বুক রিভিউ

আলোকসন্ধানী অতীতের দিকে সনৎকুমার সাহা

চোখের সামনে তৈরি হতে দেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়কে। একসময় ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকও হয়েছেন। অবসরও নিয়েছেন। তারপর সম্মানসূচক 'বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক' হিসাবে জড়িয়ে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই। ফলে সত্তর বছর বয়সী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আর তার জীবন সমান তালে বেড়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে।

শিক্ষকতা, লেখালেখি, গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের সবধারাতেই বিশিষ্ট জায়গা করে নেয়া নীতিনিষ্ঠ শিক্ষক ও চিন্তাশীল শিক্ষাবিদ সনৎকুমার সাহা'র লেখাতে যখন উঠে আসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত দশকের অবয়ব, তখন পাঠক হিসাবে একটা আগ্রহের জায়গা তৈরি হয় বৈকি? কেননা অর্থনীতিবিদ সনৎকুমার সাহা লন্ডন স্কুল অফ ইকনোমিক্সের সময়টুকু ছাড়া বাকী জীবন কাটিয়েছেন রাজশাহী শহরে। ফলে ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি দেখছেন তার ১২ বছর বয়স থেকেই। সে কারণে চিন্তক, গবেষক, অর্থনীতিবিদ, প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক মনস্ক সনৎকুমার সাহা রচিত 'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত দশক স্মৃতি সত্তা বর্তমান' বইটি আমাদের আগ্রহ বাড়ায়, ভীষণভাবে উৎসাহী করে তোলে।

বইটির উৎসর্গ করেছেন লেখক তার বিশ্ববিদ্যালয়কেই। বইয়ের ৪টি নিবন্ধের ক্রমসূচি এরকম-১. আমার বিশ্ববিদ্যালয় ২. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: যখন যা মনে পড়ে ৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি ও বিধিলিপি ৪. খান সারওয়ার মুরশিদ: যখন তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যা আর জ্ঞানের এক স্বর্ণযুগের মানুষদের নাম উঠে এসেছে এই গ্রন্থে লেখকের কলমে। ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, ডক্টর ই এইচ জুবেরি, অধ্যাপক কাসিম হোসেন, অধ্যাপক শামসি, ডক্টর মুশাররফ হোসেন, অধ্যাপক সালাহ্‌উদ্দীন আহমদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, বদরুদ্দীন উমর, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক আলী আনোয়ার, অধ্যাপক এ আর মল্লিক, অধ্যাপক মুখলেসুর রহমান, অধ্যাপক এ বি এম হোসেন, ডক্টর রশীদুল হক, অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরি, হাসান আজিজুল হক, ডক্টর গোলাম মুরশিদ, ডক্টর সুব্রত মজুমদার…. কত উজ্জ্বল কৃতি শিক্ষকের সম্মিলন ঘটেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই একসময় বেরুত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী আর মুস্তাফা নূরউল ইসলামের সম্পাদনায় আলোড়ন ফেলা পত্রিকা 'পূর্বমেঘ'। সেসব স্বর্ণস্মৃতি আর গুণীসময়কে তুলে এনেছেন লেখক সহজ-স্বাভাবিক গল্প বলার ঢংয়ে।

সনৎকুমার সাহা প্রগতিশীল সমাজবাদি রাজনীতির চিন্তাধারার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা সত্ত্বেও, চিন্তায় নৈর্ব্যক্তিক। তার সমাজ-রাজনীতি বিশ্লেষণে যে নিরপেক্ষতা তা দৃষ্টিকাড়া। বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশাসন, রাজনীতি, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের অবস্থা বিশ্লেষণ করতে যেয়ে এই বইয়ে তাই তিনি গভীরতর বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করেন, 'ভেবেছিলাম, স্বাধীনতা বাঙালি চেতনার ঐক্যকে শুধু ফুটিয়েই তোলেনি, তাকে আরও মজবুত করেছে, তার প্রেরণায় জাতীয় জীবনে সংহতির ও সম্ভাবনার অনেক উদ্যোগ জেগে উঠেছে। খেয়াল করিনি, জয় অনেককে অসহিষ্ণু করে,  আর পরাজয়ের গ্লানি বহু মানুষের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালায়। পাশাপাশি ক্ষমতার মোহ বিকারের জন্ম দেয়, এবং ক্ষমতার লোভ পারস্পরিক সহমর্মিতার দেয়াল ভেঙে টুকরো টুকরো করে।'(পৃষ্ঠা:৬৭)

স্বাধীনতার পর পরেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসাবে যোগদান করেন ডক্টর খান সারওয়ার মুরশিদ। সাত দশক বয়সের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে সম্ভবত এরকম আলোকদ্যুতি ছড়ানো মানুষ আর পাননি সনৎকুমার সাহা।

সদ্য স্বাধীন দেশে বহু ঝঞ্জা আর বিক্ষুব্ধতা কিভাবে সামাল দিয়েছেন নিজের ব্যক্তিত্ব আর নীতি সমুন্নত রেখে ডক্টর মুরশিদ, তার একটা বিশদ বয়ান আছে এই বইয়ে। আছে খান সারওয়ার মুরশিদ সম্পর্কে লেখকের এক নির্মোহ বিশ্লেষণও।

