সরল পথের সন্ধানে
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হলাম, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে, সাধ পূরণের দারুণ আনন্দ নিয়ে, তখন জানতাম না শুরুতেই আমার জন্য এক গভীর বিস্ময় অপেক্ষা করছে। প্রথম দু' সপ্তাহ বিভাগের বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা ক্লাসে এলেন, কোনো নির্দিষ্ট বিষয় পড়ানোর জন্য নয়, পদার্থবিজ্ঞান সম্বন্ধে একটা সার্বিক ধারণা শিক্ষার্থীদের দেয়ার জন্য। সেই অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণে যাবো না, একটিমাত্র বিষয় নিয়ে কথা বলবো। একদিন একজন শিক্ষক বললেন, আমাদের (অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞানীদের) চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এমন একটি গাণিতিক সমীকরণ আবিষ্কার করা যা দেখতে হবে ছোট্ট, সুন্দর এবং সরল। এতটাই ছোট যে একটা ম্যাচবক্সের পেছনে যে খালি জায়গাটুকু থাকে সেখানে লিখে ফেলা যাবে, এবং যেটি দেখে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, বিকাশ, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিণতিসহ সকল রহস্য বোঝা যাবে।
কথাটি আমার এত ভালো লেগেছিল যে, এখনো, প্রায় তিন যুগ পরও কান পাতলে শুনতে পাই। তখন যে বিষয়টি খুব বেশি বুঝতে পেরেছি তা নয়, কিন্তু যত দিন গেছে, যত বয়স বেড়েছে, ধীরে ধীরে তত উপলব্ধি করেছি কথাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। মানুষ নানাভাবে এই জগৎকে বুঝতে চেয়েছে। কেউ দর্শনের সাহায্যে, কেউ ধর্মের সাহায্যে, কেউ বিজ্ঞান দিয়ে, কেউ শিল্প-সাহিত্য-সংগীত দিয়ে, কেউ বা অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতি দিয়ে। কেবল বুঝতে চেয়েই ক্ষান্ত হয়নি, নিজেদের বোঝাপড়া অন্যদেরকে কাছে পৌঁছাতে চেয়েছে। কিন্তু যতই বুঝতে চেয়েছে ততই যেন জটিল হয়ে পড়েছে সব কিছু। এতসব জটিল বিষয় তাহলে মানুষ বুঝবে কী করে? যুগে যুগে মনীষীরা তাই চেয়েছেন একটা সরল বর্ণনা, যা সকলের কাছে সহজবোধ্য হবে, সবার কাছে পৌঁছে যাবে বিনা বাধায়। এরকম একটি ভাষা কিংবা ভাষ্য তো খুঁজে পাওয়া কঠিন। আর তাই, তাঁদের লক্ষ্য একটি সরল-সুন্দর পথ, যা একইসঙ্গে অন্য সবার কাছে আনন্দময় এবং সহজগম্য হবে।
যখন কথাগুলো শুনেছিলাম তখন আমি ছিলাম এক বিষাদগ্রস্ত তরুণ। বছর তিনেক আগে, কলেজে ভর্তি হবার পরপরই বাবা চলে গিয়েছিলেন অনন্তলোকে। সেই আকস্মিক শোক আমি সহজে সামলে উঠতে পারিনি। শোক অবশ্য কাটতে শুরু করেছিল, কিন্তু আদিগন্ত শূন্যতা বয়ে বেড়াতাম। তারওপর, এইচএসসি পরীক্ষার পর এলো সেই সর্বব্যাপি প্রলয়ংকরী বন্যা, ১৯৮৮ সালের বন্যা, সারাদেশ তো বটেই, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ অঞ্চলও তলিয়ে গেল পানির নিচে। ঘরবন্দি