতি, যেমন কাফকায়েস্ক বিচার ব্যবস্থা —দুঃস্বপ্নের মতো জটিল, উদ্ভট, বিচিত্র অথবা অযৌক্তিক কিছু, যেমন— রাষ্ট্র ক্ষমতার কাফকায়েস্ক অলিগলি, কাফকার লেখা অত্যাচার, নিপীড়ন ও বৈষম্যের এবং দু:স্বপ্নের লক্ষণ আক্রান্ত কাল্পনিক জগত। শব্দগুলোর ভেতর দিয়েই দ্য ট্রায়াল উপন্যাসের মর্মবাণী পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ব্যক্তি মানুষ কত সহজে এক নির্মম ব্যবস্থার শিকারে পরিণত হতে পারে। মানবতার চূড়ান্ত সংকট শুধু অস্তিত্বগত নয়, ন্যায় ও সত্যের প্রবল অনুপস্থিতিও বটে।

পৃথিবীর অনেক সাহিত্যিক দ্য ট্রায়াল সম্পর্কে তাঁদের মন্তব্য ও বিশ্লেষণ দিয়েছেন। আলবেয়ার কামু এই বইটিকে অ্যাবসার্ড সাহিত্যের অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, এ বইয়ে কাফকা মানুষের অস্তিত্বের সংকটকে নিখুঁত ভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর বিশ্ব অ্যাবসার্ড হলেও মেটাফিজিক্যাল। অজ্ঞাত এক অপরাধবোধের কারণে ব্যক্তি মানুষ কী করে নিগৃহীত হয়েছেন তাই-ই কাফকা দেখিয়েছেন দ্য ট্রায়াল উপন্যাসে। বিষয়টি অস্তিত্বের রহস্যেরই প্রতীক।

দ্য ট্রায়াল মূলত এক অস্তিত্ববাদী রূপক। এখানে বিচার বলতে বোঝানো হয় মানুষের নিজের অস্তিত্বের প্রশ্ন, আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব ও আধুনিক সমাজের নিষ্ঠুর যান্ত্রিকতা। এ উপন্যাস মানবিক সংকটের এক দলিল।

আর জাঁ পল সাত্র দ্য ট্রায়ালকে মানুষের স্বাধীনতার বিপরীতে অদৃশ্য শাসনের এক মূর্ত প্রতীক হিসেবে প্রত্যক্ষ করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, বইটি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষ কী করে নিজের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও স্বাধীনতা হারায় কাফকা তা প্রকাশ করেন রূপকালংকার বা মেটাফোরের মাধ্যমে। আর মিলান কুণ্ডেরা বলেছেন, দ্য ট্রায়াল আসলে অপরাধ নিয়ে রচিত কোনো উপন্যাস নয়, বরং এমন এক বিশ্ব নিয়ে লেখা যেখানে অপরাধ সম্পর্কে অনুমান করা গেলেও তার ব্যাখ্যা অনুপস্থিত। কাফকার মনন সেখানেই নিহিত। 

এই লেখকদের মন্তব্য থেকে অনুধাবন করা যায়, দ্য ট্রায়াল আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতা, রাষ্ট্র-যন্ত্রের জটিলতা , দার্শনিক দ্বন্দ্ব ও অস্তিত্বের প্রশ্নে এক অনন্য কণ্ঠস্বর। দ্য ট্রায়াল প্রকাশের ১শ বছর পরেও কাফকা আমাদের জাগিয়ে রেখেছেন। যখনই ক্ষমতা ভুল পথে ব্যবহৃত হয়, অশুভ শক্তির সেবা করে, ন্যায় বিচারের নামে এক বিকৃত ইচ্ছা অনুসারে আইন প্রণয়ন করে তখনই আমরা কাফকার জগতে থাকি।

কাফকার বিশ্বদৃষ্টি তাঁর সমস্ত কৌতুক সত্ত্বেও নিরানন্দ এবং অন্ধকারে ঢাকা। কিন্তু এটি অনন্য এক আলোও ছড়িয়ে দেয়। এ হচ্ছে মানব প্রকৃতির আলোকমালা যা খুবই প্রয়োজনীয়, যা এমন এক দিকের উন্মোচন ঘটায়, একবার দেখা গেলে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে না। এর উপস্থিতি ছাড়া আমরা কেবল ঘুমের জগতেই চলে যেতাম না, গভীর অন্ধত্ব গ্রাস করে নিত আমাদের।

দ্য ট্রায়াল মূলত এক অস্তিত্ববাদী রূপক। এখানে বিচার বলতে বোঝানো হয় মানুষের নিজের অস্তিত্বের প্রশ্ন, আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব ও আধুনিক সমাজের নিষ্ঠুর যান্ত্রিকতা। এ উপন্যাস মানবিক সংকটের এক দলিল।

দ্য ট্রায়ালকে অনেক সমালোচকই রাজনৈতিক উপন্যাস বলে গণ্য করেন যা কর্তৃত্ববাদী ও দমনমূলক শাসনব্যবস্থার স্বরূপ উদঘাটন করে। বর্তমান বিশ্বে সরকার ও রাষ্ট্র কর্তৃক যে দমন পীড়ন চালানো হয় তারই একনিষ্ঠ রূপায়ণ দ্য ট্রায়াল, শতবর্ষ আগে যা কাফকা তাঁর তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। দ্য ট্রায়াল আজকের সমাজেরই এক প্রতিচ্ছবি। কাফকার দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা উঠে এসেছিল তা বাস্তব, ফলে সাহিত্য হিসেবে এ উপন্যাস শুধু গুরুত্ববাহী নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকেও প্রাসঙ্গিক।

Comments

The Daily Star  | English

Reforms, justice must come before election: Nahid

He also said, "This generation promises a new democratic constitution for Bangladesh."

4h ago