‘আমার উপস্থাপক জীবনে’ ক্ষয়কালের প্রতিচ্ছবি
'আমার উপস্থাপক জীবন' বইয়ের লেখক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। যাকে নতুন করে পরিচয় করে দেবার কিছু নেই। ৪০ বছর ধরে বই পড়ার মাধ্যমে আলোকিত মানুষ গড়ার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। অসাধারণ সুন্দর রসগুণ সম্পন্ন বক্তা হিসেবেও আকর্ষণীয়। আজকের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ হয়ে উঠার পেছনে কাজ করেছে তার টানা দশ বছরের বাংলাদেশ টেলিভিশনে উপস্থাপক জীবন।
বইয়ের নাম 'আমার উপস্থাপক জীবন' হলেও এখানে শুধু নিজের উপস্থাপক হওয়ার গতানুগতিক দিনপঞ্জি লিখা হয়নি। সাহিত্যের রসময়তায় বাংলাদেশ টেলিভিশন যাত্রার প্রস্তুতি পর্বের ইতিহাস, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, বিনোদন সংস্কৃতি তৈরিতে টেলিভিশনের ভূমিকা থেকে সফল উপস্থাপক হতে কি ধরনের বুদ্ধিমত্তা, রসময়তা প্রয়োজন- তার বিস্তৃতি আলাপ রয়েছে।
জনপ্রিয় উপস্থাপক হওয়ার নেপথ্যে
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছিলেন বাল্যকাল থেকে ভীতু। কারো সামনে কথা বলতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে পড়তেন। কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে রবীন্দ্রনাথের 'কাবুলিয়াওয়ালা' গল্পের মিনির মতো দুর্মর কথা বলার ইচ্ছা। আবার আমি টেলিভিশনে কাজ করি শুনে তরুণীদের মতো নির্লজ্জ হয়ে কারো কাছে হাত পেতে উপস্থাপক হতে চাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশে দারুণ সঙ্কোচ। কিভাবে তিনি তার স্বভাবজাত দুর্বলতাকে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কখনো কবিতা, কখনো গল্প বলা, কখনো নাটকের মঞ্চে প্রকাশ করে দূর করেছিলেন তার বর্ণনাও আছে। যারা উপস্থাপক বা শো ম্যান হতে চান তাদের জন্য অনুকরণীয় প্রায়োগিক পথের দিশা হতে পারে।
টেলিভিশনে যুক্ত যাত্রার প্রেক্ষিত
১৯৬৪ সালে প্রথম টেলিভিশন হিসেবে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ টেলিভিশন। ততদিনে সাহিত্য আন্দোলন করার কারণে সেই সময়ের যারা বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরুর পর্বের সাথে যুক্ত ছিলেন মোস্তফা মনোয়ার, জামান আলী খান, কলিম শরাফিসহ প্রায় সবার সাথে সায়ীদের পরিচয় ছিলো। কিন্তু নির্লজ্জের মতো তাদের কাছে গিয়ে টেলিভিশনে উপস্থাপক হওয়ার কথা বলার সঙ্কোচ বাঁধা হয়ে ছিলো। সেই সুযোগ এসেছিলো টেলিভিশন যাত্রার একমাসের মধ্যে। সায়ীদ তখন কলেজের শিক্ষক জীবন শুরু করেছেন। টেলিভিশনের দুই পুরোধা মোস্তফা মনোয়ার ও জামান খান তাকে কবি জসীম উদ্দিনের একটি সাক্ষাতকার ভিত্তিক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেন।
১৯৬৫ সালে শুরু হলেও লেখকের ধারাবাহিক অনুষ্ঠান নির্মাণ শুরু করেন ১৯৭০ সাল থেকে। চলে ১৯৮০ পর্যন্ত । দশটি বছর আবু সায়ীদ কিভাবে তার উপস্থাপনা দিয়ে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তারই স্মৃতিচারণ করেন। এই সময় মূলত ধাঁধার, কুইজের এবং হাস্যরসের মাধ্যমে গভীর জীবনবোধ ছড়িয়ে দেয়ার নতুন উপস্থাপনা অনুষ্ঠান নির্মাণের ধারা চালু করেন। স্বপ্তবর্ণা, হারজিত, চতুরঙ্গ আনন্দমেলা প্রতিটি অনুষ্ঠানকে কিভাবে তিনি তার বুদ্ধিদীপ্ত, রসময় কথার মাধ্যমে জনপ্রিয় করেছিলেন তার সবিশষে বর্ণনা দিয়েছেন। সাথে অবধারিতভাবে দার্শনিক ভঙ্গিতে সাহিত্যবোধে লিখেছেন একটি জাতীয় টেলিভিশন তৈরি হওয়ার গল্প। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও বিনোদনের ভিত তৈরির সঙ্গে টেলিভিশনের সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায় বইয়ে। কিভাবে উপস্থাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও টেলিভিশন একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন তার বর্ণনা।
