ছলনা না জানা কবি আল মাহমুদ

আল মাহমুদ, ছবি: সংগৃহীত

কবিতা ভাবের ব্যাপার। ভাবের জগতে ডুব দিয়ে নিজের আবেগ, অনুভূতিকে উপমা, চিত্রকল্প ও অলঙ্কারের মাধ্যমে প্রকাশই কবিতা। দ্বিমত থাকতে পারে অনেকের। যেমন কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতাকে বলছেন 'জ্ঞান চেতনার আধার ও সঞ্জীবনী বায়ু যা কিনা মহান অনুভূতির কল্লোলিত বহিঃপ্রকাশ।'

আল মাহমুদ এমন এক অসামান্য কবির নাম। গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ সমানতালে লিখে গেলেও নিজেকে সব সময় কবি বলেই জ্ঞান করেছি । কবি তো বটেই-গত পঞ্চাশ বছরে বাংলার অন্যতম সেরা কবি। আমাদের 'সোনালি কাবিনের' বর্ণীল কবি। একজন বাঙ্গালী জীবনবোধের ও রসের কবি আল মাহমুদ।

যতটা জেনেছি, আল মাহমুদ আসলে কবি হতেই বোচকা-বুঁচকি নিয়ে শহরে এসেছিলেন। বিদ্যার জাহাজ হতে আসেননি। মন, মনন, আর তীব্র কল্পনাশক্তি নিয়ে লিখতে বসে গিয়েছিলেন। সারাটা জীবন লিখেছেন। তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছিলেন, সমালোচনা পিছু ছাড়েনি, জেল খেটেছেন, কিন্তু লেখালিখিতে বৈরাগ্য আসেনি; তাই খান্তি দেননি এবং এভাবেই হয়ে উঠেছেন বাঙলা কবিতার এক মহীরুহ। এখন যেই কথা সেই কাজ। দেখা যাক এই কবি কবিতা নিয়ে কী ভাবছেন।

আল মাহমুদ ছন্দ প্রিয়। গদ্যরীতি ও পদ্যরীতির মাঝখানে তার অবস্থান। ভাষার ক্ষেত্রে আরবি-ফার্সি ভাষা ব্যাবহারে তার জুড়ি মেলা ভার। অন্যদিকে কবিতার উপাদান লোকজ হলেও শব্দ চয়নে ও বাক্য গঠনে আধুনিক। এগুলো তার কবিতাকে জঙ্গম করে তোলেনি বরং কবিতায় এনেছে নতুন স্বাদ ও দ্যোতনা। জয় করেছেন পাঠকের হৃদয়, তাইতো 'সোনালী কাবিন' কাব্যের শুরুতেই জানান দেন 'পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা/ দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।'

'ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনী' কবির এই সত্য উচ্চারণই বলে দেয় তিনি অসামান্য। কবিরা ছলনা জানে না, তাদের ছলনা জানতে নেই। তারা ভালবাসার কাঙাল; প্রেমের পূজারী। কবিতার মাধ্যমেই মূলত হৃদয়ের ও অন্তরাত্মার প্রকাশ ঘটে। তাইতো আমাদের এই কবিও ব্যবসা করেননি; কবিতা নিয়েতো করা প্রশ্নাতীত। তাইতো সারাটা জীবন গরিবিয়ানা জীবনী কাটিয়েছেন কিন্তু জীবনকে নিয়েছেন যুঝে এবং করেছেন মহান। সঙ্গম এবং সাঙ্গ করেছেন শব্দের সাথে বন্ধুত্ব।

'কবিতা এমন' শীর্ষক কবিতায় আল মাহমুদ তার দেখা নানা জীবন অভিজ্ঞতার আলোকে কবিতার সংজ্ঞায়ন করেছেন। কবিতা যেন এখানে সহজ সরল এক গ্রামীণ আবহ। কৈশোরের স্মৃতিতে 'পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ' যেভাবে দেখেছেন সেই ভাবকল্পই এখন কবিতা হয়ে ধরা দিয়েছে। শেষ দিকে অবাক করে দিয়ে কবি বললেন 'কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার'। এ যেন কবি শামসুর রাহমানের 'রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার' যেখানে রচিত হয়েছিল স্বাধীনতার ইশতেহার অথবা জীবনানন্দের 'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা'। নেশা জাগানো উদ্দাম খোলা চুল কবিতা হয়ে ধরা দিচ্ছে কবির কাছে আর যথারীতি প্রেম, ভালবাসা স্বাধীনতার ঘোষণা দিচ্ছে।

