শাশ্বত দাম্পত্য প্রেমের যে দীক্ষা
কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। সচেতন পাঠক মাত্র তার নামের সঙ্গে কিছু বইয়ের নাম বলবেন। যেমন- জীবন আমার বোন, কালো বরফ, অনুর পাঠশালা ও অশরীরী, এগুলো এক সময় ব্যাপকভাবে পাঠকপ্রিয় হয়।
স্মৃতিচারণ, দেশভাগ, ডায়াস্পোরিক টেনশন এই তিনের সমাহার তার কথাসাহিত্য। 'কালো বরফ' বইটি প্রকাশ হয় ১৯৭৭ সালে। মাহমুদুর রহমানের ইংরেজি অনুবাদে হারপারকলিন্স ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে।
পাঠ অভিজ্ঞতায় বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে দাম্পত্য প্রেম নিয়ে লেখা উপন্যাসের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এর মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে দাম্পত্য জীবনের উল্লেখ থাকলেও, দাম্পত্য প্রেম নিয়ে তেমন আলাপের সন্ধান আমরা পাই না। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পাঠকপ্রিয় দুটি উপন্যাস চরিত্রহীন ও শেষ প্রশ্ন এ দাম্পত্য জীবন এলেও অনিবার্য অধ্যায়ের প্রতি তেমন আলোকপাত করেননি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য দাম্পত্য বিষয়ে একটা বিরূপ বার্তা আমাদের দেয়। জীবনানন্দ দাশের কিছু ছোটগল্প যেমন, প্রণয়-প্রণয়িনী, জামরুলতলা, শুধু সাধ, শুধু রক্ত, শুধু ভালোবাসা এই তিনটা গল্পে দাম্পত্য প্রেমের নানা অনুষঙ্গ উঠে এসেছে। তবে সেগুলোও পাঠকের কাছে দাম্পত্য বিষয়ে খুব ইতিবাচকতা দেয় না। এই ছাড়াও বাংলাসাহিত্যের খ্যাতিমান লেখকদের ব্যক্তিজীবনের দিকে আলোকপাত করলেও চিরায়ত বিষয়ে আশার আলো অধরা।
অন্যদিকে ইংল্যান্ডের সাহিত্যে ডিএইচ লরেন্স একজন খ্যাতিমান লেখক। প্রকৃতপক্ষে, লরেন্সকে দুনিয়াজুড়ে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্ররা প্রশংসার দৃষ্টিতে বিচার করেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস সান্স এন্ড লাভার্স পড়লে আমরা মোরেল দম্পতির দাম্পত্য সম্পর্কের একটা বিস্তারিত বিবরণ পাই। রোডেশিয়ার অন্যতম সাহিত্যিক ডরিস লেসিং রচিত দ্য গ্রাস ইজ সিঙিং- এ আমরা ম্যারি টার্নার ও ডিক টার্নারের দাম্পত্য সম্পর্কের বিস্তারিত বিবরণ পাই। ভারতীয় লেখক আর কে নারায়নের দ্য গাইড ও দ্য ইংলিশ টিচার দুটো উপন্যাসে আমরা দুটো ভিন্নধর্মী দাম্পত্য সম্পর্কের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পাই।
প্রসঙ্গে 'কালো বরফ'কে আমরা নিখাদ পারিবারিক উপন্যাসে আখ্যায়িত করতে পারি। উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র আবদুল খালেক যার ছোটবেলার নাম পোকা, তিনি দেশভাগের ফলে স্থানচ্যুত। একটি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিরাজমান ডায়াস্পোরিক টেনশন, স্মৃতিচারণ এবং স্থানচ্যুত হওয়ার যে বেদনা তাদেরকে দগ্ধ করে আমরা তার সাথে কিছুটা পরিচিত হই।
আত্মজৈবনিক ঢংয়ে লেখক স্মৃতিচারণ করেন উপন্যাসের এক পরতে, অন্য পরতে একজন পরিণত আবদুল খালেক, যিনি একজন কলেজ শিক্ষক, তার পরিবার, দাম্পত্য বাস্তবতা, প্রচলিত সামাজিক বাস্তবতায় একজন বেসরকারি কলেজ অধ্যাপকের জীবন বাস্তবতা।
