‘মুজিব ভাই থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইনি’
অনেক নেতার 'গুরু' ও পথপ্রদর্শক সিরাজুল আলম খান। মেধায়, পরিশ্রমের শক্তিতে এবং সংগঠন গড়বার ক্ষমতায় সিরাজুল আলম ছিলেন অসাধারণ; আগামীতে তিনি যে কিংবদন্তী হয়ে উঠবেন তার লক্ষণ তখনই দেখা যাচ্ছিল। মাহবুবের দু'বছরের পরের একজন ছাত্র মহিউদ্দিন আহমদ; সে-কালের রাজনীতি নিয়ে তার লেখা দু'টি বইতে মাহবুবের কথা বেশ ভালো ভাবে আছে।
তবে সিরাজুল আলম বের হয়ে গিয়েছিলেন তার মুজিব ভাইয়ের দল থেকে, মাহবুবও ছেড়েছিল তার 'গুরু'র জাসদকে। কিন্তু দুই বিচ্ছেদের ভেতর মৌলিক পার্থক্য ছিল। সিরাজুল আলম আওয়ামী লীগ ছেড়েছেন, কিন্তু শেখ মুজিবের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করেন নি, মুজিববাদও ছাড়েননি। মাহবুব সিরাজুল আলমকে ছেড়েছিল সম্পূর্ণরূপে, কারণ তাদের ব্যবধানটা দাঁড়িয়েছিল মতাদর্শিক।
এই দেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল বইতে মহিউদ্দিন তার নিজের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন ছাত্রলীগের সঙ্গে; এবং তাঁর নিজের ভাষ্যমতে এর পেছনের মূল কারণ মাহবুব। মাহবুব ছিল চোখে-পড়বার মতো মেধাবী ও কর্মঠ, এবং দুর্দান্ত সাহসী। কিন্তু যে গুণটি মহিউদ্দিনকে অভিভূত করেছিল সেটি পুরোপুরি মানবিক।
মহিউদ্দিনের পক্ষে সিরাজ-মাহবুব বলয়ের ভেতরে না-ঢুকে উপায় থাকেনি। এবং তার আপেক্ষিক-ভাবে-সীমিত রাজনৈতিক জীবনের সবটাই কেটেছে ওই বলয়ের ভেতরেই। মানবিক গুণে সিরাজুল আলমও ছিলেন অসাধারণ। তিনি স্মরণ করেছেন যে একাত্তরের যুদ্ধ শেষে ঢাকায় ফিরে তিনি অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় আশ্রয় পেয়েছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক ভবনে; খবর পেয়ে অনেক রাতে এসে হাজির হন সিরাজুল আলম এবং তাকে নিয়ে যান জহুরুল হক হলে। সেখানে থাকা অবস্থাতে ৮ জানুয়ারী খবর পাওয়া গেল শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগারে থেকে মুক্ত হয়েছেন।
খবরটা শুনে অন্য সবার মতো মহিউদ্দিনও অত্যন্ত উদ্বেলিত হয়েছিলেন, এবং সিরাজুল আলমকে বলেছিলেন, "চলেন, আমরা আজ চাইনিজ খাই।" সিরাজুল আলমের প্রতিক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত মানবিক। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিনি বলেছিলেন, "এখন আনন্দের সময় নয়। কত লোক মারা গেছে, কত লোক সর্বস্বান্ত হয়েছে।" বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাটা ছিল পিতৃতান্ত্রিক; মূল রাজনীতির তো অবশ্যই, ছাত্র রাজনীতির চরিত্রটাও ছিল ওই রকমেরই, কিন্তু সিরাজুল আলম ও মাহবুবুল হক দু'জনের ভেতরেই পিতৃতান্ত্রিক নেতৃত্বদানের তৎপরতার অভ্যন্তরের একটি মাতৃহৃদয় ছিল সংগুপ্ত, যেটি মানুষকে কাছে টেনে নিতো, দূরে সরিয়ে দেবার পরিবর্তে।
