পরিবার ছোট করে আমরা যা হারালাম
আমাদের বাবা-মায়েদের প্রজন্ম কেমন জীবন কাটিয়েছেন আর আমাদের জীবন কেমন হলো, মাঝে মাঝে ভাবি সেসব কথা। শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা বলছি, সব শ্রেণির জীবন নিশ্চয়ই একরকম ছিল না, থাকে না কখনো। জন্মনিয়ন্ত্রণের বালাই ছিল না তখন, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে, কে যে কীভাবে বড় হচ্ছে, খবরই রাখতে পারতেন না মা-বাবারা।
আমরা, ভাইবোনেরা, গল্পগুজব করে, কখনো বা পিঠাপিঠি ভাইবোন মারামারি করে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে, স্কুলে মাস্টারমশাইয়ের কাছে বেতের বাড়ি খেয়ে, নানারকম দস্যিপনা করতে করতে বড় হয়ে উঠতাম। ওসব করলে কী হবে, মা-বাবার সামনে একেবারে সুবোধ বালক-বালিকা। ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানি না। শাসন কি করতেন না তারা? বলাইবাহুল্য, করতেন। শুধু কি মা-বাবা? চাচা-ফুপু-খালা-মামা কারো শাসনের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেত না। সেই তুলনায় চাচি আর মামিরা কী যে মিষ্টি হতেন! এমনকি বড় ভাই বা বোনদেরও একচ্ছত্র অধিকার ছিল ছোটদের শাসন করার। সেখানেই শেষ নয়, পাড়া-মহল্লার অনাত্মীয় চাচা-মামারাও শাসন করতে ছাড়তেন না। আমরা বড় হয়ে উঠতাম এইসব আদরে-শাসনে। হলে হবে কী, তাদের কাছে আমাদের বড় হওয়ার স্বীকৃতি মিলতো না। তুমি পোলাপান মানুষ, তুমি কী বোঝো- এরকম ধমক খেয়েছি চল্লিশোর্ধ্ব বয়সেও!
একান্নবর্তী পরিবার ছিল তখন। মা-বাবা-ভাই-বোন ছাড়াও দাদা-দাদি-চাচা-ফুপু, এমনকি একটু দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়রাও থাকতেন বাসায়। গ্রামের সঙ্গে তখনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি বলে সেখান থেকেও মানুষ আসতেন নানা প্রয়োজনে, থাকতেন বাসাতেই। প্রাইভেসি বলতে যে একটা ব্যাপার আছে, আমাদের তা জানাই ছিল না। ছোট বাসায় গাদাগাদি করে একেক রুমে অনেকজন। প্রতি বেলায় রান্না হতো পনের থেকে কুড়ি জনের। নামেই তো মধ্যবিত্ত, আসলে নিম্নবিত্ত বা বড়জোর নিম্নমধ্যবিত্ত বলা যায়। ফলে টানাটানি লেগেই থাকতো। পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি থাকতেন একজন বা দুজন, তার ওপরেই সকল ভার। মধ্যবিত্ত ইমেজের আড়ালে দাঁড়ানো দারিদ্রের কদর্য মুখটি ঢাকার জন্য কী প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল! শাকপাতা-ভর্তাভাজিটাও এমন সুস্বাদু করে তৈরি করতেন মা-চাচি-ফুপু কিংবা বড় বোনেরা, যে অমৃতের মতো লাগতো। মাছ জুটলেও মাংস জুটতো না সহসা, উৎসব বা উপলক্ষ ছাড়া। তবু এই যূথবদ্ধ জীবনকে অস্বীকার করেননি তারা। বরং পরম মমতায় আগলে রেখেছেন আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলকে, দায়িত্ব নিয়েছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন।
এইসব করতে করতে তারা হয়তো বুঝতেও পারেননি, আমরা বড় হয়ে যাচ্ছি, সময়ও বদলে যাচ্ছে, যুগপরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ এসে হাজির হয়েছে, আমাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তৈরি হচ্ছে,আমরা স্বাধীন হতে চাইছি, প্রাইভেসি চাইছি, একা থাকতে চাইছি। আমরা বড় হচ্ছি, কষ্টেসৃষ্টে পড়াশোনা শেষ করে মধ্যবিত্তের একমাত্র স্বপ্ন 'চাকরি' নামক সোনার হরিণ ধরছি, পরিবারে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন সব ঠিকঠাক, বিরাট পরিবারের কিছু কিছু দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়া, মা-বাবার প্রয়োজন মেটানো, ছোটদের শখ মেটানো চলছে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা চলছে, হয়তো চলছে কোনো প্রেমও। তারপর বিয়ে। নতুন সঙ্গী, নতুন জীবন। মেয়ে হলে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়িতে, ছেলে হলে নতুন বউ আসছে বাসায়। সব ঠিকই তো আছে, না? হ্যাঁ, আছে, সব ঠিক আছে। আপাতভাবে।