বিষণ্ণ সময় কাটতেই চায় না। বন্যার জল একসময় নেমে গেল, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া আর শুরু হয় না। হবেই বা কীভাবে? তখন সামরিক শাসকের কাল, যখন-তখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়, শিক্ষাসূচি বিপর্যস্ত। ফলে এইচএসসি পাশ করার পরও এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হলো। খুব দুঃসহ সময় সব দিক থেকেই। ভাবছেন, এত গভীর আলাপ দিয়ে শুরু করে কেন এই ব্যক্তিগত কাসুন্দি ঘাটতে বসেছি? কারণ আছে। ওই কথাগুলো যখন শুনলাম, সেই সঙ্গে অন্য শিক্ষকদের অসামান্য সব আলোচনা, তখন মনে হলো-- আমি এমন এক জায়গায় এসে পড়েছি, যেখানে বড় চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে উঠলাম, মহৎ চিন্তার সঙ্গে পরিচয় হলে ছোট দুঃখগুলোর উপশম হয়।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের চিন্তাগুলো হয় গণ্ডিবদ্ধ, স্বপ্নগুলো হয় ছোট ছোট, গন্তব্য হয় স্বল্প দূরত্বের। আমাদের চাওয়াগুলো সাধারণত হয় জাগতিক এবং ইহলৌকিক। পারলৌকিক কোনো চিন্তা থাকলেও তা আমাদের জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মের বিধি-নিষেধ-নিয়ম-কানুনে সীমাবদ্ধ থাকে। তবু, লক্ষ্য করলে দেখবেন, গন্তব্যে পৌছাঁনোর জন্য আমরা একটা সরল পথের সন্ধান করি। সরল, সহজ, ছোট্ট এবং সুন্দর একটি পথ, যা আমাদের নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। এমনকি বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত এবং সহজ পথটিই বেছে নিতে চাই আমরা। আর বড় মানুষদের চিন্তা বড়, স্বপ্ন বড়, গন্তব্যও সুদূরে। এবং এইসব চিন্তা-স্বপ্ন-গন্তব্য সবসময় দৈনন্দিন জীবনের বিবিধ জাগতিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, ধাবিত হয় অসীমের দিকেও।
আমার ওই শিক্ষকের কথায় আবার ফিরে আসবো, তার আগে আরেকটি বিষয় দেখে আসা যাক। পৃথিবীর মানুষের চিন্তাজগৎকে এখন পর্যন্ত যারা শাসন করছেন তাদের একটা বড় অংশই ধর্ম-প্রণেতা হিসেবে স্বীকৃত। আব্রাহামিক বা সেমেটিক ধর্মগুলোর কথাই ধরা যাক। এর শুরুটা হয়েছিল আব্রাহাম বা ইব্রাহিম (আ.)-কে দিয়ে। তিনি আসলে কী বলেছিলেন বা করেছিলেন? তার চিন্তায় এমন কী নতুনত্ব ছিল? কেনই-বা তাঁর পরবর্তীকালে আরব অঞ্চলে উদ্ভাবিত সমস্ত ধর্মকেই আব্রাহামিক ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়? যেহেতু তার চিন্তার কোনো লিখিত দলিল নেই, আমাদেরকে তাই নির্ভর করতে হয় পরবর্তী সময়ের লেখাগুলোর ওপরেই, যেমন বাইবেল (ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্ট), কোরআন ইত্যাদি। সেসব থেকে দেখা যায় আব্রাহামের একটি প্রধান কাজ হলো এক ঈশ্বরের ধারণা প্রবর্তন। মানুষ একসময় তার চেয়ে শক্তিশালী যেকোনো কিছুকেই দেবতা-জ্ঞান করতো।
