কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্যরোধ– যাত্রা চলমান থাকুক 

ছবি: সংগৃহীত

পাহারা দিয়ে মন্দির, বাড়িঘর, মিউজিয়াম, ঐতিহ্য রক্ষা করার চেষ্টা, চেষ্টা হয়তো খুবই মহৎ কিন্তু কার্যকারিত্বের বিচারে এগুলো খুবই দুর্বল। টেকসই নয়। এতে আক্রমণকারীদেরকে হয়তো সাময়িক ভাবে প্রতিহত করা যায়, কিন্তু আক্রান্তের মনে চিরস্থায়ী স্বস্তি আনা যায় না। তার জন্য দরকার গরিষ্ঠের বৈচিত্রদরদী মন। কিন্তু কিভাবে তৈরী হবে এই মন? কোথায় পাবো সেই মন যে মনে বিরোধী দর্শন আর মানুষের জন্যেও মর্যাদার জায়গা থাকে?

কোথায় পাবো তা বলার আগে বলা দরকার যে, মানুষ মন নিয়ে জন্মায় না। মানুষের মন তৈরী হয়। একটা মানবশিশু বড় হতে থাকে আর পরিবার, শিক্ষালয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান আয়োজনের ভিতর দিয়ে একটু একটু করে তাঁর মন তৈরী হতে থাকে। অনেকটা চারাগাছের মহীরুহ হয়ে ওঠার মতো।

অতএব, সে যদি বৈষম্যমূলক আচরণ দেখে-শুনে-শিখে বড় হতে থাকে, তাহলে তাঁর মনও বৈষম্যে বিশ্বস্ত ও অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটেই সিমন দ্য বোভোয়া বলেছেন, "কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, নারী হয়ে ওঠে।" অর্থাৎ মানুষ হয়ে জন্মেও, সমান সম্ভাবনা আর শক্তি থাকা সত্ত্বেও, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারনে দুটি মানবশিশুর একজন ক্রমে 'কোমল নারী' আরেকজন 'প্রবল পুরুষ' হয়ে ওঠে। ফলে একজন বায়োলজিকাল নারীও পুরুষতান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত ও বিশ্বস্ত হয়ে সাইকোলজিকাল পুরুষ হয়ে ওঠে। জলজ্যান্ত উদাহরণ তো আমাদের প্রাক্তন দুইজন নারী প্রধানমন্ত্রীই। এঁদের মত 'পুরুষ' আর কে ছিলেন এই বাংলাদেশে?

এই যে অনুকূল পরিবেশ পেলেই কিছু লোকের মুখগহ্বর থেকে রিরংসা আর প্রতিহিংসার লকলকে জিহবাটা তরবারির মতো বেরিয়ে পড়ে, এসব দেখে হতাশা বাড়ে ফলে আমরা তাদেরকে অবজ্ঞা করি। ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ব্লক করি, সান্নিধ্য এড়িয়ে চলি, কেউ কেউ ঘৃণাও করি। কিন্তু তাঁরা তো থেকেই যান, এই দেশে, এই সমাজে। আমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সমমনা অন্যদের সাথে মিশে যান। তাই কেবল ব্যক্তিকে পরিহার করা নয় বরং ব্যক্তির মনকে এমন বিধ্বংসী করে তোলার কারনগুলোকে কিভাবে পরিহার করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে।

নাগরিককে নির্বোধ রাখাটা একটা সৎ রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। একটা আধুনিক রাষ্ট্র চায় ধীরে ধীরে তার নাগরিকরাও যেন আধুনিক যোগ্য বিজ্ঞানমনষ্ক ও বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে যাতে প্রতিটি ব্যক্তি একেকটি মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে। এ জন্যে রাষ্ট্র সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে।

পটভূমি কিভাবে ব্যক্তিকে বিভক্ত করে তার একটা উদাহরণ দিই। ব্যতিক্রম আছে, তবু সাধারণ ধারনা থেকে উদাহরণ। ধরা যাক ক্যাডেট কলেজ, ইংলিশ মিডিয়াম, বেসরকারী স্কুল, সরকারী স্কুল, মাদ্রাসা, এলেভেল ওলেভেল পড়া, উচ্চবিত্ত বা দরিদ্র পরিবার থেকে, গুলশান, সুন্দরবন, চরাঞ্চল বা পাহাড় থেকে আসা, একই বয়সী দশজন ভিন্ন মানুষ আপনার সামনে বসা। আপনি প্রশ্ন করলেন, "বেগম রোকেয়ার ছবিতে কি মাগী লেখা উচিৎ?" কী জবাব পাবেন? কেউ হয়ত বলবেন, 'অবশ্যই সঠিক', কেউ বলবেন, 'খুবই বেঠিক' আবার কেউ হয়ত বলবেন, "বেগম রোকেয়া কে?"

