কবি-সাহিত্যিকদের ভোটের লড়াই
প্রকৃত সাহিত্যিকরা সমাজে সম্মানীয় সব সময়। কারণ সমাজের দুঃখ-দুর্দশা, আনন্দ-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের রচনায়। এদিক বিবেচনায় তারা জাতির প্রতিনিধি। কিন্তু এই প্রতিনিধিত্ব আর রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে প্রতিনিধিত্বের মধ্যে ব্যবধান অনেক। নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যবধান ভাঙতে চেষ্টা করেছেন বাংলার বেশ কিছু কবি-সাহিত্যিক।
সহজভাবে বললে, সমাজকে এগিয়ে নিতে লেখালেখির পাশাপাশি ৮ কবি-সাহিত্যিক অংশ নিয়েছেন জাতীয় নির্বাচনে। তাদের নিয়ে সংক্ষেপে এই নিবন্ধ।
মোহাম্মদ আকরম খাঁ
বাংলার সাংবাদিকতার ইতিহাসে কিংবদন্তি সম্পাদক মাওলানা আকরম খাঁ পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেছেন মুসলিম লীগের ব্যানারে। তিনি ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন সাধারণ নির্বাচনে। নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন এবং হয়েছিলেন প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।
এইছাড়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি যথারীতি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৭ সালে তিনি ঘোষণা দিয়ে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খাঁর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তার কণ্ঠ। ১৯৬৮ সালে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত সমাজকে এগিয়ে নিতে পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম
১৯২৬ সালে ঢাকা বিভাগ (বর্তমান ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ নিয়ে গঠিত) থেকে কেন্দ্রীয় আইনসভায় দুইজন মুসলমান প্রতিনিধির জন্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল নমিনেশন পেয়েছিলেন কংগ্রেস থেকে। নমিনেশন সংগ্রহের পর তিনি ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে 'তিন শ' কয়েক টাকা' পেলেন নির্বাচনে খরচ করার জন্য। কবি জোটবদ্ধ হয়েছিলেন ঢাকার নবাব বাড়ির শাহজাদা খাজা আবদুল করীমের সাথে ; তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন বরিশালের জমিদার মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী এবং আবদুল হালিম গজনবী। কবি নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ঢাকার বেচারাম দেউড়ির ৫২ নং বাড়ি পীর সৈয়দ শাহ মোহাম্মদ ইউসুফ কাদেরীর আস্তানায় বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন। পীর সাহেবের বড় ছেলে সৈয়দ হুসেনুর রহমান কবির থাকা-খাওয়ার তদারকি করতেন। নির্বাচনের ব্যাপারে কবির আত্মবিশ্বাস ছিল আকাশচুম্বী।
জসীম উদ্দীনের নিকট কবি বলেছিলেন: "জসীম, তুমি ভেবো না। নিশ্চয়ই সবাই আমাকে ভোট দেবে। ঢাকায় আমি শতকরা নিরানব্বইটি ভোট পাব। তোমাদের ফরিদপুরের ভোট যদি আমি কিছু পাই তাহলেই কেল্লাফতে। নির্বাচিত আমি তো হবই, নির্বাচিত হলে মাঝে মাঝে আমাকে দিল্লি যেতে হবে। তখন তোমরা কেউ কেউ আমার সঙ্গে যাবে।" কিন্তু নির্বাচনের প্রথম দিনশেষে ভোটের মাঠে নিজের দুর্দশা বিবেচনা করে কবি জসীম উদ্দীনকে বললেন: "দেখ জসীম, ভেবে দেখেছি, এই ভোটযুদ্ধে আমার জয় হবে না। আমি ঢাকা চলে যাই। দেখি, অন্ততপক্ষে জামানতের টাকাটা যাতে মারা না যায়।" কিন্তু ঢাকায় গিয়েও কবি জামানতের টাকাটা বাঁচাতে পারেননি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন এবং কবির জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। মাত্র ১০৬২টি ভোট পেয়ে পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে কবি হয়েছিলেন চতুর্থ। উল্লেখ্য যে, তখন ঢাকায় মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ১৮,১১৬ জন। তখন সবাই চাইলেই ভোট দিতে পারতো না, সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটার তালিকা করা হতো।
ইবরাহীম খাঁ
