নগরীর দেয়ালগুলো অভিব্যক্তির শিলালিপি

নগরীর দেয়ালগুলো আজ অভিব্যক্তির শিলালিপি

স্বাভাবিক অবস্থায় পর্যাপ্ত সময় নিয়ে যে তরুণী চোখে কাজল টানে, বিদ্রোহের দিনগুলোতে হাতের কাছে কিছু না পেলে সেই কাজল দিয়ে সে নগরের দেয়ালে মধ্যমা উত্থিত একটি মুষ্টিবদগ্ধ হাত এঁকে দিতে পারে। গ্রাফিতি বা দেয়াল চিত্র রাস্তার শিল্প, এলিট শ্রেণীর গ্যালারী কেন্দ্রীক শিল্প প্রদর্শনীর আদিখ্যাতা নয়। শিল্পকলার যত জনরা আছে তার মধ্যে সম্ভবত গ্রাফিতিই সর্বাধিক গণসম্পৃক্ত শিল্পধারা।

এই শিল্প এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে গণঅবাধ্যতার স্বতস্ফূর্ত অভিব্যক্তি। সমাজের প্রচলিত নোরমগুলোকে তা চ্যালেঞ্জ করে। ফলশ্রুতিতে কাউন্টার কালচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভদ্রসমাজের কাছে যা অপাঠ্য সেসব গালাগাল বা নোংরা কথায় দেয়ালগুলো ভরে উঠতে পারে। স্ট্রিট আর্ট মানেই গালাগাল নয় তবে আন্দোলনরত জনতা তার মাঠের অভিজ্ঞতা থেকেই নির্ধারণ করে নেয় তার অবাধ্যতার বর্হিপ্রকাশ কোন ভাষায় হবে। যে ভদ্রোচিত জীবনধারা জুলুমকে আনচ্যালেঞ্জন্ড রাখে গ্রাফিতির নোংরা ভাষা ও চিত্র তার বিপরীতে জনগণের প্রতিরোধের সংগ্রামকে যথার্থ অভিব্যক্তি দেয়।

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সংগঠিত গণআন্দোলনগুলোতে বিক্ষোভের অন্যতম অভিব্যক্তি হিসেবে গ্রাফিতি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ছাত্রজনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের দেয়াল, সড়কসহ বিভিন্ন স্থাপনায় অঙ্কতি গ্রাফিতির ক্ষোভের ভাষা অদৃষ্টপূর্ব।

বিগত ১৫ বছর যাবত এদেশের জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে যে নিষ্ঠুর নিপীড়নের মাধ্যমে অবদমিত করা হয়েছে গণআন্দোলনের সম্মিলিত সাহস তা প্রকাশ করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। জনপদে জনপদে দেয়ালগুলো মানুষের সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ অভিব্যক্তির শিলালিপি হয়ে উঠে। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন দেয়ালে প্রতিবাদের গ্রাফিতি অংকিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কেবল দেয়ালের কান থাকে, গ্রাফিতি অংকিত হলে দেয়ালের মুখও তৈরি হয়। সেই মুখ চিৎকার করে প্রকাশ করতে থাকে গণমানুষের বুকে চেপে থাকা ক্ষোভের কথা। সেই ভাষা আপনাদের কারো কারো কাছে শ্রুতিকটু, নোংরা লাগতে পারে।

''এক দেশের গালি আরেক দেশের বুলি'', এই সরল লোক প্রবাদটি হৃদঙ্গম করতে না পারলে আপনি গ্রাফিতির 'কুরুচিপূর্ণ'(?) বয়ানের নন্দন বুঝতে পারবেন না। এবং আপনি স্থান, কাল, পাত্রের সাপেক্ষ বিবেচনা করতে অপারগ হলে দয়া করে আপনার প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক নন্দনবোধ দিয়ে তা বিচার করতেও যাবেন না। যে ছাত্র-জনতা নির্বিচার গুলির সামনে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দেয়ালে তার ক্ষোভ লিখে দিচ্ছে, এটা মাথায় রেখেই যে হতে পারে এটাই তার জীবনের শেষ টেস্টিমোনি, সেই ক্ষোভের ভাষা যে সত্য ও সাহস ধারণ করে তা আপনি ঠিক এই মুহূর্তটা পার হয়ে গেলে কখনোই পাবেন না।

জুলাই অভ্যুত্থানের যে গ্রাফিতিগুলো নিয়ে সুশীলদের আপত্তি সেগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর তাৎক্ষণিক অভিব্যক্তি। সময় নিয়ে পরিকল্পনা করে, লে-আউট করে কিংবা প্রচলিত শিল্পমান বিচার করে এগুলো আঁকা বা লেখা হয়নি। এই গ্রাফিতিগুলো প্রচলিত শিল্পমানের বিপরীতে নতুন শিল্পমান তৈরি করে।

রেজিস্ট্যান্সের দেয়ালগুলো রুফটপ রেস্টুরেন্টের গ্লাস ডেকোরেশন নয়, সেখানে আপনি কোন রোমান্টিক নন্দন খুঁজে পাবেন না। অসৌজন্যতার দোহায় দিয়ে যারা এই গ্রাফিতিগুলো মুছে দিয়েছেন তারা কি অপরিমেয় ক্ষতি করেছেন হয় তা আপনারা বুঝতে পারছেন না, নতোবা ইচ্ছা করেই ইতিহাসের সাক্ষ্য আড়াল করে ফেলার চেষ্টা করছেন। আরেকটা গণঅভ্যুত্থান আসার আগ পর্যন্ত আপনারা কখনোই আর এরকম দেয়াল দেখতে পাবেন না।

জুলাই অভ্যুত্থানের যে গ্রাফিতিগুলো নিয়ে সুশীলদের আপত্তি সেগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর তাৎক্ষণিক অভিব্যক্তি। সময় নিয়ে পরিকল্পনা করে, লে-আউট করে কিংবা প্রচলিত শিল্পমান বিচার করে এগুলো আঁকা বা লেখা হয়নি। এই গ্রাফিতিগুলো প্রচলিত শিল্পমানের বিপরীতে নতুন শিল্পমান তৈরি করে।

জুতার মাপে যেমন কেউ পা বানায় না ঠিক তেমনি সুশীল নন্দনবোধের মাপেও প্রতিবাদী জনতা গ্রাফিতি আঁকে না। বরং যারা এ বিষয়ে সন্দিহান তারা অনুধাবনের চেষ্টা করুন। নতুন দিনের নতুন শিল্পভাষা বুঝার চেষ্টা করুন। আপনার নির্ভার জীবনের কোম্পানি স্পন্সরড আদিখ্যাতার ললিতকলা দিয়ে জনগণের স্বতফূর্ত প্রতিবাদের ভাষাগুলো মুছতে যাবেন না। এদেশের জনগণ আপনাদের এসব ছলাকলা মনে রাখবে না বরং চিরকাল মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে ''ছেকা ছিনা গুতিতে আগুন লাগাও এক শাতে''।    

সহকারী অধ্যাপক, ভাস্কর্য বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

At least 30 hurt as clashes engulf part of Old Dhaka

Suhrawardy college, hospital vandalised as protests over student’s death turn violent

2h ago