বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলায় জয়ী হয়েছেন যারা

কখনো কখনো শিক্ষকদের ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন হয়ে যায় বিতর্কিত। শক্ত প্রশাসন‌ও হয়ে যায় দুর্বল।

দেশ এগিয়েছে অনেক, উন্নতির শিখরে চারপাশ। কিন্তু মিনি রাষ্ট্র তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দুর্বলতা কিংবা উপাচার্যের নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র শত বছর আগে যা ছিল এখনও তাই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যত ক্ষমতাবান হোক না কেন, একজন উপাচার্য যত কঠোর হোন না কেন নৈতিকতার প্রশ্নে যেকোনো শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারেন, এমন দৃষ্টান্ত খুঁজতে ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলে যেতে হবে না, খোদ বাংলাদেশে মেলে অনেক দৃষ্টান্ত।

ব্রিটিশ আমলে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নৈতিকতার কাছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পরাজয়, পাকিস্তান আমলে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরাজয় এবং ডক্টর আবু মাহমুদের কাছে তৎকালীন উপাচার্যের পরাজয়ের সাথে এক‌ই সূত্রে গাঁথা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিষ্কারাদেশ স্থগিত ঘোষণা করে শিক্ষার্থীর পক্ষে থাকা হাইকোর্টের রুল।

আরও একটু পরিষ্কার করে বললে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অবস্থান বেশ আলোচিত। তিনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পড়তে গিয়েছিলেন তখন হিন্দু পণ্ডিতরা একজন মুসলমান ছেলেকে বেদ পড়াতে অস্বীকার করেন। অনেক বলে কয়েও রাজি করানো যায়নি তাদের। ফলে তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে তুলনামূলক শব্দতত্ত্ব নামে নতুন একটি বিভাগ খুলতে হয়। যে বিভাগের ছাত্র হিসেবে উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। দেখা যাচ্ছে, কখনো কখনো শিক্ষকদের ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন হয়ে যায় বিতর্কিত। শক্ত প্রশাসন‌ও হয়ে যায় দুর্বল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে প্রশাসনকে ভুল প্রমাণ করার নজির পাওয়া যায় পাকিস্তান আমলেও। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব সরকার আইন প্রণয়ন করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তখন এই আইনের বিরুদ্ধে মামলা করলেন। তার আর্গুমেন্ট ছিল, তিনি চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক। যখন চুক্তি হয় তখন এমন কোনো আইন চুক্তির আওতায় ছিল না এবং চুক্তির পরবর্তীতে কোনো আইন প্রণয়ন হলে তা তিনি মানতে বাধ্য নন।  

তিনি বলেন : "এনি লেইটার এডিশন অব এনি কন্ডিশন ইজ নট এ্যপ্লিকেবল টু মি। পরবর্তীকালে কোনো নতুন শর্ত যোগ করা হলে আমার উপরে তা প্রযুক্ত হতে পারে না। ওটা ক্লিয়ার ছিলো।"‌ তার এই আর্গুমেন্টের পক্ষে আদালতে ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী একে ব্রোহী এবং জুনিয়র ছিলেন ডক্টর কামাল হোসেন। বিচারপতি সাত্তারের অধীনে সেই মামলার রায় গিয়েছিলো অধ্যাপক রাজ্জাকের পক্ষে। বিস্তারিত আবদুর রাজ্জাকের জবানে: "জিতলাম খুব ন্যারো গ্রাউন্ডে। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় আইনকে সরকার যেভাবে এ্যামেন্ড করেছিলো তার ড্রাফটিং ওয়াজ ভেরি পুওর।

