আকবর আলি খানকে নতুন করে চেনা
আকবর আলি খান দেশের বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সব ধাপে সব রকমের শাসকদের সঙ্গেই কাজ করে গেছেন। তার স্বর তখন আমরা উঁচু হতে দেখি নাই। আর দশজন আমলা সরকারকে মেনে যেভাবে চলেন সেভাবেই তাকে বাহির থেকে আমাদের দেখা। ভেতরে তিনি কেমন ভাবে পারফর্ম করেছেন তার কোনো নমুনা আমাদের চোখে পড়ে নাই। বরং তার চাকরি থেকে অবসরে তিনি প্রতিভাত হতে শুরু করলেন নতুন রূপে। সেই নতুন অবয়বটাও আর দশজনের মত নয়। দশজনকে এড়িয়ে নতুন রূপে তিনি আবির্ভূত হলেন। তাকে আমরা পেলাম চিন্তক, লেখক, বিশ্লেষক হিসেবে।
অবাক ব্যাপার কর্মজীবন শেষে গতানুগতিক স্মৃতিকথার ধাঁচ ছেড়ে তিনি শিল্প, সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাসবিবেচনা এমনকি জাতির সত্তার অণ্বেষার বিষয়েও নতুন নতুন বিশ্লেষণ হাজির করেন। তার ভাষা নতুন, গদ্য লেখার ঢং আলাদা। স্যাটায়ার আর উইট নির্ভর স্বাদু-লাবণ্যমাখা গদ্যে তিনি নতুন কিছু প্রশ্ন তুলতে থাকলেন। যেসব বিষয় মীমাংসিত বলে বছরের পর বছর আমরা নির্ভার রয়েছি সেসব স্পর্শকাতর বিষয়েও প্রশ্ন তুললেন, উত্তরে কিছু আবিষ্কারের কথা জানালেন।
তিনি কেতাদুস্তর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার নন। আমাদের চেনা গবেষক ঘরানার চৌহদ্দিতে তিনি চেনা মানুষ নন। ফলে, তার মৃদুস্বরের এসব প্রশ্ন, বিশ্লেষণ আমাদের প্রথায় চলা গবেষক, প্রফেসর, বিদ্যাজগতের দিকধরদের একটু বাঁকা চোখেই তাকে দেখতে উৎসাহিত করলো। কিন্তু আকবর আলি খান অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। তার প্রস্তুতি আজীবনের, মেধা প্রখর, বহুবিচিত্র রাষ্ট্রিক-সামাজিক বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ তিনি। সমাজের বাঁকা চোখের চাহনি কে থোড়াই কেয়ার করে একের পর চিন্তামগ্ন গ্রন্থ উপহার দিয়ে তিনি আমাদের চিরচেনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকপ্রধান বৌদ্ধিক জগতকে নাড়া দিতে থাকলেন। অর্থনীতি নিয়ে লেখা 'পরার্থপরতার অর্থনীতি' যখন বেরুলো, মানুষের নজরে এলো -তখন বোঝা গেল আকবর আলি খানকে আমরা না চিনলেও তিনি চেনেন আমাদের, সমাজ-রাষ্ট্র-জনমননের অনেক গহীনে তার বাস। আজকে অন্তত এটুকু বলা যায়, বাংলা ভাষায় দু-বাংলায় অর্থনীতি নিয়ে লেখা গুরুত্বপূর্ণ ও পাঠকপ্রিয় বই এখন সেটাই।
আকবর আলি খানের লেখালেখির সঙ্গে আমরা পরিচিত হতে শুরু করেছি কেবল। সংবাদকর্মি হিসাবে বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নেবার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। লক্ষ্য করলাম চলমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে যে কোন সাক্ষাৎকার দেবার সময় তিনি নতুন কথা বলছেন। এমন কিছু বলছেন যেটা চিন্তার উদ্রেক করে। একবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটা ঘরোয়া আলোচনায় তিনি এসেছেন জীবনানন্দ দাশ বিষয়ে। জীবনানন্দের বনলতা সেন সম্পর্কে তিনি এমন সব নতুন কথা বললেন, শ্রোতারা হচকচিয়ে গেল। প্রথমে হৈ চৈ, পরে বেদনার্ত স্বর-কেননা যে বনলতা সেনকে প্রেয়সী আর কল্পনার স্বপ্ন মানুষ ভেবে শ্রোতারা বছরের পর বছর একটা প্রতিমা গড়েছেন, আকবর আলি খান তাকেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিলেন।