ঘোষক ও উপস্থাপকের পার্থক্য
বর্তমানে অনেকে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের কল্যাণে নানা ধরণের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন । কিন্তু আসলে লেখক মনে করেন বেশিরভাগ ঘোষক। উপস্থাপক নন। কারণ সায়ীদ মনে করেন, 'ঘোষণা কথার ব্যাপার, উপস্থাপনা ব্যক্তিত্বের ব্যাপার। উপস্থাপক কেবল অনুষ্ঠানের পাত্রপাত্রীর নাম ঘোষণা করেন না, নিজের ব্যক্তিত্বের বিভায় গোটা অনুষ্ঠান আলোকিত করেন।
অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যের তিনি ব্যাখ্যাদাতা, এর বেগবান জীবনপ্রবাহের মূল পরিচালনাকারি। তার ভেতরকার তীক্ষ্ণরসবোধ, সজীবতা, বিদ্যাবুদ্ধি, প্রতিভা, কল্পনাশক্তির স্বতস্ফুর্ততায় অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত। তার মননের আলো একে অর্থ দেয় । তিনি একই সঙ্গে এর স্বপ্ন দ্রষ্টা ও রূপকার। ফুল পাতা আর ডাল অপরূপ রূপে সাজিয়ে ইকেবানা শিল্পী যা করেন অনুষ্ঠানের উপকরণ দিয়ে উপস্থাপকও তাই করেন। অনুষ্ঠানে যা যা হবে তা যদি দামি উজ্জ্বল ও বর্ণাঢ্য হয় কিন্তু উপস্থাপক যদি মেধাহীন, ও অসার হয়, তবে সেই বিরাট সম্ভার নিয়েও গোটা অনুষ্ঠান নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে। কিন্তু উপস্থাপক যদি হন সপ্রতিভ ও জীবন সঞ্চারী, তবে অনেক সাধারণ জিনিষ দিয়েও তিনি অনুষ্ঠানকে অসাধারণ করে তুলতে পারেন। একটি অনুষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উপস্থাপক। তার প্রতিভার ও অনুষ্ঠানের সাফল্য মোটামুটি সমান।'
এ কারণেই লেখক বলছেন, সবাই উপস্থাপক নয়, কেউ কেউ উপস্থাপক। ভালো উপস্থাপক তিনিই যিনি তার নিজের তৈরি অনুষ্ঠানের চাইতে বড়- ইচ্ছা আনন্দে যিনি দর্শকদের রহস্যময় অচেনা পথে হাটিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। জনপ্রিয় উপস্থাপক হওয়া টোটকা দিয়েছেন কিভাবে তিনি তার প্রতিটি অনুষ্ঠানে গল্প বলে , ধাঁধা দিয়ে, কুইজ দিয়ে উপস্থাপনার ভিন্ন এক ধরণ তৈরি করেছিলেন সেটি তুলে ধরে।
'আমি এটা মনে করি না সবার কাছে কেবল জনপ্রিয় থাকার জন্য একজন উপস্থাপকের অনুষ্ঠান করা উচিত। সব সময় ভেবেছি অনুষ্ঠান করা উচিত ভালো অনুষ্ঠান করার জন্য। সত্যিকার ভালো জিনিস কখনো খুব বেশি জনপ্রিয় হয় না। হয়তো হওয়া উচিতও না। আমার ধারণা , অনুষ্ঠান করা উচিত নিত্য নতুন চরিত্র ও আঙ্গিকে। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে শিল্পের অপরিচিত দিগন্তকে স্পর্শের তাগিদে, সেই সাথে দর্শকদের উপকার ও আনন্দ দেয়ার জন্য।
বর্তমান বাণিজ্য নির্ভর টিভি চ্যানেলের সমালোচনাও করেছেন তিনি। 'আজকের বাণিজ্য নির্ভর টিভি-চ্যানেলগুলোর মতো অনুষ্ঠানকে শুধুমাত্র স্থূল জনরুচির সেবাদাসে পরিণত করতে থাকলে , কেবল বিনোদনের জন্য বিনোদন থাকলে, তারা মানুষকে ওপরে তোলার বদলে এক ধরণের লোল মজা আর অক্ষম স্বপ্নের নিষ্ক্রিয় আর উদ্দেশ্যহীন করে ফেলে।
উপস্থাপকের পোশাক
