মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

নিজের নাম নিজেই রাখলেন ‘জ্ঞানানন্দ স্বামী’

জীবনের শেষ সময়ে তিনি যখন স্ট্রোক করে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলেন তখন না-পড়ার যন্ত্রণায় স্নেহের ছাত্র গোলাম সাকলায়নকে জানিয়েছেন: “পড়তেই যদি না পারলাম তাহলে এ জীবনের দাম কি?”

জন্মের সময় নাম রাখা হয়েছিল শেখ মুহম্মদ ইব্রাহিম (মতান্তরে মুহম্মদ ইব্রাহিম)। মা হুরুন্নেসা কিছুদিন পর ছেলের নাম পরিবর্তন করে রাখেন: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। আর তিনি নিজের নাম রাখলেন: 'জ্ঞানানন্দ স্বামী', অর্থাৎ জ্ঞানচর্চাতেই যার সুখ ও আনন্দ।

কৈশোর থেকেই ব‌ইয়ের সঙ্গে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব—পড়তেন শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ। স্মৃতিকথায় লিখছেন: "ছেলেবেলা থেকেই বাজে উপন্যাস আমি পড়তাম না। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের কিছু উপন্যাস পড়তাম, শরৎ চাটুজ্যের ব‌ইগুলি বেরোবার পরপরই পড়েছি। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা দেখে মাঝে মাঝে মনে হতো এমনি ধারা বিশ্ববরেণ্য কবি হতে পারলে মন্দ হতো না। আবার শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়ে খুশি হয়ে উঠতাম। মনে অন্য ভাবের উদয় হতো বটে। সেজন্যে তাঁদের কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস পড়ে সমালোচনা লিখেছি। বিদেশি সাহিত্য‌ও পড়েছি।" (গোলাম সাকলায়েন : ১৯৭০)

ঢাকার চকবাজার সংলগ্ন বেগমবাজারের ৭৯ নং বাড়ি, 'পেয়ারা ভবন'-এ জীবনের শেষ বত্রিশ বছর অর্থাৎ ১৯৩৭ সাল থেকে আমৃত্যু সপরিবারে বসবাস করেছেন। বাড়ির নিচতলায় বিশাল জায়গাজুড়ে ডক্টর শহীদুল্লাহর সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। গোলাম সাকলায়েনের বর্ণনায়: "যিনি আজীবন জ্ঞানসমুদ্র মন্থন করেছেন তাঁর বাড়ীটি তাঁর চরিত্রের‌ই অভিব্যক্তি যেন। বাড়ীর নিচতলায় আচার্য শহীদুল্লাহ্‌র পড়ার ঘর এবং লাইব্রেরী। লাইব্রেরীতে হরেক রকমের অসংখ্য ব‌ই। বিভিন্ন ভাষার। বাংলা, ইংরেজী, জার্মান, ফরাসী, ল্যাটিন, হিব্রু, আরবী, ফারসী, উর্দু, হিন্দী, আসামী, উড়িয়া, পালি, দেশী-বিদেশী নানা ভাষায় লক্ষ লক্ষ শব্দ বন্দী হয়ে আছে। সাজানো আছে আলমারীতে, শেলফে থরে থরে এবং প্রত্যেকখানি ব‌ই আচার্যের বহু বিনিদ্র রজনীর পড়াশোনার স্বাক্ষর বহন করছে।" (প্রাগুক্ত) 

১৯৫৪ সালে ঢাকা কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন অধিবেশনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (ডানে) ও ড. কাজী মোতাহের হোসেন (বামে)। ছবি: অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম

