কেমন আছে মুর্শিদাবাদে ভাষাশহীদ আবুল বরকতের বাস্তুভিটা

দুর্ভাগ্য শহীদ আবুল বরকতের কোন অ্যাকাডেমিক রেকর্ড কলেজে নেই। কিন্তু একথা সর্বেব ভিত্তিহীন। অমর ভাষা শহীদের প্রতি আজও অবিচার শেষ হয়নি।
মুর্শিদাবাদে ভাষাশহীদ আবুল বরকতের বাস্তুভিটা, ছবি: লেখক

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল বরকত। তার মূল বাড়ি মুর্শিদাবাদে। কেমন আছে সেই বাড়িটি। দেখতে যাই গতকাল। বাড়িতে ঢুকতে আকস্মিক গা ছমছম করে ওঠে। সুনসান অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা! শোকস্তব্ধ গৃহটি অমর একুশের ভাষা শহীদ আবুল বরকতের পৈতৃক ভিটে বাড়ি। এইখানে কেটেছে বরকতের যৌবনে পদার্পণের অমলিন দিনগুলি।

বরকতের স্মৃতি-ধন্য সেই আন্দুপুকুর, বাঁশ বাগান, ভেটেল, নিম ,তেঁতুল আরও কত গাছগাছালিতে মোড়া বাবলা গ্রাম। গ্রামে পা রাখতেই চোখে পড়বে একুশের সুগন্ধি, একদল তরুণদের উদ্যোগে শহীদের স্মৃতিতেক্রিকেট টুর্নামেন্টের প্রতিযোগিতা চলছে। দু'পা হাঁটতেই দেখা গেল মাঠে পেল্লাই সব খুঁটি থাম্বা বসছে, সারিবদ্ধ দোকানপাট বসার জোর প্রস্তুতি চলছে, কেউবা সামিয়ানা টাঙ্গাতে ব্যস্ত। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলেই শুরু হয়ে যায়  বাবলা গ্রামে মেলা, খেলা শহীদ স্মরণ উৎসব। 

বর্তমানে কাঠা চারেক জায়গায় পোড়া ইটের উত্তর দুয়ারি দোতলা বাড়ি। টিনের ছাউনির ঘরটা আজ মলিন। অবশ্য ওপরে ওঠার ঘসা খাওয়া বিবর্ণ সিড়িটা অবিকল রয়েছে। বাড়ির মালিক গোলাম মুর্শেদ সংস্কার করে ভোল পাল্টে দিয়েছেন। দোতলায় বাড়তি কামরায় কংক্রিটের ছাদ, লোহার গ্রিল, দরজায় রঙের প্রলেপ, চেনার আর উপায় নেই। নিচের ঘর লাগোয়া পুবের দেয়াল বরাবর তির বর্গার ছাদ পাড়া স্নানাগার আর শৌচালয়। আঙিনার উত্তর-পশ্চিম কোণে আদ্দি কালের পোড়ো একটা বৃহদাকার পরিত্যক্ত স্নানাগার। চৌহদ্দি ঘিরে চুন সুরকির গাঁথনি দেওয়া ভাঙা ইটের পাঁচিল, সামনের অংশ ধসে পড়েছে।

রাত গড়ালে ভাষা দিবস। এ বছরও তার ব্যতিক্রম। শহীদ বরকত স্মৃতি সংঘের সভাপতি সৈয়দ সিয়াদত আলি জানান," শহীদ বরকতের ছোট ভাই আবুল হাসানতের ছেলে আইনুদ্দিন বরকত আমার আবাল্য বন্ধু। শোকে, দুঃখে বরকতের বৃদ্ধ পিতা শামসুজ্জোহা ভোলাই মিয়া মারা গেলেন। শহীদের জননী হাসিনা খাতুনও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার ও অপমানিত হয়ে দেশ ছাড়েন। তিনি দেশ ছাড়া পূর্বে আমার হাত ধরে দু'ফোটা চোখের পানি ফেলে বলেছিলেন, পারলে আমার বরকতের ভিটেমাটির স্মৃতি ধরে রেখো। সেদিন থেকে আমি বাবলা গ্রামে শহীদ বরকতের স্মৃতি সংরক্ষণে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছি।" 