আসলে কিছুই ঠিক নেই। বছর কয়েক যেতে না যেতে মায়ের সঙ্গে বনছে না, সদাগম্ভীর বাবার সঙ্গে আগেও খুব একটা কথা হতো না, এখন একেবারেই বন্ধ, এমনকি ভাই-বোনদের সঙ্গেও আর থাকা যাচ্ছে না। এখানে স্বাধীনতা নেই, প্রাইভেসি নেই, সাধ-আহ্লাদ পূরণের সুযোগ নেই। ততদিনে হয়তো একটা বা দুটো ফুটফুটে শিশু এসেছে, তারাও একটু একটু করে বড় হচ্ছে। এতগুলো মানুষের সঙ্গে হেসেখেলে, আনন্দে-আহ্লাদে-আবদারে বড় হচ্ছে, কিন্তু তাদের দুরন্তপনার জন্য একটুও শাসন করা যাচ্ছে না। শাসনের সময় কেউ না কেউ চিলের মতো ছোঁ মেরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আহ্লাদ পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠে যাচ্ছে শিশুটা। এভাবে বাচ্চা মানুষ করা যায়? ওর একটা ভবিষ্যৎ আছে না? এই পরিবেশে থাকলে ও মানুষ হবে কী করে?
অবশ্য 'মানুষ' হওয়া বলতে কী বোঝায় সে সম্বন্ধেও পরিষ্কার ধারণা নেই আমাদের। পড়াশোনায় ভালো করা, তারপর একটা 'ভালো' চাকরি। এই তো? নাকি এরচেয়ে বেশি কিছু আছে? আমাদের কল্পনায় কি কখনো এমন কিছু ছিল যে, আমাদের সন্তানেরা হবে এমন কীর্তিমান মানুষ যে পৃথিবীজুড়ে, কিংবা নিদেনপক্ষে দেশজুড়ে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়বে? কেবল নিজের জন্য বাঁচবে না তারা, নিজেকে ছড়িয়ে দেবে আরো বহু মানুষের কল্যাণে, তাদের হাত ধরে উঠে দাঁড়াবে বহু অসহায়-দুর্বল মানুষ? আমরা সন্তানকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছি, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চেয়েছি, আমলা বানাতে চেয়েছি, সামরিক কর্মকর্তা বানাতে চেয়েছি, আইনজীবী বানাতে চেয়েছি, অর্থাৎ সব চাওয়াই পেশাভিত্তিক। কিন্তু এগুলো হলেই কি 'মানুষ' হওয়া যায়? সেজন্যই আমাদের তখন মনেই পড়ছে না, এরকম পরিবেশেই আমরা বড় হয়ে উঠেছি, মানুষ না হলেও অন্তত অমানুষ হইনি। ফলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খিটিমিটি বেড়েছে, বেড়েছে অসহিষ্ণুতা আর মনোমালিন্য। হাসিমুখ আর দেখা যায়নি আমাদের, দেখা গেছে বিরক্তি আর অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখ।
অতএব? আর কি! আলাদা হতে হবে। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে কথাটা তোলা তো সহজ নয়, সুতরাং নানা নাটক সাজাও। পরিবারের সবার কাছে সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হচ্ছে ওই শিশুগুলো, ওদেরকে কথায় কথায় মারধোর করো যেন সবাই কষ্ট পায়। কারণে-অকারণে গলা চড়াও সবার সঙ্গে, সম্পর্কগুলোকে বিষাক্ত করে তোলো, যেন সবাই বুঝে যায়– আমরা আর একসঙ্গে থাকতে চাইছি না। অথবা না বুঝলেও যেন একসময় মাকে গিয়ে বলা যায়, তোমাদের সঙ্গে আর থাকতে পারছি না, আমাকে মাফ করে দিয়ো, ইত্যাদি।
অতঃপর সবাইকে ছেড়ে ছোট্ট একটা বাসায় নতুন এক সংসারের শুরু। নিউক্লিয়াস পরিবার। তুমি-আমি আর ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটো সন্তানই যথেষ্ট। সরকারের সুখী পরিবারের বিজ্ঞাপনের সার্থক মডেল হয়ে ওঠা গেল এতদিনে! নিজেদের সংসার। মনমতো সাজানো যাবে এবার। কারো খবরদারি চলবে না, কারো ভ্রূকূটি দেখতে হবে না। বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করা যাবে বাসায়, আনন্দ-ফূর্তি করা যাবে। শপিংয়ে, সিনেমায়, পার্টিতে যেতে আর বাধা নেই। আনন্দ আর আনন্দ। সবই থাকবে জীবনে, কেবল এড়িয়ে চলতে হবে আত্মীয়স্বজনদের, তা কাছেরই হোক আর দূরেরই হোক। কারণ, আত্মীয়স্বজন মানেই 'ঝামেলা', ওপরে ওঠার পথে এরা একেকটা পিছুটান, আর এইসব ঝামেলা এড়ানোর জন্যই তো নিজেদের একটা সংসার! তাছাড়া, এখনই তো সব কিছু করার বয়স। নিজেদের ক্যারিয়ার, বাচ্চাদের 'মানুষ' করা, টাকা-পয়সা জমিয়ে একটা ফ্ল্যাট, একটা গাড়ি, মাঝেমধ্যে প্লেজার ট্রিপে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, আর সব সাফল্যের গল্প ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া। সাফল্য বা প্রতিষ্ঠা কি একা একা উপভোগ করা যায়? মানুষকে না দেখাতে পারলে ওসব দিয়ে কী হয়? এইসময় আত্মীয়স্বজন নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে কীভাবে?
