৮৪ বছর আগে ‘কৃষক’ ঈদ সংখ্যা কেমন ছিল

১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরের কথা। কৃষক-প্রজা পার্টির মুখপত্র হিসেবে একটি নতুন বাংলা দৈনিক প্রকাশিত হয়। নাম 'কৃষক'। আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক।

কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে পত্রিকার দায়িত্ব থেকে সরে যান আবুল মনসুর আহমদ। তবে এই মধ্যবর্তী সময়ে পত্রিকাটি জনমনে স্থান করে নেয়।

আজকের মতো এতো অফুরন্ত খবর বা সংবাদ সেকালের সাময়িকপত্রের পাতায় স্থান পেতো না। সংবাদপত্রের অনেকাংশ জুড়ে থাকতো 'সাহিত্য'।

বিশেষ করে ঈদ সংখ্যাগুলো সাহিত্যের বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতো। কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধের মোড়কে সমকালীন চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটতো।

ক্রেতাদের কাছে পণ্যের বা প্রতিষ্ঠানের খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপনদাতারাও এ সময়টিকে বেছে নেন। সময়টি তাদের কাছে আকর্ষণীয়, কারণ মুনাফা অর্জনের একটি বড় সুযোগ ঈদ উৎসব। ঈদ সংখ্যার বিজ্ঞাপন খাতে একটা বড় বাজেট রাখতো ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। 'ঈদুলফেৎর-১৩৪৭' সংখ্যাটি পর্যালোচনা করলে তা অনেকটাই অনুধাবন করা যায়।

ঈদ সংখ্যাটিতে মোট ৫৪টি বিজ্ঞাপন স্থান পেয়েছে। পূর্ণ, অর্ধ ও সিকি পাতা জুড়ে ছিল এসব বিজ্ঞাপন। ব্যাংক, কটন মিলস ও ইন্সুরেন্স কোম্পানির পূর্ণ পাতা বিজ্ঞাপন দেখে এই খাতগুলো সেসময় কতটা শক্তিশালী ছিল, তা অনুমান করা যায়।

পূর্ববঙ্গসংশ্লিষ্ট তিনটি বিজ্ঞাপন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দি লাইট অব হিন্দুস্থান ব্যাংক লিমিটেড (হেড অফিসঃ কুমিল্লা)। হিন্দু অধ্যুষিত ব্যবসায়ী মহলে মুসলমানদেরও যে একটা স্থান ছিল, এই ব্যাংক তার অনন্য প্রমাণ। বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সেক্রেটারিসহ কলকাতা, ঢাকা, চাঁদপুর ও করিমগঞ্জ (সিলেট) এজেন্টদের সবাই ছিলেন মুসলিম। একমাত্র হিন্দু সদস্য ছিলেন শিলচর (কাছার) এজেন্ট বাবু অজেন্দ্র কুমার পুরকায়স্থ।

আর ছিল ঢাকার সাধনা ঔষধালয় এবং ফরিদপুরের 'দি আবুবকর সিদ্দিকি কটন মিলস লিঃ' এর বিজ্ঞাপন। ঈদ সংখ্যার বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে জুতা কোম্পানি, সিনেমা, সাবান, লবণ, চা, গেঞ্জি, ওষুধ, টাইপ রাইটার, বন্দুক বিক্রেতা ছাড়াও বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে কবি মঈনুদ্দীনের 'মুসলিম বীরাঙ্গনা', ছান্দসিক কবি আবদুল কাদিরের 'দিলরুবা' এবং আবুল মনসুর আহমদের 'আয়না' গল্পগ্রন্থের বিজ্ঞাপন।

এতো গেল বিজ্ঞাপনের কথা। এবার আসি প্রকাশিত সাহিত্যের বিষয়ে।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'কৃষকের ঈদ' দিয়ে সংখ্যাটির শুরু। যে জাতির কাজ ছিল ভুখানাঙা মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, সে-জাতি কী করে গরিব-দুঃখীদের উপেক্ষা করে আত্মসুখে বিভোর হয়ে থাকতে পারে, সে-কথা কবি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছেন-

'জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিঁদ

মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?

একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার

উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পাজরের হাড়?'

শ্রীগোপালচন্দ্র নিয়োগীর 'ধনতান্ত্রিক পরিকল্পনা' সম্পর্কিত নিবন্ধটি প্রকাশ পেয়েছে তার পরেই। এতে তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মুদ্রানীতির বিশ্লেষণ করেছেন। সমকালীন ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানির বিজ্ঞাপন এবং চর্চিত সাহিত্যের কি নিবিড় যোগাযোগ!

সংখ্যার শেষ অংশে 'কবিতাগুচ্ছ' শিরোনামে দশটি ভিন্ন ভিন্ন কবির কবিতা ছাড়াও পুরো সংখ্যা জুড়েই রয়েছে কবিতার আধিপত্য। বেনজীর আহমদ (আজিকে ঈদের বাণী), জসিম উদদিন (মুসলিম হল), বন্দে আলী মিয়া (জানি একদিন যাবে চলে তুমি), বেগম সুফিয়া কামাল (ঈদের চাঁদ), এস ওয়াজেদ আলীসহ (ভিক্ষুক) কয়েকজন কবির উল্লেখযোগ্য কবিতা সংখ্যাটিতে স্থান পেয়েছে।

বিশ শতকের অন্যতম প্রধান কবি ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কারণে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত শাহাদাৎ হোসেনের 'ঝিন্ ঝিন্ ঝিন্ জিঞ্জিরে বাজে' কবিতাটি পরাধীন ভারতবর্ষের জনমনকে কতটা জাতীয়তাবাদে উদ্বেলিত করেছিল তা সহজেই অনুমেয়—

