নারীবিদ্বেষী সিরিয়াল কিলারের ‘অর্ধেক উপন্যাস’
আমেরিকার ওরেগন অঙ্গরাজ্যে মে মাসে ঋতুরাজ বসন্তের রাজত্ব। এখানে বসন্ত আর্দ্র, উষ্ণ ও আরামদায়ক। মার্চ ও এপ্রিল মাসে ওরেগনের ঘন অরণ্যে রাতের বেলা বেশ ঠান্ডা, পাহাড়ি এলাকায় বরফ পড়ে। তবে মে মাসটি নাতিশীতোষ্ণ ও সুখাবহ। এ সময় দিনগুলো হয় সূর্যালোকিত, রাতে ঠান্ডা, কখনো কখনো মৃদু থেকে হালকা বৃষ্টি হয়। বসন্তকালে ওরেগন স্টেটের জলপ্রপাতগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
প্রকৃতির এই পেলবতার ভেতরেই একজন ভয়ংকর খুনী ছদ্মবেশে ঘোরাঘুরি করে সুন্দরী তরুণীদের আশেপাশে এবং প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাদের নিয়ে যায় নির্জনে। সেখানেই নিজের লালসা চরিতার্থ করার পরে নির্মমভাবে খুন করে। এভাবে একটি দুটি নয়, নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী অন্তত ৩০জন নারীকে সে এভাবে খুন করে। টেড বান্ডি নামে এই সিরিয়াল কিলারের লোমহর্ষক সব ঘটনাগুলো দুই মলাটে বন্দি হয়ে 'অর্ধেক উপন্যাস' নাম ধারণ করলেও বস্তুত এটি গত শতাব্দীর সত্তুর ও আশির দশকে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমে তোলপাড় তোলা ঘটনারই চিত্রায়ন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ-এর পরিচালক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন তার পোশাকি নামে (কার্জন শেখ হাফিজুর) লিখেছেন এই উপন্যাস—যার পরতে পরতে রোমঞ্চ, ভয়, থ্রিল। অধ্যাপক কার্জন দুই দশকের বেশি সময় ধরে অপরাধবিজ্ঞান পড়ছেন, পড়াচ্ছেন। বিশেষ করে সহিংসতা ও কিশোর অপরাধ তার আগ্রহের বিষয়।
গল্পের প্রধান চরিত্র টেড বান্ডি নামে যুবকটি দেখতে সুন্দর, লম্বাটে মুখের আদল, খাড়া নাক, সুঠাম দেহ। বস্তুত যে সকল বৈশিষ্ট্যের কারণে কোনো যুবককে প্রথম দেখাতেই পুরুষালি ও আকর্ষণীয় বলা যায়, টেডের মধ্যে তার সবকিছুই আছে। কিন্তু তার বাম হাত ঝুলে আছে। কনুই থেকে হাতের অর্ধেক ঘাড়ের সঙ্গে বাঁধা এবং সেটি প্লাস্টার দিয়ে মোড়ানো। যে কেউ দেখে ভাববে কোনো দুর্ঘটনায় হয়তো তার হাতটি ভেঙে গেছে। আসলে এটি তার ছদ্মবেশ এবং টার্গেট নারীদের কাছে অনুকম্পা পাওয়ার কৌশল—যে কৌশলের কাছে একে একে হার মানেন রেবের্তা ক্যাথলিন পার্ক, ক্যারল অ্যান বুনসহ অসংখ্য নারী।
বাবা মায়ের অবৈধ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে টেড বান্ডির জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৪ নভেম্বর। তার বাবা ও দাদার পরিচয় সে জানে না। জন্মের পরে প্রথম তিন বছর কেটেছে তার নানা বাড়িতে। তার নানা ছিলেন প্রচণ্ড বদমেজাজি। তার বদ ও বিকৃত অভ্যাসও ছিল। সে ও তার মা কেউই তার নানার কটু কথা এবং নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। একটি শিশুর শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সুষ্ঠু বিকাশের জন্য যে আদর ও মমতা প্রয়োজন, বান্ডি তার নানাবাড়িতে সেটি পায়নি। সৎ বাবার সংসারে এসেও তার চাওয়াগুলো ছিল অপূর্ণ। শৈশবের এত এত ঘাটতি পূরণ করার জন্য মায়ের কাছ থেকে যে অনিঃশেষ আদর, যত্ন ও ভরসা দরকার ছিল, তার মা তাকে সেটি দিতে পারেননি।
শৈশবে আদর-স্নেহবঞ্চিত টেড বান্ডি যৌবনে এসেও নানাভাবে প্রতারিত হতে হতে উপলব্ধি করে, নারীরা তার জীবন শেষ করে দিয়েছে। যে কারণে সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। তার মনস্তত্ত্ব দখল করে নেয় বিকৃত যৌনাচার, লালসা, রক্ত আর খুনের নেশা। টেড বিশ্বাস করে, 'মেয়েদের কোনো আসল সত্তা নেই, প্রত্যেক মেয়েই একটা মুখোশ, আড়ালে আছে দ্ব্যর্থবোধক অস্তিত্ব। তারা এরা ছেলেদের মায়া দিয়ে ভোলায়, ছলনা দিয়ে ভোলায়। এক একটা ছেলের জীবন তছনছ করে দেয়।'
নারীদের ব্যাপারে টেডের এই ধারণা বা বিশ্বাস একদিনে তৈরি হয়নি। কিন্তু যখন তার মনস্তত্ত্বে এই পরিবর্তনগুলো আসছিল, তখন তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হয়নি। উপরন্তু মানসগঠনের এই কালে তার কোনো বন্ধুও তৈরি হয়নি। টেড দেখেছে তার চারপাশে শুধুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানুষের ভিড়। তবে আইন ও অপরাধবিজ্ঞান কোনো যুক্তিতেই এইসব বিকৃত যৌনাচার ও খুনকে সমর্থন করে না। করে না বলেই টেড একসময় পুলিশের জালে বন্দি হয়। কিন্তু দুর্ধর্ষ ও স্মার্ট টেড জেল থেকে পালিয়ে যেতেও সক্ষম হয়। যদিও শেষরক্ষা হয় না। তাকে বিচারের মুখোমুখি হতেই হয়। কিন্তু তার অপরাধ প্রমাণ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। উপরন্তু সে যখন জেলে, তখন তার পক্ষেও জনমত গড়ে ওঠে। কারণ মানুষের বিশ্বাস হতে চায় না যে, এরকম একজন মানুষ খুনী হয়ে উঠতে পারে।
তিনটি পৃথক মামলায় তাকে তিন দফা মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ভয়ংকর সব অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। তার সিরিয়াল কিলিং, নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতা প্রকাশ্যে আসার পর থেকে এটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় তার বিচার কার্যক্রম—যেটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম কোনো টেলিভাইজড প্রসিকিউশন। ১৯৮৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ফ্লোরিডা স্টেট জেলাখানায় ইলেকট্রিক চেয়ারে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে টেড বান্ডির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে সে ৩০ জন তরুণীকে ধর্ষণ ও হত্যার কথা স্বীকার করে।
এ বছরের অমর একুশে বইমেলায় 'অর্ধেক উপন্যাস' প্রকাশ করেছে তাম্রলিপি। চারু পিন্টুর প্রচ্ছদে বইটির গায়ের মূল্য ৩০০ টাকা। হাফিজ কার্জন উপন্যাসের নাম দিয়েছেন 'অর্ধেক উপন্যাস'। কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ভার পাঠকের ওপর।
Comments