বিশেষ করে যেসব বিষয় তারা ব্যাখ্যা করতে পারতো না, সেসবকে। সেজন্য সূর্য যেমন তাদের দেবতা ছিল, তেমনই সাপও ছিল দেবতার আসনে। এরকম অজস্র দেবতা থাকার ফলে মানুষের জীবন হয়ে উঠছিল ভীতিকর এবং সংকুচিত। দেবতার রোষ বা আক্রোশ থেকে মুক্ত থাকার জন্য চেষ্টার কমতি ছিল না তাদের। ভয়ে জড়োসড়ো মানুষকে এরকম বহু-দেবতা বা বহু-ঈশ্বরের উৎপাত থেকে রক্ষা করতেই সম্ভবত আব্রাহাম এক- ঈশ্বরের ধারণা প্রবর্তন করেন যে ঈশ্বর অনাদি-অসীম, যাকে দেখা যায় না, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, অথচ তিনিই সকল কিছুর স্রষ্টা। শুধু তাই, কেবল সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, প্রতিপালনের দায়ভার নিয়েছেন নিজের কাঁধেই। যেহেতু তিনি একইসঙ্গে স্রষ্টা এবং প্রতিপালক সেজন্য তিনি কেবল শাস্তিই দেন না, দেন পুরস্কারও। তিনি কেবল ভয়ই দেখান না, ভালোও বাসেন। অতএব উপাসনা করতে হলে তাকেই করতে হবে।
সেই সময়ের প্রেক্ষিতে তার এই ধারণা অবশ্যই নতুন, অভিনব এবং বৈপ্লবিক ছিল। যেসব মানুষ তাঁর ওপর আস্থা রেখেছিলেন, তাঁকে বিশ্বাস করেছিলেন তাঁরা নিশ্চিতভাবেই একটা স্বস্তি পেয়েছিলেন এই ভেবে যে, তাঁরা তাঁদের স্রষ্টা এবং প্রতিপালকের ছায়ায় আছেন। কিন্তু এরকম ধারণা প্রবর্তনের কারণ কী হতে পারে? আবারও আমাদেরকে আন্দাজের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। প্রথম কারণটি আগেই বলেছি, বহু দেবতার উৎপাত থেকে মুক্তি দিয়ে তুলনামূলকভাবে একটা নির্ভার জীবনের সন্ধান দেয়া। দ্বিতীয় কারণটি হয়তো এরচেয়ে বড়। মানুষের এই জীবন ক্ষণস্থায়ী, একথা না বললেও সবাই জানে। কিন্তু এরও একটা লক্ষ্য আছে। সেটি হলো অসীমের দিকে যাত্রা। অনাদি-অসীম ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে পারলেই এই নশ্বর জীবন তখন মহাজীবনের অংশ হয়ে যাবে। এভাবেই মানুষকে তিনি ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ জীবন থেকে বের করে মহাজীবনের সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন হয়তো।
আরো অনেক কারণ থাকতে পারে, তবে আমরা যদি এই দুটো কারণকে ধরে নিয়ে এগোই, দেখতে পাবো, প্রথম কারণটি ছিল মানুষের ইহজাগতিক জীবনকে সহজ করা। কিন্তু দ্বিতীয় কারণটি ইহলৌকিক নয়, এক পরমার্থিক জীবনের সন্ধান দেয়ার চেষ্টা করা। পরবর্তীকালে আরো অনেক পয়গম্বর এসেছেন আরব অঞ্চলে এবং তাঁরা সবাই আব্রাহামের একেশ্বরের ধারণাটি বহন করে নিয়ে গেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আমার কাছে এখনও একটা বিষয় ঠিক পরিষ্কার নয় যে, কেবল একটি অঞ্চলেই এত পয়গম্বর এলেন কেন? পৃথিবীর বাদবাকি অঞ্চলগুলো কেন তাঁদের প্রজ্ঞার আলো থেকে বঞ্চিত থেকে গিয়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই । অবশ্য পারস্য অঞ্চলের জরথুস্ত্রও ছিলেন