মাঝেমধ্যে অবশ্য মা-বাবাকে দেখতে যেতে হয়। একটা দায়িত্ব আছে না? মা হয়তো বিষাদমাখা স্বরে বলেন, কতদিন পর তোকে দেখলাম! আমাদের তৈরি উত্তর -- কী করবো বলো মা, এত ব্যস্ত থাকি! বাবা হয়তো নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করেন, সব ভালো? কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? না না কিসের অসুবিধা বাবা? সব ঠিক আছে। কিন্তু একবারও মনে পড়ে না, তাঁদেরকেও জিজ্ঞেস করা দরকার, সব ভালো? সব ঠিকমতো চলছে তো?
ওদিকে ওই যে দুটো শিশু, ওরা বুঝতেই পারছে না, কেন সবাইকে ছেড়ে তাদেরকে চলে আসতে হলো। সারাদিন সারারাত কেবল মা-বাবার চোখের সামনে থাকতে হয়, স্কুলে যাওয়া, প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়া, হোমওয়ার্ক করা, নাচ বা গান শিখতে যাওয়া, আরো কত কাজ তাদের ছোট্ট কাঁধে! একটুও ফাঁকি দেয়ার উপায় নেই। খেলাধূলা বন্ধ, বেড়াতে যাওয়া বন্ধ, কেবল মাঝেমধ্যে টিভি দেখা আর ভিডিও গেমসে ডুবে থাকার অনুমতি আছে। বিষণ্ণ থাকছে ওরা, ভুগছে গোপন কোনো মনেবেদনায়, সেদিকে আমাদের নজরই দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু সেও তো শিশু থাকছে না, বড় হয়ে উঠছে। স্কুল ছাড়িয়ে কলেজ। কলেজ ছাড়ালেই সংবিধানসম্মতভাবে প্রাপ্তবয়স্ক। তারপর? এবার স্বাধীনতা চাই তাদের। না দিয়েও উপায় নেই।
ততদিনে নিজেদের বয়সও বেড়ে গেছে, মধ্যবয়সে এসে মনে হচ্ছে, শরীর-মন আর আগের মতো চলছে না। হয়তো মা-বাবা দুজনেই চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। কিংবা একজন গেছেন, আরেকজন রয়ে গেছেন। ধরা যাক, বাবা চলে গেছেন, মা রয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁরও ভাসমান জীবন। কারণ ছেলেমেয়েরা ততদিনে যার যার মতো সংসার পেতেছে, কারো কাছেই মা'র জন্য স্থায়ী জায়গা হয়নি। দুদিন এই ছেলের বাসায়, দুদিন ওই ছেলের বাসায়, কখনো বা মেয়েদের কাছে গিয়ে থাকছেন। ঠিকানাবিহীন-ভাসমান-অপ্রয়োজনীয়-অচল মানুষ একজন। সবাই নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। নিজের প্রতিষ্ঠা, ক্যারিয়ার,সন্তান বড় করে তোলা, সামাজিকতা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ততার শেষ নেই। মাকে সময় দেয়ার মতো সময় কোথায়?