সংশোধনীর একটা কথা ছিলো : অল কন্ট্রাক্টস উইল রিমেইন আনচেইঞ্জড। কোনো চুক্তির পরিবর্তন হবে না। চুক্তি বলতে সরকার খুব সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক চুক্তি ইত্যাদি বুঝাতে চেয়েছিলো। একজন শিক্ষকের চাকরিও যে আগে চুক্তির ভিত্তিতে হতো, দিস হ্যাড নট এনটারড দেয়ার হেড। সুতরাং ব্রোহী সাহেব বড় বড় যে আর্গুমেন্ট দিলেন মৌলিক অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কে সাত্তার সাহেব সেগুলো ইগনোর করে বললেন : ইট ইজ নট নেসেসারি টু গো ইনটু দোজ আরগুমেন্টস। তিনি বললেন, কেবল এই ভিত্তিতেই সংশোধনী আমার উপর এপ্লিকেবল নয়, কারণ দি ল্যাংগুয়েজ ইন হুইচ দি এ্যামেন্ডমেন্ট হ্যাস বিন এনাকটেড এক্সক্লুডস অল কন্ট্রাকটস ফ্রম ইটস এ্যাপ্লিক্যাবিলিটি। উনি আর বিষয়ের গুণাগুণের ভেতরে যেতে রাজি হ‌ইলেন না।"

সেখানেই শেষ নয়, দুয়েক বছরের মধ্যে আবারও আদালতের শরণাপন্ন হতে হলো আবদুর রাজ্জাককে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৎকালীন প্রধান ডক্টর আজিজ ডিপার্টমেন্টে এক্সট্রা ক্লাস নিতে বলায় তিনি বলেছিলেন "আমি আর ক্লাস নিতে পারুম না"। ডক্টর আজিজ লিখিত চিঠি দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় তাকে শোকজ করে এই নোটিশে— Why you should not be removed?

নোটিশটি পাওয়ার পর তিনি আইনজীবী ব্রোহীকে দেখালেন এবং ব্রোহী একটা জবাব লিখে দিলেন। জবাব পাঠালেন কর্তৃপক্ষের কাছে। কর্তৃপক্ষ পুনরায় শোকজ করলো নোটিশে— why you should not be dismissed? বাকিটা আবদুর রাজ্জাকের জবানেই শোনা যাক: "যেদিন আমাকে বলা হলো আইদার টু এ্যাপিয়ার অর টু ফেইস একসপার্টি ডিসিশন, সেদিন আমি হাইকোর্টে রিট করলাম।" এই মামলার রায় সম্পর্কে শুনি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কণ্ঠে: "মামলা চললো। একটা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যক্তির লড়াই করা সহজ নয়। সুতরাং আপস-নিষ্পত্তির কথা উঠল। ঠিক হলো, রাজ্জাক সাহেব পদত্যাগ করবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ তাঁর সকল পাওনা মিটিয়ে দেবেন। কামাল ব্যবস্থা করে দিলেন, অক্সফোর্ডের বেলিয়ল কলেজে সার্ এক বছর থাকবেন, তারপর দেখা যাবে। রাজ্জাক সাহেব তাঁর প্রাপ্য টাকাপয়সা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব আমাকে প্রদান করে, দশ-বারোটা ব্ল্যাংক চেক স‌ই করে, বিলি-ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়ে, এক সন্ধ্যায় বিলেত র‌ওনা হলেন।" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ক্ষমতাবান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একাই আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন, ঝামেলা এড়াতে পদত্যাগ পর্যন্ত করেছেন তবুও কর্তৃপক্ষের সামনে মাথা নিচু করেননি রাজ্জাক। নৈতিকতার বলে বলীয়ান এমন সাহসী কাজ করা যায়!