এক ভীষণ প্রভাবশালী দার্শনিক। তিনিও একেশ্বরের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ওই অঞ্চলে, যদিও জানার উপায় নেই যে, আব্রাহামের বাণী তাঁর কাছে পৌঁছেছিল কি না, নাকি স্বতন্ত্রভাবেই তিনি এই ধারণার প্রবর্তন করেছিলেন। ভালো ও মন্দের দ্বন্দ্ব চলছে এই পৃথিবীতে, চলছে আলো ও অন্ধকারের দ্বন্দ্ব, তিনি সেই আলোর পথ প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত ধর্ম জরথস্ত্রুবাদকে আব্রাহামিক ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা না হলেও এই ধর্মের অনেককিছুই পরবর্তকালে ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং ইসলাম ধর্মে আত্মীকরণ করা হয়েছিল।
সেমেটিক ধর্মের আরো দু-একজন পয়গম্বরকে নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। যেমন ধরুন মোজেস বা মুসা (আ.)-এর কথা। কথিত আছে, তিনি সিনাই পর্বতে গিয়ে একাধারে চল্লিশ দিন ধ্যান করে ঈশ্বরের কাছ থেকে কিছু অনুশাসন নিয়ে এসেছিলেন। দশটি অনুজ্ঞার সমন্বয়ে গঠিত এই অনুশাসনের মধ্যে জাগতিক এবং পারমার্থিক দুটো বিষয়ই আছে। সংক্ষেপে সেগুলো হলো : ঈশ্বর এক, অন্য কাউকে ঈশ্বরের আসনে বসানো যাবে না; মূর্তি গড়ে বা ছবি এঁকে ঈশ্বরের আরাধনা করা যাবে না; ঈশ্বরের নামে শপথ খাওয়া যাবে না (আমরা যাকে বলি কসম কাটা, তা করা যাবে না); সপ্তাহের একদিন ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে স্যাবাথ (উপোস বা রোজা) পালন করতে হবে, কারণ ঈশ্বর ছদিন ধরে বিশ্ব সৃষ্টির পর একদিন বিশ্রাম নিয়েছিলেন; পিতামাতাকে সর্বদা মান্য করবে; নরহত্যা করবে না; ব্যাভিচার করবে না; পরের ধন আত্মসাৎ করবে না; মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না এবং পরের ধনে লোভ করবে না। দেখা যাচ্ছে, প্রথম দুটো একবোরেই পরমার্থিক। ঈশ্বরের এককত্ব যেমন ঘোষণা করা হচ্ছে, তেমনই তার কোনো রূপ কল্পনা করার ব্যাপারে নিষেধ করা হচ্ছে। মূর্তি গড়লে বা ছবি আঁকলে তো কল্পনা করতেই হয়, অতএব ঈশ্বরের মূর্তি বা ছবি আঁকা যাবে না।
তৃতীয় এবং চতুর্থটি জীবনাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেও এর সঙ্গেও আছে ঐশ্বরিক যোগ। কিন্তু পঞ্চম থেকে দশম অনুজ্ঞাগুলো একেবারেই ইহলৌকিক দৈনন্দিন জীবনের করণীয় সম্বন্ধে বিধি-নিষেধ। হয়তো এই অনুশাসনগুলোর উদ্দেশ্য ছিল মানুষের ইহজাগতিক জীবনকে সুন্দর করা এবং একইসঙ্গে জীবনের একটা পারমার্থিক তাৎপর্য যুক্ত করা। পরে অবশ্য ইহুদি ধর্মে আরো অনেক নিয়মকানুন যুক্ত হয়। বলতে গেলে পদে পদে নিয়মকানুন। এমনকি পশু জবাই কীভাবে করতে হবে তারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ওই ধর্মে। এইসব নিয়মকানুন-আচার-অনুষ্ঠান জীবনকে সহজ করার বদলে কঠিন করে তোলে, তবে ওই দশটি অনুজ্ঞা পালন করা কিন্তু ততটা কঠিন নয়। সম্ভবত ওই অনুশাসনগুলো ছিল সরল পথের সন্ধানেরই অংশ।