বর্তমানে উপস্থাপক মানে সুট টাই পরা, দামি শাড়িতে, গাউন পরা ঝকমকে এক তরুণ বা তরুণী। কিন্তু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সারাজীবন সাধারণ পাঞ্জাবি পরে উপস্থাপনা করেছেন। একজন উপস্থাপকের পোশাক কেমন হবে তারও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন নিজের গল্প বলে। পঞ্চাশ ষাট দশকের মুসলিম লীগের রাজনীতিবিদ ছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী। ইংরেজি সাপ্তাহিক সান পরবর্তীতে দৈনিক অবজারভারের প্রকাশক। লেখক হামিদুল হক চৌধুরীর নাতি ববির অফিসে মাঝে মাঝে আড্ডা দিতেন।
এখনকার মতো তখনো পরামর্শকের অভাব ছিলোনা। বির অফিসে ববির এক বন্ধু সাইয়িদকে পরামর্শ দেন পাঞ্জামা-পাঞ্জাবি ছেড়ে সুট টাই পরতে। তাহলে উপস্থাপককে আরো আকর্ষণীয়, আরো স্মার্ট আরো গ্রহণযোগ্য লাগবে। ববি খেপে গিয়ে বলেন, সায়ীদ আপনি কখনো তার কথা শুনবেন না। টিভিতে দর্শক আগে পোশাকের দিকে তাকায় না, আগে মানুষটাকে ভালোবাসে। তারপর তার পোশাক। পোশাকের উপর তাকেই জোর দিতে হয় যাকে মানুষ ভালোবাসেনা। সায়ীদ দর্শকরা আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছে, আপনি যাই পরবেন তাই তারা ভালোবাসবে। একজন উপস্থাপকের পারিবারিক মানুষ হিসেবে প্রিয় হয়ে ওঠা জরুরি।
ক্ষয়কালের প্রতিচ্ছবি বর্তমান টেলিভিশন!
বাংলাদেশে এখন টেলিভিশনের বাড়বাড়ন্ত। যোগ হয়েছে যে কোনো স্থান থেকে নিজেকে প্রদর্শনের সুযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কিন্তু কিছুই কি মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটতে পারছে? কেনো পারছে না তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন লেখক।
'আসলে এ নিয়ে টেলিভিশনের তেমন কিছু করার নেই। কারণ টেলিভিশন একটি মাধ্যম মাত্র তার নিজের কিছু করার নেই। সে নিজে কিছু সৃষ্টি করেনা। জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতির অঙ্গন থেকে যেসব ব্যক্তিত্ব, ,যোগ্যতা বা প্রতিভা জন্ম নেয় ,টেলিভিশন তাদের জাতির কাছে পৌঁছে দেয় মাত্র। আসল ধ্বস টেলিভিশন অঙ্গনে নয়। নেমেছে আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতির অঙ্গনে । এই অঙ্গন এখন পুরোপুরি নীরক্ত ও অন্ধকার। অর্থপূর্ণ কিছুরই আজ সে জন্ম দিচ্ছে না। টেলিভিশন পর্দাকে যারা জীবন্ত আর গতিশীল রাখবে'
গত দুই দশকে এমন একজন উজ্জ্বল ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষও আমাদের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে দেখা দেননি যারা কথার শক্তিতে বা ব্যক্তিত্বের ছটায় মানুষকে বিস্মিত ও সম্মোহিত করতে পারতেন।
মূলত লেখক বাংলা টেলিভিশন প্রথম দুই দশকের ব্যক্তিত্ব মুনীর চৌধুরী, ডক্টর হাসান জামান, শামসুল হুদা চৌধুরী, মোস্তফা কামাল (বিচারপতি), বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কলিম শরাফি, মোস্তফা মনোয়ারদের মতো সংস্কৃতিবান মানুষদের কথাই বলেছেন। প্রযুক্তি বাধাকে যারা নিজেদের কথা আর ব্যক্তিত্বের যাদুতে তুড়ি মেরে উড়িয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আজ সেই উচ্চতা কোথায়!
'আমার উপস্থাপক জীবন' প্রকাশ হয় ২০০৫ সালে। তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এতটা সর্বগ্রাসী হয়নি। দুই দশক পরে রুচির দুর্ভিক্ষ এখন আরও প্রকট। তখন টেলিভিশনের ঘুরে দাঁড়ানোর সর্বশেষ সুযোগ টুকুকে কাজে লাগানোর পরিবর্তে টেলিভিশন উদ্যোক্তারা লাইক ভিউয়ের পেছনে ছুটে এই মাধ্যমের মৃত্যু নিশ্চিত করছে। এই সময়েও যারা দর্শক হৃদয়ে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মৃতি অমলিন রাখতে চান তাদের জন্য অবশ্য পাঠ্য 'আমার উপস্থাপক জীবন'।
Comments