শুধু রাজ্জাক সাহেব নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তার ছাত্র ডক্টর আবু মাহমুদ‌ও। উপাচার্য এম ওসমান গনির আমলে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ডক্টর এম এন হুদা লম্বা ছুটিতে যান। পরবর্তী প্রধান হিসেবে যোগ্যতা ও সিনিওরিটির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন ডক্টর আবু মাহমুদ‌। কিন্তু মতাদর্শের দিক থেকে উপাচার্যের সাথে মিল না থাকায় উপাচার্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক পদের জন্য আবেদন করতে বলেন তার‌ই ছাত্র ডক্টর আনিসুর রহমানকে। আনিসুর রহমান উপাচার্যের প্রস্তাব নাকচ করলে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তারপর বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ডক্টর কে টি হোসেনকে। এই অযৌক্তিক নিয়োগের পর ডক্টর মাহমুদ হাইকোর্টে উপাচার্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন। হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি সৈয়দ মুর্শেদ, ডক্টর আবু মাহমুদের পক্ষে ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক রায়। যে রায়ে শোচনীয় পরাজয় ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে পাকিস্তান আমলের সেই রেশ কাটেনি এখনো। চলতি বছরের ২ আগস্ট কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইকবাল মনোয়ারকে 'সাময়িকভাবে বহিষ্কার' করে কর্তৃপক্ষ। কারণ, তিনি উপাচার্যের বক্তব্য তার পাঠানো প্রতিবেদনে হুবহু তুলে ধরেছেন যা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে 'উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে' তথ্য প্রচার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার' ঘটনা হিসেবে ধরা হয়। এই ঘটনায় হাইকোর্টে রিট করেন। ৯ আগস্ট উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্ট ৮জনকে হাইকোর্টের পক্ষ থেকে আইনী নোটিশ পাঠানো হয়। ১৪ আগস্ট বিচারপতি ভিস্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার বেঞ্চ ইকবাল মনোয়ারের উপর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিষ্কারাদেশ ৬ মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা দেন। এতে প্রতীয়মান হয়, যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন গঠিত হলেও নৈতিকতার প্রশ্নে একজন শিক্ষার্থীর সামনে উতরে যেতে পারেনি।

বহুল আলোচিত টিভি উপস্থাপিকা ও শিক্ষক সামিয়া রহমান যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় অর্জন করেছেন সেটিও অনেকের মনে থাকার কথা। হাইকোর্ট স্পষ্ট জানায়: "সামিয়া রহমানের পদাবনতির আদেশ অবৈধ"। এই ঘোষণা কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের মুখে চুনকালি নয়?

সামিয়া রহমানের মতো এক‌ই অভিযোগ এনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাসির উদ্দিন আহমদকে অপসারণ করা হয়েছিল ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল। তিনি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন এবং হাইকোর্ট চলতি বছরের ১৭ আগস্ট তার অপসারণের নির্দেশকে অবৈধ ঘোষণা করে। তিনি আবার ফিরে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুল হক নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ৭ বছর আইনি লড়াই করে ২০১৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে শিক্ষক হিসেবে বিভাগে যোগদান করেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখি এক‌ই দশা। ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবিকে সমর্থন করায় ৩জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। তারা হাইকোর্টে রিট করলে ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট তাদের বহিষ্কারাদেশ স্থগিত করার নির্দেশ দেয় এবং রুল জারি করে জানতে চাওয়া হয়, কেন তাদের অপসারণের সিদ্ধান্ত অবৈধ হবে না। 

ঢাবির অধ্যাপক রহমত উল্লাহ ভুলবশত খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর কারণে তাকে সকল প্রকার একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু তিনি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন এবং হাইকোর্ট তাঁর একাডেমিক কার্যক্রম অব্যাহতির সিদ্ধান্তকে বাতিল বলে ঘোষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আপিল করলে গত ২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট অধ্যাপক রহমত উল্লাহর পক্ষে শুনানি বহাল রাখে। অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৬৭-৬৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন জিল হোসেন। ১৯৭৩ সালে উনি অনার্সে একটি বিষয়ে ফেল করেন শিক্ষকদের গাফিলতির কারণে। অনেক হিসাবের পর বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেন। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে রায় আসে তার পক্ষেও।

এমনভাবে ঘটনা অনেক আছে। কিন্তু সারাংশ হচ্ছে, নৈতিকভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে। রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ ক্ষমতা নিয়েও নৈতিকতার প্রশ্নে ছাত্র কিংবা শিক্ষকের কাছে বারবার মুখ থুবড়ে পড়তে হচ্ছে। প্রশাসন ভুলে যান, নৈতিকতার কাছে ক্ষমতা তুচ্ছ। এইভাবে নীতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেরাই কেবল নিজস্বতা হারাচ্ছে না, বরং একটি প্রজন্মকে শেষ করে দিচ্ছে এবং ভেঙ্গে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ডও।

Comments

The Daily Star  | English

Upazila Polls: AL, BNP struggle to keep a grip on grassroots

The upazila election has exposed how neither of the two major parties, the Awami League and BNP, has full control over the grassroots leaders.

5h ago