প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ ১৯৩৭ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর-গোপালপুর কেন্দ্র থেকে প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি কৃষক-প্রজা পার্টি থেকে নমিনেশনের আবেদন করেছিলেন কিন্তু তাকে নমিনেশন দেওয়া হয়নি, যে কারণে তিনি বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগের নমিনেশনে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর ব্যক্তিগত সুনাম এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ'র প্রচারণার পরও তিনি বিজয়ী হতে পারেননি; কৃষক-প্রজা পার্টির মনোনীত ধনবাড়ীর নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলীর কাছে পরাজিত হলেন।
আবুল কালাম শামসুদ্দীন
আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর জবানে শুনি: "এ-নির্বাচনে লীগ-মনোনীত প্রার্থী হিসাবে আমাকেও দাঁড়াতে হয়েছিল এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বঙ্গীয় আইন সভার সদস্যও আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম।" পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য পদ গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি ছোঁড়ার ঘটনার প্রতিবাদে আইনসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
দ্বিতীয়বারও তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে, ১৯৫৪ সালে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবুল মনসুর আহমদ। সে-বার সারা বাংলার মতো ময়মনসিংহে তাঁর আসনেও মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছিল। আবুল মনসুর আহমদের কাছে এত অধিক ভোটে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন যে, তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। আবুল মনসুর আহমদের সাক্ষ্য: "ভোটার ও জনগণের এই মতিগতি দেখিয়া আমরা উভয়েই বুঝিলাম, শামসুদ্দীন সাহেবের জামিন বাযেয়াফত হইয়া যাইতেছে। উভয়ে আমরা তাঁর জামিনের টাকা বাঁচাইবার চেষ্টা করিলাম। উভয়ে এক গাড়িতে উঠিলাম। ভোটার ও ওয়ার্কারদের বুঝাইলাম। কিছু ভোট শামসুদ্দীন সাহেবকে দিয়া তার জামিনের টাকা বাঁচানো দরকার। শামসুদ্দীন সাহেবের টাকা ত আমাদেরই টাকা। শামসুদ্দীন সাহেবের টাকা বাঁচাইতে কারও আপত্তি ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হইল, মুসলিম লীগকে ভোট দিতে হয় যে। ও-কাজ করিতে ত কেউ রাযি না। কাজেই শামসুদ্দীন সাহেবের জামিন বাযেয়াফত হইল।"
আবুল মনসুর আহমদ
আবুল মনসুর আহমদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি নিজ এলাকা ময়মনসিংহ থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুসলিম লীগের মনোনীত আবুল কালাম শামসুদ্দীন। মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার, তন্মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ একাই পেয়েছিলেন ২৯,৪০০। এই নির্বাচনে বিজয় অর্জনের পর আবুল মনসুর আহমদ ফজলুল হক মন্ত্রীসভার স্বাস্থ্য মন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর তিনি কারারুদ্ধ হন এবং ১৯৬২ সালে মুক্তি পান। পূর্ববাংলার মঙ্গলের জন্য তিনি নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, বিশেষ করে শিল্পায়নে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) এর প্রতিষ্ঠাতা-নেতা ছিলেন। ১৯৫৩-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগ এর সহ-সভাপতি ছিলেন।
হবীবুল্লাহ বাহার
হবীবুল্লাহ বাহার ১৯৪৬ সালে ফেনী মহকুমা থেকে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয় অর্জন করেন। আবু জাফর শামসুদ্দীন লিখেছেন: "সে-সময় তিনি বাংলাদেশের বহু জায়গায় বক্তৃতা দেন। নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিপুল সাফল্যের মূলে হবীবুল্লাহ বাহারের অনলস ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের পর বাহার পোর্ট হজ কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঐ পদে বহাল ছিলেন।"