মোজেস যখন তার অনুসারীদের এই শিক্ষাগুলো দিচ্ছিলেন, সম্ভবত তার কিছুকাল পরে ভারতবর্ষে গৌতম বুদ্ধ নিয়ে এসেছিলেন অন্য ধরনের এক পথ। দীর্ঘ ধ্যান আর সাধনার মাধ্যমে অর্জিত প্রজ্ঞার ফলাফল ছিল নির্বাণের ধারণা। জগতের সকল জীবের প্রতি ভালোবাসা যেমন ছিল তাঁ নির্দেশনার অংশ তেমনই ভীতি এবং বাসনা থেকে হৃদয়কে মুক্ত করে নির্বাণ লাভ করার মাধ্যমে এক মহাজীবনের অংশ হবার সুযোগও করে দিয়েছিলেন তিনি। আত্মিক মুক্তি এবং সমৃদ্ধির জন্য নির্বাণকেই তিনি সরল পথ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ভারতবর্ষে অবশ্য হিন্দু ধর্মেরও ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল এবং সেখানেও আছে ইহজাগতিক ও পারমার্থিক জীবনের জন্য কল্যাণকর দিকনির্দেশ।
বুদ্ধের প্রায় শ'পাঁচেক বছর পর আরবে আরেক প্রভাবশালী পয়গম্বরের আবির্ভাব হলো। জেসাস, যীশু বা ঈসা (আ.) তাঁর নাম। অনুতাপ, ক্ষমা আর ভালোবাসা -- এই তিন সূত্র ছিল তাঁর পক্ষ থেকে মানবজাতিকে দেয়া উপহার, যা মানুষকে পার্থিব জীবনের যাবতীয় সংকট থেকে যেমন মুক্তি দেবে তেমনই এক অসীম পারমার্থিক জীবনের সন্ধান দেবে। খ্রিষ্টান ধর্মে দৈনন্দিন জীবনে করণীয় তেমন আচার-অনুষ্ঠান, বিধি-নিষেধের বালাই নেই। যা আছে তার সবই মনন ও হৃদয়ের চর্চার ব্যাপার।
আব্রাহামিক দর্শনের সর্বশেষ প্রতিনিধি হয়ে আরবে এলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.), যীশুর শ'পাঁচেক বছর পর। তিনিও ছড়িয়ে দিলেন শান্তি ও সাম্যের বাণী, ধৈর্য ও ক্ষমাকে ঘোষণা করলেন মহত্তম গুণ হিসেবে, সততা-সত্যবাদিতা-পারস্পরিক সহযোগিতা, অপরের কল্যাণ ও মঙ্গল চিন্তার কথা তো বললেনই, একইসঙ্গে দেখালেন পরমের সঙ্গে মিলনের পথ। পবিত্র কোরআনের সুরা ফাতিহা মুসলমানরা নামাজের প্রতিটি রাকাতে তো পড়েই, এ ছাড়াও পড়ে। সেখানে একটি আয়াতে প্রার্থনা করা হয়েছে এই বলে যে, 'আমাদের সরল পথ দেখাও'। মুহাম্মদ (সা.) এভাবেই তাঁর অনুসারীদের ভেতরে সরল পথ অনুসন্ধানের বীজ বুনে দিয়েছিলেন।
এত ছোট পরিসরে ধর্মগুলো সম্বন্ধে কিংবা এই মহামানবদের সম্বন্ধে কিছুই বলা হয়ে ওঠে না। আমি যেহেতু একটি বিষয় নিয়ে কথা বলছি -- সরল পথের সন্ধান-- তাই, বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টাও করছি না। আব্রাহামের অনুসারীদের সকল চিন্তাবিদের দর্শনগুলো পরবর্তীকালে পরিণত হয়েছে প্রভাবশালী ধর্মে। ফলে এগুলোর আচার-অনুষ্ঠান, বিধি-নিষেধ, আদেশ-নির্দেশ সবই হয়ে উঠেছে অনুসারীদের কাছে অলঙ্ঘনীয়। আর এই অলঙ্ঘনীয় অনুশাসনগুলো পালন করতে গিয়ে এসব ধর্মের অধিকাংশ অনুসারী হারিয়ে ফেলেছে দর্শনের মর্মবাণী, হারিয়ে গেছে সরল পথ অসুন্ধানের আকাক্ষা।
