জীবন ও সাহিত্যের নিখুঁত রূপকার সৈয়দ মুজতবা আলী

সৈয়দ মুজতবা আলী। ছবি: সংগৃহীত

সেদিন ছিল সরস্বতী পূজা। গোসল ও হাঁটার জন্য গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ঘড়িতে তখন দুপুর ১২টা। হঠাৎই এক নারী তার ছোট্ট নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে মুজতবা আলীর সামনে এসে অনুনয়ের কণ্ঠে বললেন, 'বাবা, আমার বাড়ির পূজাটা করে দাও না, পুরোহিত এখনও আসেননি। আমি পুরোহিতকে খুঁজতে বের হয়েছি। বাচ্চাটা না খেয়ে অঞ্জলি দেবে বলে বসে আছে।'

মুজতবা আলী প্রথমে হেলা করলেও পরক্ষণেই আকুল আবেদন উপেক্ষা করতে না পেরে গেলেন তাদের বাড়ি। গিয়ে দেখলেন পূজার যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন, কেবল অনুপস্থিত পুরোহিত। তখন বিশুদ্ধ সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণে সরস্বতী পূজার যাবতীয় নিয়মনীতি সারলেন মুজতবা আলী। বাড়ির লোকজন ভীষণ খুশি মনেই আপ্যায়ন করলেন তাকে। শেষমেশ দক্ষিণা নিয়ে বিদায় হলেন তিনি। পূজার আচারকানুন দেখে কেউ বুঝতেই পারল না, মানুষটি ভিন্ন ধর্মের।

পরে সৈয়দ মুজতবা আলী সেই স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন, 'জানি না মা সরস্বতী এই বিধর্মীর পুজোয় অসন্তুষ্ট হলেন কি না? তবে আশা করি তিনি উপোসী বাচ্চাটির শুকনো মুখের দিকে চেয়ে এই অধমকে ক্ষমা করবেন।'

সৈয়দ মুজতবা আলীর মনন আর চিন্তাশীলতা ছিল এমনই মানবদরদী।

তিনি চিরকালই ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। শান্তিনিকেতনের প্রথম দিকের শিক্ষার্থী ছিলেন মুজতবা আলী। সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয়সহ মোট ১৫টি ভাষা জানা সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন অসম্ভব মেধাবী।

বিশ্বভারতী থেকে স্নাতক শেষে আফগানিস্তানের কাবুল কৃষিবিজ্ঞান কলেজে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার প্রভাষক হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন তিনি। কলকাতা থেকে কাবুল যাওয়ার পথের যাত্রা নিয়েই পরে লিখেছিলেন সুবিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী 'দেশে বিদেশে'। যেখানে আমরা দেখতে পাই অত্যন্ত সূক্ষ্ম রসবোধের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনা এবং আফগানিস্তানের আর্থসামাজিক অবস্থার পটপরিবর্তনসহ নানা বিষয়।

শান্তিনিকেতনে সপরিবারে সৈয়দ মুজতবা আলী। ছবি: সংগৃহীত

মুজতবা আলী যখন কাবুল ছিলেন, তখনই আফগানিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে বাচ্চায়ে সাকোর আক্রমণ। এর মধ্য দিয়েই ভ্রমণকাহিনী 'দেশে বিদেশে' শেষ করেছিলেন তিনি। দেশভাগের ১ বছর পরে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া 'দেশে বিদেশে' গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। সেখানেও ছিল নানান ঝক্কি, যা নিয়ে প্রথম প্রকাশকের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধও হয়েছিল মুজতবা আলীর।

বিষয়টি গড়িয়েছিল আদালতেও। এ অবস্থায় উকিলের প্রয়োজন পড়লে মুজতবা আলী ব্যারিস্টার তাপসকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে বললেন, 'ভাই, আমার এমন একজন কৌঁসুলি চাই, যে কি না আমার এই মামলাটায় আমায় হারিয়ে দেবে।'

তাপসকুমার মুজতবা আলীর রসটা ধরতে পেরে বললেন, 'আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। আমি এখনও পর্যন্ত একটা মামলাতেও জিতিনি।'

এরইমধ্যে মুজতবা আলী আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিলেন দর্শনশাস্ত্রে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে নিয়েছিলেন ডি.ফিল ডিগ্রি। বছর খানেক পড়েছিলেন কায়রোর বিশ্বখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়েও।

সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর হাতেখড়ি হয়েছিল শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নকালে। এ সময় সত্যপীর, ওমর খৈয়াম, টেকচাঁদ, প্রিয়দর্শীসহ নানা ছদ্মনামে দেশ পত্রিকা, আনন্দবাজার, বসুমতী, সত্যযুগ, মোহাম্মদী পত্রিকায় লিখতেন তিনি।

সৈয়দ মুজতবা আলী। ছবি: সংগৃহীত

অনেকগুলো ভাষা জানায় ভাষাবোধ সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল মুজতবা আলীর। ছিল সূক্ষ্ম রসবোধও। অন্যদিকে শ্লোক ও রূপকের যথার্থ ব্যবহারের কারণে মুজতবা আলীর রচনা হয়ে উঠেছিল অতুলনীয়।

বাংলা সাহিত্যে সরস রচনায় এক নবদিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ওই সময়ে তিনি ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয় লেখক। এরপরও লেখার বিষয়ে তার ছিল ভীষণ অনীহা। তিনি বলতেন, 'হাঁড়িতে ভাত থাকলে সাঁওতাল কাজে যায় না। আর আমার ড্রয়ারে টাকা থাকলে আমি লিখি না!'