তিনি আরও বলেছেন: "তাঁর স্টাডিরুমে গেছি, ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার দেখেছি। বিচিত্র গ্রন্থাগার—বিচিত্র তার জ্ঞানপিপাসা। হরেক রকম ভাষার হরেক রকমের ব‌ই-পুস্তক-কেতাব এবং পাণ্ডুলিপি। এ গ্রন্থাগার ছিল তাঁর প্রিয় সম্পদ। দেখে মনে হয়েছে জ্ঞানের নেশায় খ্যাপার মতো ব‌ই সংগ্রহ করেছেন। বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি সাহিত্যের লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকদের ব‌ই-পুস্তক তো ছিলই তাঁর পুস্তকাগারে। তাছাড়া ফরাসী, জার্মান, ল্যাটিন, হিব্রু, আরবী, হিন্দী, উর্দু, অসমীয়া, উড়িয়া প্রভৃতি ভাষায় লিখিত ব‌ইও দেখেছি। ইউরোপীয় ভাষার মধ্যে ইংরেজি এবং ফরাসীতে লেখা ব‌ইয়ের সংখ্যাই বেশি। প্রত্যেকখানি ব‌ই তিনি সযত্নে পড়েছেন। ব‌ইয়ের মার্জিনে নোট লিখেছেন। স্বতন্ত্র প্রবন্ধ লিখেছেন ওসব নিয়ে।" (প্রাগুক্ত)

তার লাইব্রেরী এবং গ্রন্থ-সংগ্রহ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন: "কখনো ব‌ই এসেছে বার্লিন থেকে। কখনো লন্ডন এবং প্যারিস থেকে। কখনো কায়রোর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনিয়েছেন ব‌ই। বিদেশের অনেক দুষ্প্রাপ্য ব‌ইয়ের ফটোস্ট্যাট্ কপিও আনিয়েছেন। দরকারি ব‌ইয়ের জন্য অর্থ ব্যয় করতেন অকাতরে। কোনো ব‌ই দেশে নেই খবর পাওয়া মাত্র তক্ষুনি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন বিদেশে। কখনো ফটোকপি আনিয়েছেন, কখনো মাইক্রোফিল্মস করে এনেছেন গোটা ব‌ই।" (প্রাগুক্ত)

কাজী মোতাহার হোসেন সাক্ষ্য দিয়েছেন—'অবসরের দিনে চৌদ্দ-পনেরো ঘণ্টা বা তারও অধিক কাল কোরান তেলাওয়াত, গ্রন্থরচনা ও অধ্যয়ন' করতে দেখেছেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে। (স্মৃতিকথা : কাজী মোতাহার হোসেন) গোলাম সাকলায়েন সাক্ষ্য দিয়েছেন: "কোনো কোনো দিন রাতের খাবার খেতেন রাত বারোটা একটায়। তাঁর লাইব্রেরীতে পড়ছেন।" (গোলাম সাকলায়েন, প্রাগুক্ত)

রবীন্দ্রনাথের 'গীতিঞ্জলি' ছিল তার অনেক প্রিয় কাব্যগ্রন্থ। ১৯২৬ সালে প্যারিসে পিএইচডি করার জন্য যাত্রাপথে জাহাজে পড়ার জন্য দু'টি গ্রন্থ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন: আল কুরআন এবং গীতাঞ্জলি। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব এবং কুরআন হাদিসের উপর রচিত গ্রন্থ বেশি পড়তেন; সাথে সাথে বিশ্বসাহিত্যের সাথেও ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। 

আমাদের দেশের আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ঢাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হবার সুবাদে দেশের প্রথিতযশা লেখকবৃন্দ নিজেদের ব‌ই উপহার দিতেন, মন্তব্য শুনতে চাইতেন। গোলাম সাকলায়েন লিখছেন: "পেয়ারা ভবনে গেছি এক প্রসন্ন প্রহরে। দেখি তার পড়ার টেবিলে আদমজি পুরস্কারের জন্য দাখিল করা গাদা গাদা ব‌ই। জীবনস্মৃতি, গল্প, উপন্যাস ও কবিতার বই। ওগুলি তিনি সযত্নে পড়েছেন। একটি পৃথক ফর্দে এক একখানা পুস্তকের উপর মন্তব্য লিখেছেন, বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেছেন সংক্ষেপে। বললেন: 'আমার অনেক ছাত্রের অথবা প্রীতিভাজনের লেখা ব‌ইও থাকে পুরস্কারের জন্য। ঠিক ঠিক জাজমেন্ট দেয়া যে কত মুশকিল বুঝতেই পারছো। কাজেই খাটতে হয়। আমার দিক থেকে লাভ হলো এই যে, আমাদের দেশের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি ও প্রকরণ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে পারি।" (প্রাগুক্ত)