'কোথায় মক্কা মদিনা কোথায় জঙ্গী সে আসোয়ার

আজাদী ফৌজ তাজী বোররাকে হাঁকিছে বারম্বার

মজলুম আজি, ঘন ফরিয়াদে

জালেমের ফাঁদে আছাড়িয়া কাঁদে

দুনিয়ার বুকে বাদশাহী করে দাজ্জাল দাগাবাজ,

দোরবার ঘাতে কে ভুলিবে দাদ আগুয়ান হও আজ।'

'এক মাস রোজা গেলো। এফতারি, নূনপানি, কখনো কখনো গুড় ও আতপ চা'ল পানিতে ঘুটে ক্ষীর; এতে নারকেল দেয়াও চলে, কিন্তু মেলা ভার। সেহরী চিংড়ী পান্তা পেঁয়াজ, তাও পেট ভরে নয়। তাতে অনুযোগ নেই। খোদা যা মাপায়, তাই জোটে; তাতে না সবর হওয়া গুনার কাজ।..'

'কৃষকের ঈদ' শিরোনামে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর এই অগ্রন্থিত গল্পটি খুঁজে পাওয়া যাবে 'ঈদুলফেৎর-১৩৪৭' সংখ্যায়। পুরো সংখ্যায় রয়েছে এমনি নানা গল্প। ধূপছায়া পত্রিকার সম্পাদক ডাক্তার রেণুভূষণ গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনা 'টেম্পারেচার' এ ফুটে উঠেছে মানবদেহে নানামাত্রার টেম্পারেচারের বাৎচিৎ।

শ্রীহিরণ্ময় গুপ্ত 'কলিকাতার পৌর গ্রন্থাগার' শীর্ষক নিবন্ধে করপোরেশনের ওয়ার্ডভিত্তিক গ্রন্থাগারের অবয়ব কেমন হওয়া উচিত সে চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। চিন্তাশীল বাঙালি প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক কাজী আবদুল ওদুদ 'সুলতান মাহমুদ' শিরোনামে ঐতিহাসিক এই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলার প্রয়াস পেয়েছেন। এই ধারার আরেকটি রচনা আনোয়ারা চৌধুরীর নেপোলিয়ানের পারিবারিক জীবন সংযুক্ত হয়েছে আলোচ্য সংখ্যায়।

এই দুর্লভ ও অতি মূল্যবান ঈদ সংখ্যাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির ডিজিটাল আর্কাইভ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিয়াত্তর এবং মূল্য চার আনা। প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে।

প্রগতিপরায়ণ-আধুনিক নরনারীর জন্য প্রচ্ছদের 'পামিকোকো' ও 'হিমকল্যাণ' কেশতৈলের সঙ্গে সূচিপত্রে উল্লিখিত বেশ কয়েকটি নিবন্ধের বিশেষ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। ডা. কে. এন খানম, কুমারী কল্পনা সরকার ও রাবেয়া হায়দারের নিবন্ধ যথাক্রমে মেয়েদের 'মুখশ্রী রক্ষার উপায়', 'নারী-সৌন্দর্য্যের ঐতিহ্য' ও 'নারীর কেশ-সৌন্দর্য্য' রচনায় যা ফুটে উঠেছে প্রকৃষ্টরূপে।

এগুলো মূলত নারীর সৌন্দর্যচর্চায় ভূমিকা রাখতে নিবন্ধের মোড়কে বিজ্ঞাপিত পণ্য ব্যবহারের হাতছানি। তবে এ দেশের নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সামসুন নাহার মাহমুদের 'মেয়েদের শিক্ষা স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রা' শীর্ষক রচনাটি এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। উদ্ধৃত অংশটি তার অনন্য প্রমাণ—

'নারীর শিক্ষা ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে আলোচনা করিতে গিয়া আমরা বহু উপলক্ষ্যে বহুবার একটী বিষয় চিন্তা করিয়াছি তাহা হইল, ভবিষ্যতের শিক্ষিত নারীর জীবন কোন্ কোন্ পথে চলিতে পারে কি কি হইতে পারে তাঁহাদের উপযোগী … এই প্রসঙ্গে আমি অনেকবার সাহিত্যিক জীবনের এবং সাংবাদিক জীবনের উল্লেখ করিয়াছি। বাহিরের জগতের কোলাহল হইতে দূরেও নারী নিভৃতে পুস্তক রচনা, পত্রিকা পরিচালনা, চিত্রাঙ্কন প্রভৃতি কাজের মধ্যে জীবনের সার্থকতা খুঁজিয়া পাইতে পারে।'

বিধায়ক ভট্টাচার্য্যের 'ষ্ট্রাইক' এবং এস. এম. বজলুল হকের 'প্রতিহিংসা' শিরোনামে দুটি নাটকেরও দেখা মেলে আলোচ্য সংখ্যায়। এই সংখ্যায় প্রকাশিত 'রেডিওতে সাম্প্রদায়িক প্রীতি', 'বীমা তহবীল ও ভারতের শিল্প সমস্যা', 'বাঙলায় তুলার চাষ', 'জীবন বীমার নূতন কার্য্য সংগ্রহ পদ্ধতি', 'পাট রপ্তানি শুল্ক'র মতো বিষয়ভিত্তিক বেশ কয়েকটি নিবন্ধ আজও প্রাসঙ্গিক।

৮৪ বছর পর আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত 'কৃষক' ঈদ সংখ্যাটি আপামর পাঠকের দৃষ্টিতে কিরূপে ধরা দিল তার বিচার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

13h ago