বইয়ের ৭৮ পৃষ্ঠায় ডক্টর খান সরওয়ার মুরশিদের কাজের বিশ্লেষণ করতে যেয়ে সনৎকুমার সাহা লিখেছেন, 'এখানে তিনি ছিলেন বহিরাগত। আমার মনে হয়েছে, এই দূরত্ব তিনি মুছে দিতে চাননি। কাজ সহজ হবে, এমন মনে করে সাধারণত প্রভাবশালী কোনো স্থানীয় স্বার্থচক্রের ঘনিষ্ঠ হতে চান কেও কেও। তিনি তেমন কোনো চেষ্টাই করেননি। প্রয়োজনে সবাইকে ডেকেছেন। কথা শুনেছেন সবার। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বিধিসম্মভাবে অগ্রসর হয়েছেন আপন বিবেকের কাছে পরিশুদ্ধ থেকে। ভালো-মন্দ বিবেচনাবোধকে ব্যক্তিগত লাভের তাড়নায় আবিল করে তোলেননি। নানামুখী চাপ পড়েছে তার ওপর নিশ্চয়। শান্তভাবে তিনি তাদের ঠেকিয়েছেন। কোনো কিছুতে জড়িয়ে পড়েননি বলে মনের দৃঢ়তা তার অটুট থেকেছে। যা অনুচিত মনে করেছেন, তার কাছে নতি স্বীকার করেননি। নিজের তাতে ক্ষতি হলেও না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো চেয়েছেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে।'

আজকের দিনে এই বিবেচনা খুব দুষ্কর। এই বই পাঠের সবচেয়ে বড় লাভ এটিই। নৈতিক-প্রশাসনিক মানুষের বদলে জ্ঞানবিমুখ, রাজনৈতিক দলদাস, নিম্নরুচির একদল মানুষ যে বিশ্বদ্যিালয়ের মত জায়গাতেও নীতি-নৈতিকতা-সততা বর্জন করে দলকেই, ক্রীতদাসী মনোভাবকেই সবার ওপরে জায়গা দিচ্ছেন, সেটাই যে এ জাতির গন্তব্য নয়, সেই আলোকসন্ধানী অতীতের দিকে সনৎকুমার সাহা আমাদের নিয়ে গেলেন। জানান দিলেন আমাদের বনসাইকালের মহোৎসবের দিনেও ডক্টর খান সারওয়ার মুরশিদের মত বটবৃক্ষের কথা আমরা সগৌরবে স্মরণ করতে পারি। ভাবতে পারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে এমন মানুষও এই স্বাধীন বাংলাদেশে হওয়া যায়, পাওয়া যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন, বিধি-বিধান নিয়েও একটা মননময় আলোচনা আছে এই গ্রন্থে। আছে চোখের সামনে বেড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওঠা-নামার এক অবলোকন। আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেই বিভীষিকার কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর -বাহিরের নানা অভিজ্ঞতা। সাত দশক ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিকে খুব কাছ থেকে দেখে লেখকের বার বার মনে হয়েছে ডক্টর খান সারওয়ার মুরশিদের কথাই। এটা তার দুঃখ ও আশার জায়গা দুটোই হয়তো।

সে কারণেই তিনি বইয়ের ইতি টেনেছেন এই কথা লিখে যে, 'গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রের বিকার যখন আস্ফালন করতে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে-বাইরে যখন তা শক্তি সঞ্চয় করে, ন্যায়-অন্যায় ভেদরেখা যখন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে ঢাকা পড়ে যায়, তখন শুধুই সদিচ্ছা নিয়ে কাজে নেমে সফল হওয়ার আশা খুব কমই থাকে। চুয়াত্তরে এসে এই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে শুরু করেছিলেন ডক্টর মুরশিদ। লড়াই করতে চাইলে তাঁকেও পাল্টা দল জোটাতে হতো। মনে হয়, তার রুচি এতে সায় দেয়নি। তা ছাড়া লড়াই স্বয়ং বৃহত্তর লক্ষ্য পেছনে ফেলে সামনে চলে আসতে পারত। লক্ষ্য স্বয়ং তাতে অবান্তর হয়ে পড়তে পারত। তিনি বোধহয় এটা চাননি। নিজেই সরে গেছেন। তবে মাথা উঁচু করেই।'

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত দশক উদযাপনের চলতি বছর জুলাইতে বইটি প্রকাশ করেছে 'কথাপ্রকাশ'। সাত দশকের ইতিহাস বয়ানে বা স্মৃতির ঝাপি রচনায় এই ক্ষীণকায়া (মাত্র ৮৮ পৃষ্ঠার) বইটি হাতে নিয়ে, ভেতর যাত্রায় পাঠক একটু হোঁচট খাবেন।

কেননা মাত্র চারটি নিবন্ধ নিয়ে এই বই। যার দুটি আলাদা আলাদা উপলক্ষে লেখা। নতুন করে লেখা হয়েছে দুটি নিবন্ধ। পাঠকের এই হোঁচট খাওয়া যে অকারণ নয়, তার বয়ান আছে খোদ লেখকের ভূমিকায়। তাঁর সরল স্বীকারোক্তি, 'লেখাগুলো তৈরি হয়েছে ছাড়া ছাড়াভাবে, বিভিন্ন সময়ে। বই আকারে তাদের সাজাবার কোনো লক্ষ্য সামনে ছিল না।'

তারপরও সনৎকুমার সাহা প্রশংসা পাবার যোগ্য। বিশেষ করে তার নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। সাত দশকের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘটনাপ্রবাহের আলোকপাত করতে যেয়ে এসেছে সময় ও সমাজের নানান বয়ান। সেখানে তার যে নিজস্ব অবলোকন ও নির্মোহ ভাবনা, সেটাই আসলে এই বইয়ের শক্তির মূল জায়গা। বর্তমান সময় ও সমাজকে দেখবার ক্ষেত্রেও সেটা মূল্যবান মাত্রা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। পাঠক হিসাবে সেটাই আমাদের বড় পাওনা। সে কারণেই তিনি ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। প্রকাশক হিসাবে 'কথাপ্রকাশ' এই বইটি প্রকাশ করেও পাঠকদের কৃতার্থ করেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

1h ago