গুরু-শিষ্যের বড় রকমের আরেকটি মিলও ছিল। অনার্স শেষ করে দু'জনের কেউই আর ছাত্র থাকেননি, রাজনীতিতে সার্বক্ষণিক হয়ে গেছেন। উভয়েই যে মেধাবী ছিলেন সেটার প্রতিফলন দেখা গেছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতে তাঁদের সাফল্যেও। সম্প্রতি-প্রকাশিত আত্মজৈবনিক রচনা, আমি সিরাজুল আলম খান-এ সিরাজুল আলম এক জায়গাতে নিজের সম্পর্কে বলেছেন, "ছাত্র হিসেবে আমি খুব মেধাবী ছিলাম। ভাবতাম মেট্রিকে প্রথম স্থান অধিকার করবো। শিক্ষকরাও তাই মনে করতেন। পরীক্ষার ফলাফল বের হবার পর দেখলাম আমার স্থান দশের মধ্যেও নেই। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম আমার স্থান ছিল ১৮তম।" এক্ষেত্রে শিষ্য কিন্তু গুরুকে ছাড়িয়ে গেছে। মেট্রিকে সে চতুর্থ স্থান পেয়েছিল। আইএতে তার স্থান ছিল একাদশতম। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিরাজুল আলম অনার্স পড়েছেন গণিত বিষয়ে, মাহবুব অর্থনীতিতে। ভালো ফল-করা ছাত্ররা সেকালে রাজনীতিতে তেমন একটা আসতো না, এলেও টিকতো না; আর যারা স্ট্যান্ড করতো তাদের প্রবণতা দাঁড়াতো ভালো ফল করাটাকে অব্যাহত রাখা, এবং পাস করে সরকারী চাকরীতে ঢুকে পড়া। ব্যতিক্রমীরাও ছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এই দু'জন, এই গুরু-শিষ্য। ছাত্র ইউনিয়নে স্ট্যান্ড করাদের তাও পাওয়া যেতো, ছাত্রলীগে তারা বলতে গেলে দুর্লভই ছিল।
সিরাজুল আলমের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দানের পেছনে সিরাজুল আলমের চিন্তা ও পরিকল্পনার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। স্বাধীনতার পরে নিতান্ত বাধ্য হয়েই তিনি মুজিববিরোধী রাজনীতি গড়ে তোলাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যক্তি মুজিবের প্রতি তাঁর আনুগত্য কখনোই ক্ষুণ্ণ হয়নি। আত্মজৈবনিক রচনাটির একবারে শেষ প্রান্তে এসে তিনি জানাচ্ছেন, "ছাত্রলীগের দ্বিধাবিভক্তির পরও আমি রব-গ্রুপ ছাত্রলীগকে শেখ মুজিবের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে আনার কোনো চেষ্টাই করি নি।" বলছেন, "একইভাবে আমিও মুজিব ভাই থেকে কোনোভাবেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই নি।" (১৭৯-৮০)
এটাও অবশ্যই খেয়াল করবার ব্যাপার যে মুজিব শাসনামলে জাসদের সকল নেতা তো বটেই হাজার হাজার কর্মীও কারাবন্দী হয়েছে, প্রাণও দিয়েছে অনেকে, কিন্তু মূল নায়ক সিরাজুল আলম একবারও গ্রেফতার হন নি। শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তো ছিলই, দেখাসাক্ষাত পর্যন্ত হয়েছে। মুজিব তাঁকে বাকশালে যোগ দিতে বলেছিলেন, এবং নিরাপত্তার খাতিরে সাময়িক ভাবে অন্যত্র চলে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সিরাজুল আলম সেই পরামর্শ অনুযায়ী ভারতে চলে যান, এবং সেখানে অবস্থানরত অবস্থাতেই ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের খবরটা তাঁকে শুনতে হয়। 'মুজিববাদ'কে জনপ্রিয় করায় এমনকি ওই নামকরণেও তার ভূমিকাই ছিল প্রধান। শেখ মুজিব যদি সম্মত হতেন তবে সিরাজুল আলমরা ভরসা করতে পারতেন যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। শেখ সাহেব সম্মত হননি বলেই সিরাজুল আলম তার সাংগঠনিক শক্তিকে 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার জাসদীয় আন্দোলনটি গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছেন। তাতে ক্ষতি হয়েছে উভয়পক্ষের। দেশের লাভ লোকসানের হিসাবটা ভিন্ন।