নাগরিককে নির্বোধ রাখাটা একটা সৎ রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। একটা আধুনিক রাষ্ট্র চায় ধীরে ধীরে তার নাগরিকরাও যেন আধুনিক যোগ্য বিজ্ঞানমনষ্ক ও বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে যাতে প্রতিটি ব্যক্তি একেকটি মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে। এ জন্যে রাষ্ট্র সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে।

সর্বজনীন শিক্ষা চালু করে যেন দুজন নাগরিক মানসিক গঠনের দুই মেরুতে পরস্পর মারমুখী হয়ে বেড়ে না ওঠে। এক বা একাধিক ব্যক্তির ইচ্ছা বা অনিচ্ছার শাসনের বিপরীতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে যেন নাগরিকদের মধ্যে বিচার পাওয়া বা না পাওয়া নিয়ে সন্দেহ তৈরী না হয়। রাষ্ট্রের সম্পদ এমন ভাবে ব্যবহার করে যেন দেশের কোন অংশের মানুষ নিজেকে বৈষম্যের শিকার ভাবতে না পারে। রাষ্ট্র সকলের মানবাধিকার রক্ষা করে যাতে প্রতিটি ব্যক্তি বিকশিত হতে পারে ফলে সমাজে চিন্তার সমতা তৈরী হয়।

সুতরাং আপনি যখন আশপাশে কোন 'নির্বোধ'কে দেখেন তখন আসলে আপনি একজন ভিকটিমকেও দেখছেন। কারন তাঁর এই নির্বুদ্ধিতার পিছনে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ব্যর্থতা আছে। রাষ্ট্র তাঁকে পুষ্টি দেয় নি, শিক্ষা দেয় নি, সম্মান দেয় নি, কর্ম দেয় নি। তাই সে এমন করছে।  

মেইন সুইচে গোলমাল থাকলে যত ওয়াটের বাল্বই লাগান, আলো দেবে না। তো মেইন সুইচটা কী? মেইন সুইচটা হলো, এককথায় বৈষম্য আর একাধিক কথায়- শিক্ষা, সুশাসন, ন্যয়বিচার, জবাবদিহিতা আর শুদ্ধাচার। কোন 'শিক্ষা' বা পদ্ধতির কারনে আপনার সামনে বসা মানুষগুলো মৌলিক জাতীয় বিষয়গুলোতেও বিভক্ত, কোন পদ্ধতির কারনে কেউ কেউ দিগ্রী পেলেও অশিক্ষিত ও অসভ্য, কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক আনুকূল্যে কেউ কেউ এমন অসহিষ্ণু উৎকট হিংস্র অধার্মিক হয়ে উঠছে, আবার কোন প্রভাবে কেউ কেউ উদার মমমাময় দরদী আর বৈচিত্রের সৌন্দর্যে আস্থাশীল, মুদ্রার সেই অপর পিঠের বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে হবে। সেই পদ্ধতিকে চিহ্নিত ও উৎপাটিত না করা পর্যন্ত পাহারা দিয়ে শান্তি ঐতিহ্য ও বৈচিত্রকে রক্ষা করা যাবে না।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নাম বদলে ছাত্ররা যখন বৈষম্য দূর করার ব্রতকে সামনে আনলো, ব্যক্তিগতভাবে তখন থেকেই আমার আশার বসতি শক্ত হয়েছে। হৃদয়ে আর শরীরে অনেক অনেক রক্তক্ষরণ সত্ত্বেও, এই আশা ধরে রাখতে চাই।

Comments

The Daily Star  | English
Overall situation of foreign direct investment

Net foreign direct investment hits six-year low

The flow of foreign direct investment (FDI) in Bangladesh fell to $104.33 million in the July-September quarter of fiscal year 2024-25, the lowest in at least six years, as foreign investors stayed away from Bangladesh amid deadly political unrest, labour agitation, and a persistent economic crisis.

13h ago