পর্যালোচনা

অগ্নিযুগে যে মহারাজের ৩০ বছর জেল

অগ্নিযুগের বিপ্লবী, রাজনৈতিক নেতা ও সমাজসংস্কারক মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। এসবের বাইরে তিনি একজন একজন লেখক। তার রচিত 'জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম' গ্রন্থটিই মানুষের মাঝে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ছয় দশক আগে প্রকাশিত বইটি আজও সমানভাবে সমাদৃত। আত্মজীবনীমূলক এই রচনা নতুনভাবে সময় ও মহারাজকে জানতে ভূমিকা রাখবে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বাংলার বিপ্লবীদের লড়াই-সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাসকে বুঝতে বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বইটি বাংলাদেশ ও ভারতে দুটি ভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে। হয়েছে একাধিক সংস্করণ। ২৯ অক্টোবর ১৯৬৮ সালে ঢাকার ৩৭ নং হাটখোলা রোডের মডার্ন প্রিন্টিং ওয়ার্কস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত বইটির প্রথম সংস্করণের প্রকাশক ছিলেন লেখক নিজেই। 

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রকাশিত বইয়ের নাম 'জেলে ত্রিশ বছর- ব্রিটিশ: পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস', প্রকাশক- ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন, ঢাকা। আর ভারত থেকে প্রকাশিত হয়েছে, 'জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম' নামে। প্রকাশক- র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, কলকাতা। ১৯৬৮ সালে লেখকের নিজ উদ্যোগে প্রকাশিত সংস্করণের নামটিই রেখেছে র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। 

এর বাইরে তার আরও দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়। একটি- 'গীতার স্বরাজ' অন্যটি 'জীবনস্মৃতি'। কিন্তু এখন আর বই দুটির সন্ধান পাওয়া যায় না।

'জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম' বইসূত্রে জানা যায় মহারাজের কবিতা লেখার তথ্য। তিনি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, কারাগারে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কারাবিধিতে ছিল এমন কোনো শাস্তি বাদ নেই, যা মহারাজ ভোগ করেননি। এই অসামান্য ত্যাগ দেশের জন্য প্রেরণার। 

১৯১৪ সালে তৃতীয়বারের মতো আটক হলেন বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলায়। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বরিশাল জেল থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে বদলি হলেন। হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ি, কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্থায় চালান দেওয়া হলো। প্রেসিডেন্সি জেলে পৌঁছানোর পর তাঁকে ডান্ডাবেড়ি পরানো হলো। ক্ষুদ্র একটি সেলের মধ্যে দিনরাত সময় কাটাতে হতো তখন। কারও সঙ্গে কথা বলা যেত না। কারও সঙ্গে কথা হয়েছে, এটি প্রমাণিত হলে শাস্তির পরিমাণ আরও বেড়ে যেত। জেলখানায় পাথরসমেত নিম্নমানের চালের ভাত পরিবেশন করা হতো নিত্যদিন। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে কবিতা লিখলেন মহারাজ-

বইটির প্রতিটি পাতায় পাতায় রয়েছে অগ্নিযুগের নির্মম ইতিহাস। বইতে লেখক স্বদেশী আন্দোলন, সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ আন্দোলন, বিপ্লবী দলের গঠন, অনুশীলন সমিতি, অস্ত্র সংগ্রহ, বোমার কারখানা, ডাকাতি, খুন, জাল টাকা তৈরি, জেলজীবন, পলাতক জীবন, আন্দামানের জেল জীবন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়লাভ, শিক্ষকতা জীবনের প্রসঙ্গ বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।

'জেলের বেটা বড় খচ্চর,/ খেতে দেয় ধান আর পাথর...।' জেলখানায় প্রচণ্ড শীতে চাহিদা অনুযায়ী কম্বল না পেয়ে আবার লিখলেন- 'সুপারিন্টেনডেন্ট বড় পাজির পাজি,/ বেশি বেশি কম্বল দিতে হয় না রাজি।'

১৯১৬ সালে আন্দামান জেলে যাওয়ার পূর্বে জেলের ভেতর সুরকি দিয়ে সেলের দেয়ালে লিখলেন- 'বিদায় দে মা প্রফুল্ল মনে যাই আমি আন্দামানে, এই প্রার্থনা করি মাগো মনে যেন রেখো সন্তানে। জেলে কাগজ-কলম না থাকায় প্রতিবাদী এই কবিতাগুলো কোনো কাগজে লিখে রাখতে পারেননি, মুখস্থ করে রাখতে হয়েছে। কবিতাগুলো তিনি জেলের মধ্যে চিৎকার করে অন্য বন্দিদের শোনাতেন। কী এক সময় পারছেন, ভয়াবহ... 