১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের যে সম্মেলনটিকে উপলক্ষ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দু'টি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায় সে বিভাজনটা অনিবার্যই ছিল; কারণ সিরাজপন্থীরা মনে করতো তারা প্রগতিশীল এবং বিপরীতপক্ষকে বলতো প্রতিক্রিয়াশীল। তবে কর্মীদের ভেতর এই বিভাজন যতোটা সত্য ছিল নেতাদের ক্ষেত্রে ততোটা সত্য ছিল না। নেতাদের কেউ কেউ যে-জাতীয়তাবাদী পথটা ধরে নিজেদের যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেখানেই থেকে গেছেন। আবদুর রাজ্জাক ছিলেন সিরাজুল আলমের নিকট সহযোগী, শুরুতে প্রায় অবিচ্ছিন্নই ছিলেন তারা; কিন্তু বিভাজনের সময়ে রাজ্জাক কথিত প্রগতিশীলদের সঙ্গে থাকেননি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই রয়ে গেছেন।
সিরাজুল আলম নিজেও তো জাতীয়তাবাদের বৃত্তটা ভেঙে যে বের হয়ে যাবেন তা পারেননি। বৃত্তটাকে তিনি প্রসারিত করেছেন, হাজার হাজার তরুণকে, যারা বিপ্লব করতে চাইছিল তাদেরকে নিয়ে এসেছেন কাছে টেনে। এরা আওয়ামী রাজত্ব চায় নি, বিপ্লব চেয়েছিল, এবং তাদের রাজনীতি আওয়ামী লীগকে সরিয়ে নিজেরা সেখানে বসে পড়বে এই আশার দ্বারা পরিচালিত ছিল না, আকাঙ্ক্ষা ছিল সমাজ বিপ্লবের। জাসদ গঠিত না হলে এই তরুণদের অনেকেই হয়তো কমিউনিস্ট হতো। জাসদপন্থী তরুণদের কাছে তখনকার কাজটা মনে হচ্ছিল বিপ্লবী। চরম রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন সহ্য করার রোমাঞ্চকর প্রতিশ্রুতি তো ছিলই, ছিল সমাজবিপ্লব সম্ভব করে তোলার দুঃসাহসিক প্রতিজ্ঞাও, যে প্রতিজ্ঞাটি তারা লক্ষ্য করেছে বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভেরার মধ্যে। তারা নির্বাচন দেখেছে, দেখেছে নির্বাচনে দেশ স্বাধীন হয়নি, এমন কি ক্ষমতার হস্তান্তরও ঘটেনি, তারা দেখেছে যে তাদেরকে যুদ্ধে যেতে হয়েছে, এবং যুদ্ধশেষে চোখের সামনে দেখতে বাধ্য হয়েছে যারা ক্ষমতায় বসে গেছে তারা লুণ্ঠন, জবরদখল, চোরাচালানি, প্রতিপক্ষের মানুষকে খুন করাসহ হেন অপকর্ম নেই যা করা থেকে বিরত থেকেছে। বিপ্লবের স্বপ্নে-স্পন্দিত এই তরুণরা আদর্শের জন্য প্রাণদানে প্রস্তুত ছিল। বলাবাহুল্য মাহবুব ছিল এদের অগ্রবর্তীদের একজন। যুদ্ধপূর্ববর্তী বিপ্লবী স্বপ্নকে সে বহন করছিল দুর্দমনীয় উৎসাহে।
যুদ্ধের ভেতর দিয়ে তারুণ্যের যে শক্তির অসম্ভব এক বিকাশ ও বিস্ফোরণ ঘটেছিল লুণ্ঠন-নিয়োজিত আওয়ামী লীগের পক্ষে তাকে কোনো ভাবেই ধরে রাখা সম্ভব ছিল না। সিরাজুল আলম এটা বুঝেছেন। ওই বিকাশ ও বিস্ফোরণের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগটা ছিল প্রত্যক্ষ ও সার্বক্ষণিক। এই শক্তিকে তিনি উদ্বুদ্ধও করেছেন। ধারণা করা খুবই সম্মত যে একে ধরে-রাখা এবং কাজে লাগাবার জন্যই তারুণ্যে ভরপুর ও অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী অবস্থান থেকে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠনের, যে-সরকারে তিনি মোহাম্মদ তোয়াহাকে, এমনকি সিরাজ সিকদারকেও নিয়ে আসতে পারবেন বলে ভরসা করছিলেন। তিনি জানতেন যে এদের নাম শোনা মাত্র আওয়ামী লীগের মুশতাকপন্থী ও শেখ মনিপন্থীরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবেন, কিন্তু এও জানা ছিল তার যে সিরাজ সিকদার তো বটেই, মোহাম্মদ তোয়াহাও হানাদারদের বিরুদ্ধে সামনাসামনি লড়াই করেছেন; এবং তাঁরা দু'টি শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্বও করতেন। হয়তো ভেবেছেন যে সবাইকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ছাতার নীচে নিয়ে এলে লাভ হবে 'মুজিবাদের'ই। প্রস্তাবটিকে বঙ্গবন্ধু নাকচ করে দেন নি, কিন্তু গ্রহণ করাটা ছিল একেবারেই অসম্ভব। সিরাজুল আলম জানাচ্ছেন,