বরকতের বাড়ির সামনের সদর রাস্তার উপর পাশাপাশি দুটি আবক্ষ মূর্তি, তার একটি 'বরকত ভবনে'র সম্মুখে, অন্যটি 'আবুল বরকত স্মৃতি সংঘে'র উদ্যোগে নির্মিত। গ্রামে 'বাবলা আবুল বরকত শিশু শিক্ষাকেন্দ্র' স্থাপন ও 'বাবলা- বহড়া' প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯৮৩ সালে নামকরণ হয়েছে। 'শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়'। স্কুলের পেছনে বরকতদের দানের জায়গায় প্রায় বিঘা কবর স্থান। ১৯৬৩ সালের ২১ জুলাই বরকতের বাবা শামসুজ্জোহা ভুলু মিয়া মারা যান। এখানেই শায়িত আছেন তিনি। 

গ্রামবাসীদের দাবি- শহীদের নামে একটা খেলার মাঠ এখানে গড়ে উঠুক। শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে ওয়াকফকৃত বাস্তুভিটাটির সংরক্ষণ প্রয়োজন। উল্লেখ্য শহীদের মা ওয়াকফ করা বাস্তুবাড়িসহ স্থাবর অস্থাবর মিলে বিয়াল্লিশ বিঘা সম্পত্তির মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগ অংশ নামমাত্র মূল্যে বিক্রি ১৯৬৪ সালে বরকতের মা হাসিনা বানু সপরিবারে বাংলাদেশে চলে যান। নিবাস গাড়েন গাজীপুর মহানগরের চান্দনা গ্রামের 'বাবলা বিথী'তে।

বাবলা মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার অন্তর্গত এক অজ পাড়া গাঁ। এই গ্রামে ১৯২৭ সালে ১৬জুন  জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের অদূরে এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বাবলা নদী। সালার স্টেশন থেকে তালিবপুর মোড় তিন-চার কিমির পথ। মোড়ের মাথায় বরকতের স্মৃতিধন্য তালিবপুর হাই স্কুল। এই স্কুল থেকে তিনি ১৯৩৭ সালে  চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। 

বাবলা বরকতের প্রিয় জন্মভূমি হলেও তাদের সাত পুরুষের আদিভূমি ছিল সালারের গুলহাটিতে। সালার থেকে কান্দিগামী রাস্তায় শালিন্দা হয়ে প্রাচীন গুলহাটি গ্রাম। শহীদ বরকতের ছোট চাচা খোদা হাফেজ মিয়া এই গ্রামে বসবাস করতেন। তার দুই পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র আবুল কালাম জাকারিয়া ওরফে মানিক মিয়া আছেন। তিনি সদ্য নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও সহধর্মিনীকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান। প্রায় ৮০ বছর অতিক্রান্ত বৃদ্ধ মানিক মিয়া বাড়ির দলিজে পায়ের উপর পা উঠিয়ে বসে আছেন। চিনতে এক মুহুর্তও অসুবিধে হয়নি। শহীদ বরকতের মতোই চেহারার গড়ন, লম্বা লম্বা পা, দীর্ঘ চেহারা। পরিচয় দিতেই হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন, অন্দরমহলে নিয়ে গিয়ে স্মরণ করলেন শৈশবের নিজের চাচাতো কথা। বললেন, "ছোট ছিলাম, ঢাকা থেকে খবর এলো, ভাই আর নেই, বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল ! এই বাড়িতেই ওর আব্বা মানে আমার বড় চাচার জন্ম। 'তারপর একে একে ওপারে চলে গেল, আমরা থেকে গেলাম। হাসনাত ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা বেড়াতে এলে এ বাড়িতে বেড়াতে আসে, আমরাও যাই।'

শহীদ বরকতের ছোট চাচা খোদা হাফেজ মিয়া এই গ্রামে বাস করতেন। ছবিতে তার দুই পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র আবুল কালাম জাকারিয়া ওরফে মানিক মিয়া পরিবার নিয়ে আছেন এইখানে। ছবি: লেখক