তিনি যুক্তি, তর্ক, নথি, তথ্য, ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন নাটোরের বনলতা সেন একজন রূপজীবী। পরে জীবনানন্দ দাশের কবিতার অসাধারণ ব্যাখ্যাকার হিসেবে আমরা তাকে পেয়েছি। এভাবে একে একে পরার্থপরতার অর্থনীতি, ডিসকভারি অব বাংলাদেশ, গ্রেশামস ল সিনড্রোম এন্ড বিয়ন্ড, দারিদ্রের অর্থনীতি: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, আজব ও জবর আজব অর্থনীতি, বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি, অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি, চাবিকাঠির খোঁজে: নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন, অন্ধকারের উৎস হতে, দুর্ভাবনা ও ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, বাংলায় ইসলাম প্রচারের সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, বাংলাদেশে বাজেট অর্থনীতি ও রাজনীতি, পুরানো সেই দিনের কথা, মুজিবনগর সরকার ও বর্তমান বাংলাদেশ-বই আকবর আলি খানকে আমাদের একজন চিন্তক-লেখক তো বটেই পাঠকপ্রিয় লেখক হিসেবেও হাজির করেছে।
তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কেনো আকবর আলি খান লিখতেন, এতো বিচিত্র বিষয়ে কেনো লিখতেন, কি তিনি খুঁজতে চাইতেন, তার লেখক জীবনের অভ্যন্তরীণ সংগ্রামই বা কি ছিল, সেসব কৌতূহল পাঠকসমাজের ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতিমুখিন-সুবিধাবাদী আমলাতান্ত্রিক আবহে জীবন কাটিয়েও এরকম চিন্তা আর অন্বেষণ কেনো আকবর আলি খানকে তাড়িত করলো সেই কৌতুহলও আমাদের ছিল। বড় আমলা থেকে লেখক হয়েছেন বলে মূলধারার লেখক সমাজে তিনি খুব আদৃত ছিলেন এটা বলা যাবে না। তার মৃত্যুর পর দুচার জায়গায় তার লেখালেখি বিষয়ে আলোচনা শুনতে যেয়ে বুঝেছি দেশের অনেক বড় বড় লেখক, চিন্তকরা তার লেখার সঙ্গে সম্যক পরিচিতও নন। ফলে আকবর আলি খানকে, তার লেখালেখির দুনিয়াকে আবিষ্কার করার কাজটা সহসা হবে বলে ভাবি নাই।
কিন্তু আমাদের ভাবনাতে মৃদু আশা জাগিয়ে রেখেছিলেন আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া। আকবর আলি খানের জুনিয়র সহকর্মি ছিলেন। ছিলেন লেখালেখির একজন নিভৃত কিন্তু নিবিষ্ট সহযোগী। আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া নিজেও বড় আমলা হয়েছিলেন। তার গুরু আকবর আলি খানের মতই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেছেন। নিভৃতচারী হলেও বাংলাদেশে প্লেটোর রচনাসমগ্র বাংলায় অনুবাদ করেছেন, নানাবিধ দর্শনগ্রন্থ অনুবাদে মনোনিবেশ করেছেন। আকবর আলি খানের এই জুনিয়র স্কলার বন্ধুর কাছে আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম আকবর আলি খানের জীবন ও লেখালেখি সম্পর্কে একটা স্মৃতিকথা। কিন্তু তিনি আমাদের আশাকে লঙ্ঘন করে অসম্ভব সুন্দর-চিন্তাধর্মী 'তোহফা' নিয়ে এসেছেন, 'আকবর আলি খান লেখালেখির জায়গা-জমিন' শিরোনামে।