ফেনীতে তার নির্বাচনী এলাকায় তার সাফল্য সম্পর্কে ধারণা করা যায় রাজনীতিবিদ আবদুস্ সালামের সাক্ষ্য থেকে: "বাহার যে নির্বাচনকেন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব করতেন, ১৯৫৪ সালে আমি যখন সেই নির্বাচন কেন্দ্রে প্রার্থী হলাম, দেখতে পেলাম, লোকে তখনো তাঁর কথা বলছে। তারা, বাহার তাদের জন্য যতটা করেছেন আমিও ততটা করবো কিনা, আমার কাছে জানতে চেয়েছিলো।"
শাহেদ আলী
অধ্যাপক শাহেদ আলী ১৯৫৪ সালে সিলেট-১ (ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ নিয়ে গঠিত আসন) আসন থেকে খেলাফতে রব্বানী পার্টির নমিনেশনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তখন তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি অধ্যাপনা থেকে পদত্যাগ করে সিলেটে গিয়ে নমিনেশন পেপার দাখিল করেন।
১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের একাধিপত্যের মধ্যেও খেলাফতে রব্বানী পার্টির নমিনেশনে শাহেদ আলী জয়ী হয়েছিলেন। স্মৃতিকথায় লিখেছেন এ সম্পর্কে: "জয়শ্রী থেকে গেলাম সুনামগঞ্জ। ভোট কাউন্টিং হবে। এসডিও আবদুল আজিজ সাহেব রিটার্নিং অফিসার। ভোট গণনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চেহারার একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। তিনি আশা করতে পারেননি যে নির্বাচনে মুসলিম লীগ হেরে যেতে পারে। তারপর যখন ভোট গণনা শেষ হলো তখন তিনি ইজি চেয়ারে কাত হয়ে শুয়ে গেলেন। তিনি আশাও করতে পারেননি যে আমি অপরিচিত একজন লোক হয়ে এত ভোট পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হব। আমার যে গুটিকয়েক সাপোর্টার সেখানে উপস্থিত ছিল তারা কোর্ট-প্রাঙ্গণে ধ্বনি তুলল, 'রব্বানী পার্টি জিন্দাবাদ, অধ্যাপক শাহেদ আলী জিন্দাবাদ।"
নির্মলেন্দু গুণ
কবি নির্মলেন্দু গুণ ১৯৯১ সালে নেত্রকোনা-বারহাট্টা আসন থেকে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চেয়েছিলেন কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত না হওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচনে অংশ নেন। কবির মার্কা ছিল কুমীর। এই মার্কার ব্যাপারে কবিকে প্রশ্ন করা হয় এবং কবি উত্তর দিয়েছিলেন: "আমি নিজে অত্যন্ত নিরীহ মানুষ। তার উপর স্বতন্ত্র। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা আমাকে করুণার দৃষ্টিতে দেখুক এমন কোনো নিরীহ প্রতীক বেছে নেয়াটা বোকামি হবে ভেবেই আমি এই প্রতীক বেছে নিয়েছি। আপনারা সবাই জানেন যে কুমির সমীহ আদায় করার মতো প্রাণী। জলের রাজা এবং প্রয়োজনে স্থলেও উঠে আসতে পারে।"
এ ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন: "ঢাকা থেকে কুমির আঁকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নেত্রকোনা নিয়ে সেই কুমিরের ছবি টানানো হলো। এলাকাবাসী বলতে শুরু করলো, ঢাকার কুমির নেত্রকোনা আসতে আসতে টিকটিকি হয়ে গেছে।" নির্বাচনে তিনি ১২৪৯টি ভোট পেয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
এছাড়াও, ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য 'জমিয়ত-এ-উলামা'র পক্ষ থেকে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-কে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি।
নির্বাচন এক আজব ব্যাপার। পুরো বাংলার মুসলমান সমাজের মধ্যমণি হয়েও নজরুলের জামানত বাজেয়াপ্ত হয় আবার একেবারে অপরিচিত শাহেদ আলী বিপুল ভোটে ধরাশায়ী করেন মুসলিম লীগ ও যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের। আবার দেখা যাচ্ছে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ব্যক্তিগত সুনাম ও সাফল্য দলীয় প্রতিকূলতার কারণে ম্লান হয়ে গেছে। বলা যায়, নির্বাচন এমন এক জাল যেখানে কখন কোন্ রুই-কাতলা আঁটকে যায় আর পুঁটি মাছ নিপুণ কায়দায় বেরিয়ে যায়, বলা মুশকিল!
Comments