অবাক হ‌ই যখন গোলাম সাকলায়েনের কণ্ঠে বলি: "আচার্য শহীদুল্লার লেখাপড়ার নির্দিষ্ট সময়-সূচী ছিল না। দিনরাত‌ই পড়তেন। লিখতেন। গবেষণায় লিপ্ত থেকেছেন সবসময়। ট্রেনে অথবা প্লেনেও পড়াশোনা করতে দেখেছি। পড়াশোনায় তন্ময়তার ব্যতিক্রম দেখিনি কখনো। দু'চারখানি ব‌ই তাঁর নিত্যসঙ্গী হিসেবেই থাকতো।"

পড়াশোনা, গবেষণার তন্ময়তার এমন একটি সময়ের সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি: "রাজশাহীর লোকনাথ হাইস্কুলের পণ্ডিত মনীন্দ্রমোহন চৌধুরী কাব্যতীর্থ। তিনি 'আদ্য-পরিচয়' নামক মধ্যযুগের বাংলা পাণ্ডুলিপিখানি সম্পাদনা করে প্রকাশ করার পক্ষপাতী। চৌধুরী মশাই পুঁথিখানি সম্পাদন করতে ইচ্ছুক হলেও প্রাচীন পুঁথি-পাণ্ডুলিপির হস্তলিপি পাঠে অভ্যস্ত নন। তিনি ধরে পড়লেন আচার্য শহীদুল্লাহ্‌কে। শহীদুল্লাহ্ সাহেব‌ও পুলকিত হলেন। আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তিনি 'আদ্য-পরিচয়'র একটি মাত্র পাণ্ডুলিপি নেড়েচেড়ে ভালো করে দেখলেন। তারপর পুঁথিখানির পাঠ-উদ্ধারের কঠিন কাজে লেগে গেলেন। চৈত্রের কাঠফাঁটা রোদ্দুর। ভয়ানক তাপ। ঘরে বাইরে তিষ্ঠানো দায়। দেখেছি আচার্য শহীদুল্লাহ্ লুঙ্গি পড়েছেন। গায়ের জামা-গেঞ্জি খুলে তুলে রেখেছেন আলনায়। তিনি একাগ্রচিত্তে 'আদ্য-পরিচয়'র পাঠ-উদ্ধারে মগ্ন। নিদারুণ গরমে বিন্দু বিন্দু স্বেদ চুইয়ে পড়ছে। ভিজে উঠেছে সমস্ত শরীর। কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই শহীদুল্লাহ্ সাহেবের। নতুন কোনো পুঁথি-পাণ্ডুলিপি পেলে অথবা গ্রন্থ পেলে সেটি পড়ে শেষ না করা অবধি তিনি স্বস্তি পেতেন না। নতুন তত্ত্ব ও তথ্যের অন্বেষায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। ভুলে যেতেন বার্ধক্যের কথা।" (প্রাগুক্ত)

আচার্য জ্ঞানতাপস শহীদুল্লাহর একটি অভ্যাস ছিল, তিনি পারতপক্ষে কাউকে ব‌ই ধার দিতেন না। কেন? তাঁর জবাব: "লোকে প্রয়োজনের সময় এসে ব‌ই নিয়ে যায়, পরে আর ফেরৎ দেয় না। অনেক দামী ব‌ই এভাবে খোয়া গেছে।" তাঁর কাছে কেউ ব‌ই চাইতে গেলে কৌতুকের সঙ্গে বলতেন:

"লেখনি পুস্তিকা জায়া পর হস্তং গতাগতা।
যদি সা পুনরায়াতি ভ্রষ্টা নষ্টা চ মদিতা॥"

অর্থাৎ ব‌ই, কলম এবং স্ত্রী যদি পরহস্তে যায় তাহলে ফিরে পাবার সম্ভাবনা নেই। যদিওবা ফিরে পাওয়া যায় তবে তার পূর্বের অবস্থা আর থাকে না।