১৯৪৭ সালের শেষ দিক থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের মতো সিলেট শহরেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। সিলেটের ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল সিলেটের মুসলিম সাহিত্য সমাজ। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ছিল আল ইসলাহ।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসেই আল ইসলাহর এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'বাংলার পরিবর্তে অন্য কোনো ভাষা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হউক ইহা আমরা কখনো সমর্থন করিতে পারি না।'

মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর, ৩০ নভেম্বর এবং ২৮ ডিসেম্বর সিলেটে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ৩০ নভেম্বর আলোচনায় বক্তব্য দিয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি তখন দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।

বক্তব্যে সৈয়দ মুজতবা আলী রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে যুক্তি ও তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'বাংলায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হবে চরম বোকামি।' অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্রের বয়স তখন ৩ মাসও হয়নি।

বক্তব্যে মুজতবা আলী রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ক্ষুরধার ও শক্তিশালী যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। একইসঙ্গে আরব, পারস্যের মাতৃভাষার উদাহরণ ছাড়াও ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মাতৃভাষার গুরুত্ব ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। মুজতবা আলীর সেই অসামান্য বক্তব্যটি ১৯৪৯ সালে 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।

সৈয়দ মুজতবা আলীর বক্তব্যের ওপর প্রকাশিত গ্রন্থ 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'। ছবি: সংগৃহীত

এ বক্তব্যের জন্য পরে মুজতবা আলীকে প্রচুর হেনস্তার শিকার হতে হয়েছিল। হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল তার পরিবারকেও।

১৯৪৮ সাল। সৈয়দ মুজতবা আলীর বড় ভাই সৈয়দ মুর্তাজা আলী তখন বগুড়ার ম্যাজিস্ট্রেট। সে বছরের ডিসেম্বর মাসে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের বার্ষিক সাহিত্য সম্মিলনীর সভাপতি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সৈয়দ মুজতবা আলীকে।

বগুড়ায় বার্ষিক সাহিত্য সম্মিলনীর সভাপতি হিসেবে বক্তব্য ছাড়াও সেই সফরে বেশ কয়েকটি জ্ঞানগর্ভ ও প্রখর রসবোধসম্পন্ন বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। তার বক্তব্যে মুগ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীরা তাকে বগুড়ায় চলে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে সদ্যই বদলি হয়েছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ছাত্রদের পাশাপাশি বড় ভাইয়ের অনুরোধেও বগুড়ায় চলে আসেন তিনি।

কিন্তু শান্তিনিকেতনের মায়া কখনোই ছাড়তে পারেননি মুজতবা আলী। বরাবরই শান্তিনিকেতনের প্রতি ছিল তার অসীম টান। তাই ১৯৬১ সালে শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে বিশ্বভারতীর ইসলামের ইতিহাস বিভাগে রিডার হিসেবে যোগ দেন।

একবার একদল দর্শনার্থী দেখা করতে এসেছিলেন তার সঙ্গে। তিনি তাদের বলেছিলেন, 'শান্তিনিকেতনে এসেছ কী কী দেখতে? ক্ষিতিমোহনবাবুকে দেখেছ?' তারা বললেন, 'দেখেছি।' 'নন্দলাল বসুকে?' 'হ্যাঁ, দেখেছি।' 'হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে?' 'তাকেও দেখেছি।' তারপর তিনি বললেন, 'ও! বাঘ সিংহ সব দেখে এখন বুঝি খট্টাশটাকে দেখতে এসেছ!'

সাহিত্য তো বটেই, ব্যক্তিজীবনেও প্রচণ্ড রসিক ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। বেশি বয়সে বিয়ে করার কারণে সবসময়ই আক্ষেপ করতেন। বলতেন, 'বেশি বয়সে যে পতিরা বিয়ে করে তারা ভীষণ বউপ্রেমী হয়। আমার অবস্থা হয়েছে তেমনই।'

এক সময় অ্যালসেশিয়ান জাতের কুকুর পুষতেন তিনি। পোষা কুকুরটির নাম দিয়েছিলেন 'মাস্টার'। কারণ তিনি একটু বেশি খেতে শুরু করলেই কুকুরটা চিৎকার জুড়ে দিত। মুজতবা আলী কুকুরটাকে নিয়ে এক লেখায় লিখেছিলেন, 'গত জন্মে এ ব্যাটা নিশ্চয় আমার চাচা ছিল।'

জীবন সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, 'জীবনই অভিজ্ঞতা আর অভিজ্ঞতাই জীবন। অভিজ্ঞতাসমষ্টির নাম জীবন, আর জীবনকে খণ্ড খণ্ড করে দেখলে এক-একটি অভিজ্ঞতা। এক- একটি অভিজ্ঞতা যেন এক এক ফোঁটা চোখের জলের রুদ্রাক্ষ। সব কটা গাঁথা হয়ে যে তসবি-মালা হয় তারই নাম জীবন।'

সৈয়দ মুজতবা আলী আজীবন ছিলেন সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তিনি নিজেকে বলতেন বিশ্ব নাগরিক, যার প্রমাণ তার লেখাতেও উঠে এসেছে।

সৈয়দ মুজতবা আলী সম্পর্কে তার বড় ভাই সৈয়দ মুর্তাজা আলী লিখেছিলেন, 'তার সাহিত্যে বিন্দুমাত্র ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না। কিন্তু তার এই উদারতার জন্য গোড়া স্বধর্মীরা তাকে কোনোদিন ক্ষমা করেননি।'

আজ প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই কিংবদন্তি সাহিত্যিককে।

তথ্যসূত্র:

 মজলিসী মুজতবা/ তাপস ভৌমিক

কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর/ সবিতেন্দ্রনাথ রায়

সৈয়দ মুজতবা আলী: প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ/ গোলাম মোস্তাকীম

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

7h ago