তখনকার গণভবনের সবুজ চত্বরে একদিন সন্ধ্যায় আমার কাঁধে হাত রেখে বঙ্গবন্ধু অনেকক্ষণ হেঁটেছিলেন। এক পর্যায়ে বলেই ফেললেন, "পারলাম নারে সিরাজ।" আওয়ামী লীগের সকলেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। (আমি সিরাজুল আলম খান, পৃ ১৫৭)। আবার জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠনের চিন্তার পেছনে আরও একটি বাস্তবিক উপলব্ধি কাজ করছিল; তার বর্ণনায় সেটি ছিল এ রকম : বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে সশস্ত্র যুদ্ধের সংগঠন ও পরিচালন প্রক্রিয়া এবং তার অগ্রগতির বিবরণ, যুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর বাইরেও ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক বিশেষ করে তরুণদের ভূমিকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করতে পারেন নি। এ সম্পর্কে তার বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা ছিল না। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলশক্তিটিকে তিনি কখনোই বুঝতে বা ঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন নি। (১৫৮-৫৯)
ছাত্রলীগের সম্মেলনের মুহূর্তে যে বিভাজনটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সিরাজুল আলম চেয়েছিলেন যে তাতে 'বিপ্লব'পন্থীদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুই থাকুন। সিরাজুল আলম স্মরণ করেছেন যে, একই দিনে দু'জায়গায় ছাত্রলীগের দুই অংশের দু'টি সম্মেলন অনুষ্ঠান-আয়োজনের আগের রাতেও 'মুজিব ভাইয়ে'র সঙ্গে তাঁর একান্তে আলোচনা হয়। তাঁর ধারণা ছিল মুজিব দুই সম্মেলনের কোনোটিতেই যাবেন না। ধারণা শুধু নয়, ছিল আশাও। কিন্তু সে-রাতে জানলেন ঘটনা ভিন্ন। সিরাজুল আলম বলছেন, বঙ্গবন্ধু রবদের সম্মেলনের জন্য আমাকে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বললেন, 'সিরাজ, আমি কমিউনিস্ট হতে পারবো না।' সিরাজুল আলম হয়তো নেতাকে বোঝাবার চেষ্টা করতে পারতেন যে তাঁকে কমিউনিস্ট হতে হবে না, এবং তরুণদেরকে কমিউনিস্ট হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্যেই বরং ওই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে, কিন্তু সে-সুযোগ তিনি পাননি।
এর পরে সিরাজুল আলম পরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধ্বনি তুলেছেন, কিন্তু ওই ধরনের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে ধরনের সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও সংগ্রাম প্রয়োজন সেটা তাঁর জানবার কথা নয়, জানতেনও না। তবে নতুন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের কথা না-বলে যে আর জনপ্রিয় রাজনীতি করা যাবে না সেটা তাঁর উপলব্ধিতে পরিষ্কার ভাবেই এসে গিয়েছিল। যুদ্ধের আগে স্বাধীনতার কথা বলেছেন, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, এখন কী বলবেন, সেটাই ছিল প্রধান সমস্যা। ঊনসত্তরে-সত্তরে-একাত্তরে 'জয় বাংলা'র আওয়াজ দিয়ে ছাত্রলীগের তরুণকে উদ্বুদ্ধ করা গিয়েছিল। কমিউনিস্ট বলে পরিচিত ছাত্ররা