আরবে মোজেস বা ভারতবর্ষে গৌতম বুদ্ধ যখন ইহজাগতিক বাস্তবতার সঙ্গে কিংবা বলা যায় লৌকিক জীবনে একটা পারমার্থিক তাৎপর্য যুক্ত করতে চাইছেন, তখন পাশ্চাত্যে থ্যালেস এবং তার অনুসারী দার্শনিকগণ এবং তারও পরে সক্রেটিস প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেছেন। জগৎটা কীভাবে চলছে, সব সৃষ্টির মূলে কী আছে, কিংবা দৈনন্দিন জীবনে প্রচলিত ধারণাগুলো সম্বন্ধে অন্তহীন প্রশ্ন। প্রশ্ন করেছেন প্রাচ্যের দার্শনিকরাও। সত্যি বলতে কি প্রশ্ন ছাড়া নতুন কিছুর জন্মই হয় না। কিন্তু প্রাচ্যের এইসব চিন্তা ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে বলে প্রশ্ন গেছে থেমে, তৈরি হয়েছে প্রশ্নহীন বিশ্বাস। ওদিকে পাশ্চাত্যের সেই প্রশ্নের ধারা চলমান থাকার কারণে জন্ম নিয়েছে বিজ্ঞানের, যুক্তিই যেখানে প্রধান।
বিজ্ঞানও চায় একটি সরল বর্ণনা। মানুষের তো বটেই প্রকৃতির অন্য সব জীব ও জড়ের আচার-আচরণ, বৈশিষ্ট্য-ধর্ম, গতি-প্রকৃতি যেমন ব্যাখ্যা করতে চায় বিজ্ঞান, তেমনই চায় এই অসীম-বিস্তৃত মহাবিশ্বের জন্ম-বিকাশ ও সম্ভাব্য পরিণতির ব্যাখ্যাও। যে শিক্ষকের কথা বলেছিলাম লেখার শুরুতে, তিনি আমাদের সেটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন। তিনি উদাহরণ হিসেবে আইনস্টাইনের ভর-শক্তির সমতা সূত্রের কথা বলেছিলেন। এটা দেখতে যেমন ছোট, তেমনই সুন্দর, এবং একইসঙ্গে এক গুঢ় দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দেয়। সেটি হলো, মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে সবই ছিল শক্তিরূপে। কোনো বস্তুই তখন ছিল না, থাকা সম্ভব ছিল না। তাহলে বস্তুর বা ভরের আবির্ভাব হলো কীভাবে?
সে এক দীর্ঘ গল্প। অন্যত্র সে গল্প বলেছি বলে তার পুনরুল্লেখ করলাম না। আইনস্টাইনের এই সূত্রটি আমাদেরকে জানায় যে, বস্তুর ভর হলো এর ভেতরে কতটুকু শক্তি সঞ্চিত আছে তার পরিমাপ। যদি কোনো বস্তুকে ভেঙে ছিন্ন-বিচ্ছন্ন করে ফেলা যায়, মানে এর অণু-পরমাণু, কিংবা তার চেয়ে ক্ষুদ্র কণা প্রোটন-নিউট্রন-ইলেকট্রনকে যদি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা যায় তাহলে এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেব বিপুল শক্তি। কেন? কারণ আদিম মহাবিশ্বে যে বিপুল শক্তির বিকিরণ ছিল সেখান থেকেই তৈরি হয়েছিল এই ভরবাহী কণাগুলো, আর সেগুলো মিলেমিশেই পরমাণু-অণুর গঠন, এবং পরিশেষে বস্তুর আবির্ভাব। আমাদের চারপশে যা কিছু দৃশ্যমান তার মূলে আছে এই অদ্ভুত-সুন্দর এক রহস্য। বিজ্ঞান যেমন সেই আদিম মহাবিশ্বকে বুঝতে চায়, তেমনই বর্তমানকেও ব্যাখ্যা করতে চায়, আন্দাজ করতে চায় ভবিষ্যৎকেও। আর তারই জন্য চলছে এক সরল-সুন্দর-ছোট্ট সমীকরণের সন্ধান।
কেউ সরল পথ খুঁজছে বিজ্ঞানে, কেউ ধর্মে, কেউ দর্শনে, কেউ বা সমাজ-সংসারে। পাই বা না-পাই সরল পথের সন্ধান আমদের থামছেই না।
Comments