কবিতা নিয়ে কতই না ভেবেছেন এই কবি। তাই আক্ষেপ ঝড়ে পরে 'অবুঝের সমীকরণ' কবিতায়। কেওই যেন কবিতাটা ঠিকঠাক বুঝছে না; সবাই একটা কিসের পিছুটানে যেন আছে। কবি চিত্তে তাই ব্যাকুলতা ও ক্ষোভ:'কবিতা বোঝে না এই বাংলার কেউ আর.../পুলিস দারোগা ছাত্র অধ্যাপক সব.../ কাব্যের ব্যাপারে নীরব!' এমনকি 'ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা/ সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে/ কবিতা বোঝে না।'

যার সারা অঙ্গে কবিতা, সেই কবিতা বোঝে না; এমনকি নাটের মহলের  নটী নারীও কবিতা বোঝে না। সবাই ভাব ধরে আছে বোঝার- সঙ সেজে আছে যেন কবিতা শুধুই ঢং। কবির মনে তাই তীব্র দহন। শিল্প বুঝছে না কেও। শিল্প যেন এখন শুধু টাকার বিনিময়ে বিক্রীত মাল! শিল্প যেন একটু চেখে দেখা, সামান্য ছুঁয়ে দেয়া, রঙের প্রলেপ- মমতা দিয়ে আলিঙ্গন বা মননে ও মগজে ধারণ নয়। কবি তাই যারপরনাই ব্যথিত। পাঠক এমনকি কবির সাথেও কবিতার আজ কত দূরত্ব। তাই শান্তি নেই কবির মনে। কবি শহীদ কাদরীর মত তাই বলতে হয়:'প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/ কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…'

"লোক লোকান্তর" নাম কবিতায় দেখি এক অসাধারণ আল মাহমুদকে। এই কবিতার শেষে অকপটে ঘোষণা করেন 'কবিতার আসন্ন বিজয়'। কবিতার শুরুতেই কবি বলেন: 'আমার চেতনা যেন একটি শাদা সত্যিকার পাখি, / বসে আছে সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের ডালে;'

কবি পাখি হয়ে এই প্রকৃতির সৌন্দর্যের 'সুগন্ধ পরাগে মাখামাখি' করেন; ঠোঁট দিয়ে চুমু খান।বাংলার এই নিগূঢ় রহস্যময়ী প্রকৃতির ছলা কলার 'রূপে তার যেন এত ভয়'; কবি একদিকে পড়েছেন মোহে আরেকদিকে ধন্দে। এসব উৎরে কিন্তু আবার এসবকে সাঙ্গ করেই তিনি রচনা করেন কবিতার সৌধ। কবিতা যেন হয়ে উঠে চিত্রকল্প মাখা এক ঘর যেখানে শব্দেরা আপন সন্তান হয়ে কোলে ফিরে। মায়ায় ও আনন্দে। এইতো কবিতা। সৃষ্টির আনন্দ ও যন্ত্রণ। এক 'আহত কবির গান'। কিন্তু সৃষ্টির আনন্দে সদা উদ্বেল, অনেকটা নজরুলের মত 'সৃষ্টি সুখের উল্লাসে' ফেটে না পড়লেও রবীন্দ্রনাথের মত বিজয় জানান দেন 'ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি' বলে। এতে কবিতার রুদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত; হয় কবিতার বিজয়।

'শোকের লোবান' কবিতায় কবি যেন উপহার দেয় কবিতার এক অনন্য সংজ্ঞা, 'যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর  নিম্ন-নাভিমূল'। কবি সাবলীল ও অকাট্য যুক্তিতে বলে ফেলেন কবিতার ভাষায় বিম্বিত হতে চাইলে শিশুর মত নগ্ন হতে হবে, ভালবাসার কলা জানতে হবে; কবিরা সহজ কিছু পারে না। তাদের করতে হয় শিল্প সাধনা। সহজ করে কি বলা যায়? জীবন কি সহজ করে ধরা দেয়?

স্বয়ং নমস্য রবি ঠাকুরও বলেছিলেন 'সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে,/সহজ কথা যায় না বলা সহজে'। প্রিয় জীবনবাবুও প্রশ্ন রেখেছিলেন 'সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা কে বলিতে পারে আর!' কবিতা যে সহজ নয়; জীবনের মতই, প্রকৃতির মতই বৈচিত্র্যময় ও রহস্যময়য়।