শুধু ব্যক্তি মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর জীবন-সংগ্রাম নয় বইটির প্রতিটি পাতায় পাতায় রয়েছে অগ্নিযুগের নির্মম ইতিহাস। বইতে লেখক স্বদেশী আন্দোলন, সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ আন্দোলন, বিপ্লবী দলের গঠন, অনুশীলন সমিতি, অস্ত্র সংগ্রহ, বোমার কারখানা, ডাকাতি, খুন, জাল টাকা তৈরি, জেলজীবন, পলাতক জীবন, আন্দামানের জেল জীবন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়লাভ, শিক্ষকতা জীবনের প্রসঙ্গ বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।

বিপ্লবী দলের ব্যায় মেটানোর জন্য ডাকাতি করতে হয়েছে সংগঠনের সভ্যদের। মহারাজও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে এ নিয়ে তার খেদ ছিল। মহারাজ বলছেন- 'আমি পরাধীন ভারতে বহু ডাকাতি করিয়াছি, খুন করিয়াছি, চুরি করিয়াছি, নোট জাল করিয়াছি, কিন্তু যাহা কিছু করিয়াছি, সবই দেশের স্বাধীনতার জন্য- কর্তব্যের দায়ে। আমরা বিদ্বেষ ভাব হইতে বা ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধনের জন্য কিছুই করি নাই।  আমি যাহাকে হত্যা করিয়াছি, তাহার আত্মার কল্যাণ কামনাই করিয়াছি, তাহার পরিবারের শুভ চিন্তাই করিয়াছি। ডাকাতি বা খুন আমাদের পেশা ছিল না। আমরা যাহাদের বাড়িতে ডাকাতি করিয়াছি, যাহাদিগকে হত্যা করিয়াছি, আমরা জানিতাম তাহারা আমাদের স্বদেশবাসী। আজ স্বাধীন ভারতে আমাদের হাতে যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকিত, তবে আমরা যাহাদের বাড়ীতে ডাকাতি করিয়াছি, তাহাদের বংশধরদের মধ্যে যাহারা আজ বিপন্ন তাহাদিগকে সরকারি সাহায্য দান করিতাম।' [পৃষ্ঠা- ৪৯]

বইতে বিশেষত বিপ্লবী ভগৎ সিং ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের প্রসঙ্গও এসেছে গুরুত্বের সঙ্গে। মহারাজ তার সময়ে ভারতবর্ষের যেসব শীর্ষ নেতার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু অন্যতম। নেতাজির সঙ্গে মহারাজের সম্পর্ক শুধু খানিক পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁরা একসঙ্গে জেল খেটেছেন, রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। সংগঠন তৈরি করতে ভারতবর্ষের নানা স্থানে একসঙ্গে সফর করেছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে হাতে হাত রেখে লড়াই করেছেন। আমৃত্যু তাদের এ সম্পর্ক অটুট ছিল। কেমন ছিল সেই সম্পর্ক?
 