 মানিক মিয়ার চার ছেলে। কেউই তেমন সম্মানজনক প্রতিষ্ঠা পায়নি। মেজো ছেলে আব্দুল কাদেরের বড় মেয়ে সোহানি বেগম একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। সোহানির একমাত্র ভাই রিয়াজুল ইসলাম এই বয়সে এত লম্বা যে দেখে বোঝার উপায় নেই সে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তানভীরের স্ত্রী শবনম জাহান যথেষ্ট শিক্ষিতা মহিলা বলেই মনে হলো। তাঁর স্বামী দিল্লির এক বহুজাতিক সংস্থায় সামান্য বেতনের চাকরি করেন। ময়না মিয়ার তিন ছেলে, তিন মেয়ে। ছেলেরা একই বাড়িতে বসবাস করেন। ছোট ছেলে সাহেল আলি আতা  অনেকটা শহীদ বরকতের দেহাকৃতি পেয়েছেন। ময়না মিয়া ও মানিক মিয়া দুই পরিবারের সামান্য কৃষি জমির উপর জীবিকা চলে। সুখে-দু:খে এভাবেই দিন কাটাচ্ছেন বরকতের আত্মীয় স্বজনরা। সালার- ভরতপুরের পুবগ্রাম, তালিবপুর ,শিসগ্রাম, কাগ্রাম প্রভৃতি মহল্লায় ছড়িয়ে আছেন বরকতের নিকট আত্মীয়রা।

শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে ভাষা শহীদ আবুল বরকতের যৌবনের দিনগুলি এখন বিস্মিত অধ্যায়। কৃষ্ণনাথ কলেজের দিনগুলি কেমন কেটেছে তা জানার নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র নেই। ফেলে আসা সাতাত্তর বছরের আগের ছেঁড়া ছেঁড়া জীর্ণ স্মৃতি আজ বিবর্ণ। 'সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা ' ছেলেটির কলেজের বারান্দাময় ঘুরে বেড়ানো সহপাঠী , কলেজ ঘাটের আড্ডা , গোরা বাজারের ইউসুফ বিল্ডিং এর  দিবা রাত্রির  সাথীরা আজ আর কেউ নেই। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন 'বরকতময় ইউসুফ বিল্ডিংটা' , ওয়াকফকৃত ছাত্রাবাসটিতে আজ বরকতের মতো ছাত্রদের থাকার সুযোগ নেই, কিছু অসাধু ও বেওয়ারিশদের দখলে।

বরকতের বাড়ির সামনের সদর রাস্তার উপর 'বরকত ভবনে'র সম্মুখে পাশাপাশি দুটি আবক্ষ মূর্তি। ছবি:লেখক

দেশভাগ বরকতের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে বলে তার পরিবারের মন্তব্য। তিনি দেশ বলতে অখন্ড বাংলাকেই বুঝেছিলেন। গোড়ামী,সম্প্রদায়িক ভেদাভেদ তাঁর চোখে ছিল বিষময়। শিক্ষিত মুসলিমদের একটা বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তানের পাড়ি দিলেও তাঁর পরিবার দেশত্যাগের কথা চিন্তা করতে পারেননি। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বিত বরকত বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেও অখন্ড বাঙালি জাতি স্বত্তা ও মাতৃভাষা বাংলার জন্য নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করলেন তিনি মৃত নন- তিনি শহীদ। মাতৃভাষা বাংলার অস্তিত্বের সঙ্গে তার নামটি চির অমর হয়ে থাকবে।

কৃষ্ণনাথ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝা বলেন, দুর্ভাগ্য শহীদ আবুল বরকতের কোন অ্যাকাডেমিক রেকর্ড কলেজে নেই। কিন্তু একথা সর্বেব ভিত্তিহীন। অমর ভাষা শহীদের প্রতি আজও অবিচার শেষ হয়নি। কৃষ্ণনাথ কলেজের মতো ঐতিহ্যবাহী কলেজে তার নামে একটি সভাকক্ষের নামকরণ হয়েছে মাত্র । বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে চিরস্থায়ী করতে সংকীর্ণতার বেড়াজাল থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে বলে মত তার।

লেখক ও গবেষক। মুর্শিদাবাদ

Comments