প্রথমে উল্লেখিত উপন্যাসগুলোতে আমরা দেখতে পাই পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে দু'জন ব্যক্তির যে একটা জায়গায় পারস্পরিক বোঝাপড়া দরকার সে দিকটাতে বড় রকমের শূন্যতার সন্ধান পাই। রেখা মামার বাড়িতে বড় হয়েছেন। জীবন সম্পর্কে তার ধ্যানধারণার সাথে আবদুল খালেকের মিল কম। রেখা জীবনকে উপভোগ করতে চান তার দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু খালেকের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা এমারসনের "সেলফ রেলায়েন্ট ম্যান" মতো। খালেককে আমরা বলতে শুনি, "আমি যতটুকু, ঠিক ততটুকুই। নিজেকে এর বেশি মনে করতে গেলেই গোলমাল বাধে।" খালেকের এই কথা আমাদেরকে মার্কিন দার্শনিক এমারসনের সেই উক্তিটা স্মরণ করিয়ে দেয় " What is good in your private heart, can be good for others."
আপাতদৃষ্টিতে রেখাকে আমরা একজন অসুখী মানুষ হিসেবে পাই উপন্যাসে। জীবন নিয়ে তার অভিযোগ বিস্তর। তাঁর শিক্ষক স্বামীর আর্থিক অসচ্ছলতা তাকে পীড়া দেয়। তবে এই অসচ্ছলতার পেছনে খালেকের দায় কতটুকু সেটা তিনি বুঝতে ব্যর্থ বা আমরা তাকে বুঝতে চেষ্টা করতে দেখি না। জীবন নিয়ে খালেক সাহেবের যে উপলব্ধি যে গভীর জীবন দর্শনের পরিচয় দেয়। খালেক রেখাকে বলছেন, "জীবনকে পাহাড় মনে করলে পাহাড়, তুলো মনে করলে তুলো। যে যেভাবে নেয়। কোনো না কোনোভাবে জীবন চলেই, কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে না। "দারিদ্র্য সৃজনশীল ও সংবেদনশীল মানুষকে অনেকসময় সংসারজীবন সম্পর্কে উদাসীন ও বিমুখ করে। কাছের মানুষের কাছে জীবনানন্দ দাশ ও নজরুলের লেখা চিঠিগুলো পড়লে আমরা সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাই। খালেক দারিদ্র্যের ভারে নুয়ে পড়া একজন ক্লান্ত ব্যক্তি। কিন্তু, রেখার কাছে তিনি একজন পলায়নপর প্রেমিক। তাই তিনি তাঁদের পারিবারিক বন্ধু নরহরি ডাক্তারের কাছে অভিযোগ করেন খালেক হয়তো অন্য নারীর প্রেমে পড়েছেন।
দারিদ্র্য বিষয়ে হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, 'একজন দরিদ্র মানুষ নিজ দেশে পরবাসীর মতো।' বইয়ের আবদুল খালেক, সারাক্ষণ অস্তিত্বের সংকটে তটস্থ থাকেন, তাঁকে আমরা 'নিজদেশে পরবাসীর' রূপে দেখতে পাই। রেখা যখন আবদুল খালেককে সন্দেহ করতে শুরু করেন তখনই তাদের পারিবারিক বন্ধু নরহরি ডাক্তারের উদ্যোগে তারা দিনব্যাপী বেড়াতে বের হওয়ার সুযোগ পান। জগত সংসারের যাবতীয় বেদনা ভুলে রেখা আর খালেক নিজেদেরকে কাছে পান। এতেই ঘুচে যায় রেখার যাবতীয় আক্ষেপ, তাঁদের সংসারের মরা নদীতে নতুন ক'রে জোয়ার আসে ভালোবাসার; অনেকটা সেই গানের মতো, 'ভালোবাসা তোমার ঘরে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসুক।' তাদের ইচ্ছেগুলো গানের কথার মতো জ্যান্ত হয়ে সংসারের বুকে তুমুল নাচ শুরু করেছে।
সংসার ধর্মের একটা আলাদা রূপ আছে। বিশেষত দাম্পত্যে। এখানে সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না থাকবেই। তবে দু'জন ব্যক্তি যখন পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসেন, সেটা অবশ্যই রুচিতে, চাওয়া ও জীবন দর্শনে, তখন তাদের জীবনে ইংরেজ কবি জন ডানের সেই উক্তি প্রতিফলিত হয়, If our two loves be one, or, thou and I/ Love so alike, that none do slacken, none can die."