মহারাজ বলছেন '...মান্দালয় জেলে পৌঁছানোর পরই সুভাষবাবু বলিয়াছিলেন, মহারাজের সিট আমার পাশে থাকিবে এবং সুভাষবাবুর পাশে আমার থাকার সৌভাগ্য হইয়াছিল। সুভাষবাবুর জন্ম বড় ঘরে, শৈশব হইতে তিনি সুখে লালিত পালিত হইয়াছেন। কিন্তু দেশের জন্য দুঃখ-কষ্ট বরণ করিতে তিনি কাহারও অপেক্ষা পশ্চাৎপদ ছিলেন না। তিনি অম্লানবদনে সকল কষ্ট সহ্য করিয়াছেন। তিনি সকল অবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকিতেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোন আপত্তি নাই তাহার- যাহা পান তাহাই খান। চাকর-বাকরদের উপরও তাহার ব্যবহার খুব সদয়, কখনও কটুকথা বলেন না। কাহারও অসুখ হলে তিনি নিজে সারারাত্রি জাগিয়া সেবা করিতেন। একবার টেনিস খেলিতে যাইয়া আমি পড়িয়া যাই-তাহাতে হাঁটুর চামড়া উঠিয়া যায় ও ঘা হয়। সুভাষবাবু প্রত্যহ নিজহাতে আমার ঘা নিমপাতা সিদ্ধ জল দ্বারা ধোয়াইয়া দিতেন। খেলা, হৈ চৈ, আমোদ- প্রমোদ সবটাতেই তাঁর বেশ উৎসাহ ছিল। কয়েদীরা খালাসের সময় সুভাষবাবুর কাছে কাপড় জামা চাহিত। তিনি কাহাকেও 'না' বলিতে পারিতেন না। সুভাষবাবুর মত লোককে জেলখানায় সঙ্গী হিসাবে পাওয়া খুব সৌভাগ্যের বিষয়। [পৃষ্ঠা: ১১৩-১৪]

মহারাজের এই ভাষ্যের মধ্য দিয়ে আমরা অন্য এক নেতাজীকে দেখতে পাই। নেতাজীর পাশাপাশি বইতে দেখতে পাই ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে মহারাজের সাক্ষাৎপর্ব। এ কি শুধুই সাক্ষাৎ? না অন্য কিছু? ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসের সময় ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর। ভগৎ সিং তখন পলাতক আসামি হিসেবে আত্মগোপনে ছিলেন। পুলিশের কাছে তাঁর নামে ওয়ারেন্ট ছিল। মহারাজের সঙ্গে দেখা করার সময় রামশরণ দাসকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। রামশরণ দাস তখন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় দণ্ডিত ছিলেন। 

তিনি মহারাজের পূর্বপরিচিত, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল রামশরণ দাসের সঙ্গে। তারা একসঙ্গে আন্দামানে জেলে ছিলেন। রবীন্দ্রমোহন সেনের আপার সার্কুলার রোডের বাসায় এক রাতে তাদের সাক্ষাৎ হয়। সে সময় ভগৎ সিং মহারাজের কাছে বোমা ও পিস্তল চেয়েছিলেন। মহারাজ তাতে সাড়া দিয়ে ভগৎ সিংয়ের হাতে বোমা ও কয়েকটি পিস্তল দিয়েছিলেন। তবে একইসঙ্গে দ্রুতই এই পিস্তল ও বোমা ব্যবহার না করতে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু হয়েছিল ঠিক তার উল্টো। 

অনুশীলন সমিতির সভ্য মহারাজকে সবাই পছন্দ করতেন। এমনকী প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের নেতা কর্মীরা পর্যন্ত তাকে সমীহ করতেন। অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের মধ্যে প্রকাশ্য- অপ্রকাশ্য বিরোধ ছিল। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর সাথে কারো বিরোধ ছিল না। অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বগুণে তিনি তা অর্জন করেছেন। তিনি কখনো আপোষ করেননি। অন্যায়ের কাছে মাথা নথ করেননি। অসামান্য দেশপ্রেমিক এই মানুষটি ব্রিটিশ শাসনের সময় তিরিশ বছর জেল কেটেছেন। আত্মগোপনেও থেকেছেন পাঁচ-ছয় বছর। এরপর স্বাধীন দেশেও তাকে অত্যাচার- নির্যাতন সইতে হয়েছে। পাকিস্তান সরকার তাকে কারা অন্তরীণ করে রেখেছিল। একই সঙ্গে নিষিদ্ধ করেছিল তার লেখা 'জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম' বইটিও। 

সবকিছু ছাপিয়ে এই বইটির জন্য মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে আর্বিভূত হয়েছেন। কালের বিবর্তনে গ্রন্থটি অগ্নিযুগের উল্লেখযোগ্য দলিল হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ-শাসন ও প্রতিরোধের ইতিহাস জানতে হলে বইটির পাঠ আবশ্যিক।

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

2h ago