স্মৃতিকথার মেদুরতা ছাড়িয়ে চিন্তা-বিশ্লেষণ, অন্বেষণ বিবেচনায় আকবর আলি খানের এক নতুন দুনিয়ার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। ১২০ পৃষ্ঠার ছোট বই কিন্তু আকবর আলি খানের সকল বই ধরে ধরে তিনি আলোচনা করেছেন। পাঠক হিসেবে আকবর আলি খানের লেখালেখি সম্পর্কে আমাদের যে জিজ্ঞাসা, যে কৌতূহল, যে ভিন্নমত-তার সবকিছুর একটা উত্তর আছে এতে। বইটির বড় গুণ আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া নিজের ভাষাকেও অতিক্রম করেছেন। বইটি পড়তে যেয়ে কখনো কখনো মনে হয়েছে এটিও আকবর আলি খানের নিজেরই লেখা। বিশ্লেষণভঙ্গি আর মনোহর গদ্যের লাবণ্যে একটি স্বাদু বইয়ে পরিণত হয়েছে।
তার উন্নয়নচিন্তা, ইতিহাসভাবনা, স্বদেশ-অন্বেষণ, জ্ঞানপথের পরিব্রাজন- কিভাবে একটি চৈতন্যলোকের মালায় পরিণত হয়েছে, তার সূত্র অবিষ্কার করেছেন লেখক। আমাদের আমলাতন্ত্র, আমাদের সমাজ, আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের ধর্মভাবনা, আমাদের চিন্তার সকল সামাজিক-রাষ্ট্রনৈতিক পাটাতনে যে অনগ্রসরতা তার ঐতিহাসিক ও সামাজিক কার্যকারণ খুঁজতে আকবর আলি খানের লেখালেখি কিভাবে সাহায্য করতে পারে , তার একটা আলোকপথ দেখিয়েছেন আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া। আকবর আলি খানের লেখালেখির সামষ্টিকতার মধ্যে যে শক্তি ও সম্ভাবনা আছে, তাকে আমাদের রাষ্ট্র-সমাজ জীবনে কাজে লাগাতে গেলে এই বইটি বিপুলভাবে সহায়তা করবে। এতে আকবর আলি খানের চিন্তা ও বিশ্লেষণকে খুঁজেছে বটে কিন্তু আদোতে লেখক এই ভূ-খণ্ডের ইতিহাসচেতনা আর সমাজভাবনার সম্ভাবনাকেই উসকে দিয়েছেন। এই ভূ-খণ্ডে সমাজ-রাষ্ট্রে অতীতে যা ঘটেছে তারা ব্যাখায় আকবর আলি খানের চিন্তাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন তিনি।
লেখকের কথায় লেখার ইতি টানতে চাই। তিনি লিখছেন,'' আকবর আলি খান যেসব সমস্যার কথা ভেবেছেন, যা নিয়ে আলোচনা করেছেন, তা সেটি ইতিহাস হোক, অর্থনীতি হোক, লোকপ্রশাসনিক, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা হোক, পানি ব্যবস্থাপনা হোক, সাহিত্য সমালোচনা হোক; কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে নয়, ব্যবহারিক স্তরেও তিনি তার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাই তিনি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের ভূমিকা, অপরিহার্যতা, তার উন্নয়নের কথা ভেবেছেন। তিনি অর্থনীতি, রাজনীতি, আমলাতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থা, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে বই রচনা করেছেন। আমরা তাঁকে কোনো এক নামে কী করে ডাকব?''
আকবর আলি খানকে আমরা যে নামেই ডাকতে চাই না কেন, সেই নাম ঠিক করার ক্ষেত্রে আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া রচিত, প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত 'আকবর আলি খান লেখালেখির জায়গা-জমিন' নিশ্চিতভাবেই সহায়ক হবে।
Comments