তিনি তাঁর ছাত্রদের রচনা, বই যত্নের সঙ্গে পড়তেন। পড়ে মন্তব্য জানাতেন এবং উৎসাহিত করতেন। গোলাম সাকলায়েন লিখছেন: "ডক্টর শহীদুল্লাহ তাঁর ছাত্রদের রচনাও অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে পড়েন এবং দরকার হলে কাটিং নিতেও কার্পণ্য করেন না। কেবল ছাত্রদের প্রতি প্রীতি-ভালোবাসার জন্য‌ই নয়, একবার পড়ে যদি কোনো রচনা তাঁর ভালো লাগতো তাহলে সেটা সংরক্ষণ করতেন যত্নের সঙ্গে। কোনো ছাত্রের লেখা ব‌ই-পুস্তক ভালো লাগলে তিনি অকুণ্ঠ তারিফ করতেন। বলতেন, 'অমুকের ব‌ইখানা অথবা নিবন্ধটি ভারী সুন্দর। বেশ খেটেই লিখেছে।' আচার্য শহীদুল্লাহ নিজে প্রথম শ্রেণীর লেখক এবং পাঠক হয়েও অন্যের লেখা বই এন্তার পড়তেন, সুখ্যাতি করতেন। কখনো কুণ্ঠা দেখিনি তারিফ করতে।" (প্রাগুক্ত)

তাঁর সমৃদ্ধ লাইব্রেরিটি নিয়ে ভীষণ চিন্তা ছিল; জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক যেমন 'উইল' করে যেতে চেয়েছিলেন তেমনি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ‌ও লাইব্রেরির একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন: "আমি ভাবছি আমার বহু পরিশ্রমে গড়া ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর কথা। আমার মৃত্যুর পর লাইব্রেরী যাতে রসাতলে না যায় তার ব্যবস্থা করে যেতে চাই।"

কিন্তু পেরেছিলেন কি? তিনি সবসময় খুব জোরের সঙ্গে বলতেন: "দেখো, ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার না হলে কেউ লেখক হতে পারে না। হতে পারে না গবেষক ও পণ্ডিত। লেখক ও সাহিত্যিক হ‌ওয়ার পূর্বশর্ত হলো, মূল্যবান গ্রন্থের সংগ্রহশালা নির্মাণ।" (প্রাগুক্ত) তার এ উপদেশ নবীন লেখক, সাহিত্যিকদের জন্য সর্বদা স্মরণীয়।

লেখক ও সাংবাদিক শান্তা মারিয়া লিখছেন: "প্রায়ই বলতেন, বই এবং বউ তার সবচেয়ে প্রিয়। তার চকবাজারের বাড়িতে ছিল বিশাল লাইব্রেরি। বাড়িতে যতক্ষণ থাকতেন ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারেই পাঠে নিমগ্ন থাকতেন। পাণ্ডিত্যের জন্য তাকে বলা হতো চলন্ত অভিধান।"

অনেকবার তিনি নিকটস্থ ছাত্রদেরকে বলেছিলেন: "বুক ওয়ার্ম অর্থাৎ গ্রন্থকীট বলে যে একটি কথা চালু আছে বলতে পারো আমি সেই গ্রন্থকীট। যদি কখনো সরকার আমার উপর বিরক্ত হয়ে আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে তাহলে আমার কোনোই অসুবিধা হবে না যদি মনের মতো ব‌ই পড়তে পাই। সেটাই হবে আমার সবচে' বড় শাস্তি যদি ব‌ই থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।"

জীবনের শেষ সময়ে তিনি যখন স্ট্রোক করে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলেন তখন না-পড়ার যন্ত্রণায় স্নেহের ছাত্র গোলাম সাকলায়নকে বলছেন: "পড়তেই যদি না পারলাম তাহলে এ জীবনের দাম কি?"

Comments

The Daily Star  | English

All educational institutions reopen after heatwave-induced closures

After several closures due to the heatwave sweeping the country, all primary and secondary schools, colleges, madrasas, and technical institutions across the country resumed classes today

33m ago