দেখা যাচ্ছে আল মাহমুদের কাছে কবিতা গ্রামের মতই সহজ সরল আবার প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ ও নারীর লীলার মতই রহস্যময় ও মোহনিয় সৌরভে আকর্ষণীয়।কবিতাও ধোঁয়া তুলসীপাতা না। কাম-তাপ- দুঃখ-শোকে কবিতাও আচ্ছন্ন হয় যেমন হন কবি। কবিতা একটা লড়াই এর জায়গা যেমনটা ছিল আল মাহমুদের জীবন। কবিরা হারে না; তেমনি কবিতাও। কবিতা হল জয়ন্তীর জয়।

কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো- এই সকল কাব্যগ্রন্থ হারাবার নয়। এগুলো কবির বিজয় কেতনই উড়ায়। বাঙলাকে আবিষ্কার, গ্রামবাংলার লোকজ ধারাকে ধারণ এবং নারী পুরুষের সম্পর্কের বয়ান বুঝতে গেলে আমাদেরকে আল মাহমুদের কবিতার কাছে যেতে হবে নিঃসঙ্কোচে।

ইতিহাস ও কালকে সাক্ষী রেখে লেখেন ' ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ ট্রাকের মুখে আগুন দিতে/ মতিয়ুরকে ডাক।/ কোথায় পাবো মতিয়ুরকে/ ঘুমিয়ে আছে সে!/ তোরাই তবে সোনামাণিক/ আগুন জ্বেলে দে।' ('ঊনসত্তরের ছড়া-১')। কবিতা যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুষে উঠে। এ যেন এক অন্য আল মাহমুদ গর্জে উঠেন কবিতায়। কবিতা হয়ে উঠে একটি বারুদ। কবিতা যেন এখানে সুকান্তের 'দেশলাইয়ের কাঠি':'মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—/ বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;'

যেই শিশু প্রায় ১০-১২ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলন নিয়ে কবিতা লিখায় তার উপর হুলিয়া জারি করা হয়; যিনি পরিণত বয়সে  মুক্তিযুদ্ধে  ঝাঁপিয়ে পড়েন সেই কবিকে  আমরা অনেকটা  অবহেলা করেছি। এ কবির ছিল না কোন একাডেমিক ডিগ্রীর প্রতি ঝোঁক। সেই জন্যই কি ইংরেজি পড়া লোকরা চটেছিলেন! নাকি তিনি জীবনের শেষ দিকে ইসলামিক ভাবধারার কবিতা লিখেছেন বলে? কবিকে কবির মত দেখলেইতো হয়। কবিতা ভালো লাগল কি লাগল না সেটাই মুখ্য। খামোখা ব্যক্তিকে নিয়ে এত টানা হেঁচড়া কেন? তারা হয়ত ভাবতেই পারেনি কবি টিকে থাকবেন বাংলা কবিতার মানসপুত্র হয়ে।

আল মাহমুদ সারা বাংলাদেশকে কবিতায় খুঁজেছেন; খুঁজেছেন মানুষকে এবং নিজেকে। 'নোলক' কবিতায় কবির মায়ের হারানো 'সোনার নোলক' যেন তার এক একটি কবিতা। যতবারই যত জায়গায় তিনি এই নোলক খুঁজেছেন ততবারই নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন এই বাংলাকে, বাঙ্গালী ও নিজেকে। এই আবিষ্কারই তাকে কবিতার কাছে নিয়ে গেছে, গভীর থেকে গভীরে। সহজিয়া ঢঙ্গে কবি বলেন: 'আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/ হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে.'

'প্রত্যাবর্তনের লজ্জা' নিয়ে কবি হয়তো আর এই ধরাধামে ফিরবেন না; কিন্তু দেহত্যাগ করলেও আজীবন বেঁচে থাকবেন কালোত্তীর্ণ কবিতায়, কবিতাপ্রেমিদের আত্মার আত্মীয় হয়ে। বাঙলা ও বাঙ্গালীদের জন্য আল মাহমুদ অপরিহার্য। কবির কলমে দাবি 'আলো-আঁধারির এই খেলা তবে আমাকে নিয়েই শেষ / আমার শরীর কাঁপছে যেমন কাঁপছে বাংলাদেশ।'

আজ আপাতত ছেড়ে দিচ্ছি 'সোনালী কাবিন'র একটি চরণ দিয়ে 'আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন' মানুষ বেঁচে থাক, অধিকার নিশ্চিত হোক; হিস্যা মিলুক সুষম বণ্টনে। কবি ও কবিতা বেঁচে থাক লোক লোকান্তরে। চৈতনে অচৈতন্যে। অনেকটা কবির ভাষায় বলি: কবিতা হউক সত্য ও বিবেকের ভাষণ। কবিরা হয়ে উঠুক এক একজন সত্য ও স্বপ্নদ্রষ্টা।

 

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

2h ago