তারপর? তারপর আরো বয়স বেড়েছে আমাদের, ছেলেমেয়েরা এখন সত্যিই বড় হয়েছে, হয়তো তারা আর দেশেই থাকতে চাইছে না, কিংবা থাকলেও চাইছে আলাদা থাকতে, স্বাধীন থাকতে। ভাগ্য ভালো হলে আমাদের প্রত্যাশামতো 'মানুষ' হয়েছে তারা। আর খারাপ ভাগ্য হলে উচ্ছন্নে গেছে -- কেউ হয়তো নেশায় আসক্ত হয়ে নিজেকে ধ্বংস করেছে, কেউ সন্ত্রাসী হয়েছে, কেউ ঘর ছেড়ে চলে গেছে। এদিকে আমাদের শরীরে নানা অসুখ-বিসুখ বাসা বেঁধেছে। মা-বাবা দুজনেই চিরবিদায় নিয়েছেন, ভাইবোনরা দূরে দূরে, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, বন্ধুবান্ধবরাও আসে না আর। কোথাও যেতেও ইচ্ছে করে না। একা লাগে, নিঃসঙ্গ লাগে, অবসাদ আর অবসন্নতায় দিন কাটে। জীবন তো সরলরেখা নয়, সবার জীবনেই দুঃখ আসে, আসে শোক, অসুখ-বিসুখ, গ্লানি-পরাজয়, নৈরাশ্য-ক্লান্তি, ব্যর্থতা-দুর্যোগ। আমাদের জীবনেও এসেছে। তখন দেখি, কেউ আর নেই পাশে দাঁড়ানোর মতো, কাঁধে হাত রাখার মতো, সান্ত্বনা দেয়ার মতো। এমনকি মন খুলে কথা বলার মতোও কেউ নেই। তখন পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। হয়তো এই আলাদা জীবন, আলাদা সংসার তখনকার বাস্তবতায় অনিবার্যই ছিল, কিন্তু তার জন্য এত বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করার দরকার ছিল। ওই বিষ আসলে স্থায়ী হয়ে গেছে। আসার পথে যে কাঁটা সে বিছিয়ে এসেছিলাম, তা কেবল পথেই নয়, মনেও বিঁধে আছে। ফলে আর ফেরা যাচ্ছে না ভাইবোনদের কাছে, আত্মীয়স্বজনের কাছে, আপনজনের কাছে। অথচ এই বয়সে এসে কী মূল্যবান মনে হচ্ছে তাদের উপস্থিতি এবং সঙ্গকে! কত কথা মনে পড়ছে! ছোটবেলার কথা, মা-বাবার কথা, ভাইবোনদের সঙ্গে কতশত স্মৃতি! কিন্তু ভাগ করে নেয়ার মতো মানুষ নেই।
মনে পড়ছে, বাসাভরতি মানুষ ছিল, তারপরও দু-চারজন বাড়তি মানুষের কথা মাথায় রাখতে হতো মাকে। কখন যে কে এসে পড়ে ঠিক তো নেই। সময়-অসময় বলে কিছু ছিল না, যে-যখনই আসুক, মা তাদের খাওয়ার আয়োজন করতেন। টানাটানির সংসার, তেমন বিশেষ কিছু রান্না হয়তো করতে পারতেন না, ঘন করে ডাল আর ডিম ভেজে ধোঁয়া-ওঠা ভাত বেড়ে দিতেন অতিথিকে। স্বাদ বাড়ানোর সঙ্গে হয়তো একটু আচার, এক টুকরো লেবু, দুটো কাঁচামরিচ। তৃপ্তি করে খেতেন সেই অতিথি। সেই পরিবেশনের মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল, মায়া ছিল, আর সামান্য খাবার খেয়েও অতিথির মুখে যে অপার্থিব তৃপ্তির আলো খেলা করতো, সেসব দেখলেও বুকের ভার অনেকখানি লাঘব হতো, অনেক ক্লান্তি দূর হতো, ফুলের সৌরভে ভরে উঠতো হৃদয়। এখন আর অতিথিরা আসে না আমাদের বাসায়, এলে হরেক রকমের খাবার সামনে দেয়া হয়, কেউ কিছু খেতে চায় না। সবারই নানারকম অসুখ-বিসুখ, খাবারদাবারে অনেক রকমের বিধিনিষেধ, খাদ্যের চেয়ে ওষুধই এখন অধিক প্রয়োজনীয়।
বয়স বাড়ে, আর আমাদের মনে হতে থাকে– যে আদিম যূথবদ্ধ জীবনের অবশেষ বয়ে নিয়ে এসেছিলেন দাদা-দাদু, মা-বাবারা, সেই জীবনেও দুঃখ ছিল, বেদনা ছিল, শোক ছিল, হাহাকার ছিল, কিন্তু সবকিছু ভাগ করে নেয়ার মতো মানুষও ছিল, ছিল যূথবদ্ধতার শক্তি, সাহস এবং আনন্দও। সেই জীবনকে আদিম জীবন হিসেবেই বিবেচনা করে এবং স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে আমরা আধুনিক-নিঃসঙ্গ-স্বাধীন-নিউক্লিয়াস জীবন বেছে নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু হারিয়েছি সঙ্গ, মায়া, বন্ধন, জীবনের সৌরভ।
Comments