সংসার বিষয়ে খালেকের দর্শন আমাদের মাঝে জীবনমুখী চিন্তার উদ্রেক করে। উপন্যাসে খালেকের মুখে শুনতে পাই, "কেউ একজন সংসার করে, তখন সে তার মানে খুঁজতে যায় না। মানে খুঁজতে গেলে বিপদ। বুকে হেটে, গড়িয়ে গড়িয়ে, ডিগবাজি খেয়ে তাকে চালিয়ে যেতে হয়। মাহমুদুল হকের রেখা ও আবদুল খালেক আখেরে পেরে উঠলেও লরেন্সের মোরেল দম্পতি, লেসিংয়ের টার্নার দম্পতি এবং আর কে নারায়ণের রোজি-মার্কো সেটা পেরে ওঠেন না।
দাম্পত্য বিষয়ে লেবাননের বিখ্যাত কবি খলিল জিবরান তাঁর "দ্য প্রফেট"- এ বলেছেন, "তোমরা একসাথে জন্মেছিলে বাঁচবেও একসাথে আজীবন।/ যমদূত এসে ঘাড় চেপে ধরার আগমুহূর্তেও তোমরা একসাথে থাকবে। /হ্যাঁ, তোমরা খোদার রহমতে একসাথে থাকবে। /কিন্তু, দুজনের পথচলায় একটা ব্যবধান রাখবে।/এবং দুজনের মাঝে স্বর্গের বাতাস বইতে দিবে।"
আমাদের নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড়ো সংকট হলো দাম্পত্য-কলহ। প্রতিনিয়ত পারিবারিক কলহ ও বিচ্ছেদের খবর শুনতে পাই। এর ভেতর কালো বরফ উপন্যাসের চরিত্রদের জীবনে যাবতীয় সন্দেহ, অভিমান ও গ্লানি ছাড়িয়ে সুখের প্রত্যাবর্তন নতুন করে উদ্বুদ্ধ করে আমাদের। কারণ বিবাহিত জীবন তো অনেকটা উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের সেই সংক্ষিপ্ত কবিতা "বিয়ে" এর মতো যেখানে কবি বলেছেন, " বিয়ে, অমিল অনেক, এক পুরুষ /ও এক নারী:/বহতা নদী এক/বেয়ে পড়ে এক মাঠে।"
ইংরেজ দার্শনিক স্যামুয়েল জনসনের একটা উক্তি স্মরণ করে আমরা কালো বরফ সম্পর্কে পাঠ প্রতিক্রিয়ার ইতি টানব। বই পড়া বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, "A book should either help us to enjoy life or endure it." মাহমুদুল হকের কালো বরফ আমাদেরকে দুটোরই সন্ধান দেয়। রেখা- খালেক দম্পতির দাম্পত্য সুখ ফিরে আসায় আমরাও সুখী হই, আবার জীবনকে সহ্য করে টেনে নিয়ে যাওয়ার দীক্ষাও পাই।
Comments