সেদিন 'জয় সর্বহারা' আওয়াজ দিয়েছে, কিন্তু তাদের আওয়াজটা তেমন জমে নি। একাধিক কারণে। প্রথমত যারা এই আওয়াজ দিচ্ছিল তারা নিজেরা কেউই সর্বহারা ছিল না, বরঞ্চ অল্প মাত্রাতে হলেও সামাজিক অবস্থানে ছাত্রলীগের কর্মীদের চেয়ে উঁচুতেই ছিল। দ্বিতীয়ত সর্বহারাদেরকে তো ছাত্র-যুবকদের আশেপাশে কোথাও দেখা যায় নি। সর্বোপরি 'জয় বাংলা'র ভেতরে বাঙালীর ওপর পাঞ্জাবী শাসকদের শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত যে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছিল 'জয় সর্বহারা' ও 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' দিয়ে তা প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না।
'জয় বাংলা'র লোকেরা যখন বলছিল 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা' তখন তাদের ওই আওয়াজ এমন গভীরে গিয়ে হানা দিয়েছে যেখানে 'তোমার আমার ঠিকানা, খেত খামার আর কারখানা'র আওয়াজের পক্ষে যাওয়াটা ছিল দুঃসাধ্য। মধ্যবিত্তের জন্য পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তো দৃশ্যমান, ওইসব নদী তো বাস্তবে সত্য, সত্য তারা কল্পনাতেও; খেত-খামার-কারখানা অনেক দূরের। কেবল দূরের নয়, সেসব জায়গাতে মধ্যবিত্ত যেতেও চায় না। ভয় করে সে অনেক কিছুকেই, সব চেয়ে বড় ভয় তার কৃষক ও শ্রমিক হওয়াকে। সমাজতন্ত্রের রণধ্বনি, 'শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো', কি দাঁড়াতে পারে 'বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো'র কাছে? পারবার কথা নয় এবং পারেও নি। একই ভাবে 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান'ও এক সময়ে হারিয়ে দিয়েছিল 'দুনিয়ার মজদুর এক হও'কে। জাতীয়তাবাদী আবেগ সবসময়েই অধিক শক্তিশালী আন্তর্জাতিকতাবাদের তুলনায়।
কিন্তু একাত্তরের শেষে 'জয় বাংলা' নিয়ে জাতীয়তাবাদীদের জন্য একটা সমস্যা দেখা দিল। সেটা এই যে ওটা তো ছিল স্বাধীনতার ডাক, স্বাধীনতা যখন এসে গেল তখন তো ওই ডাকে আগের মতো না কাঁপে গলা, না কাঁপে হৃদয়। স্বাধীনতা সোনার বাংলা দূরে থাক, মানবিক বাংলাও আনতে পারে নি। স্বাধীনতার সংগ্রামে 'সোনার বাংলা শ্মশান কেন' নামের একটি পোস্টার যে পরিমাণের আবেগ জাগিয়ে তুলেছিল তার তুলনা বিরল। বৈষম্যের নানাবিধ মূর্ত চিত্রের ভেতর চালের দামের খবরটাও ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে যে চালের মণ ২৫ টাকা পূর্ববঙ্গে তার মণ ৫০ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। আশা ছিল দাম ওই দাম পঁচিশেও থাকবে না, নেমে যাবে দশে। কিন্তু দেখা গেল দৌড়টা একেবারেই উল্টো দিকে। চালের মণ প্রথমেই হলো এক শ', তারপরে লাফিয়ে লাফিয়ে মহানন্দে সে পৌঁছে গেল তিন শ' টাকায়।
সিরাজুল আলম খানের যে অনুসারীরা একদা তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে আওয়াজ তুলেছিল 'বিশ্বে এলো নতুন বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ', 'বিশ্বে এলো তৃতীয় বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ' তারাই এখন গলা ফাটানো শুরু করলো 'তিন শ' টাকা চালের দাম, এরই নাম 'মুজিববাদ', বলে।
এমনটা যে ঘটবে প্রখরদৃষ্টি সিরাজুল আলমেরা তা আগেই আঁচ করেছিলেন। 'জয় বাংলা'তে কুলাবে না, 'মুজিববাদ'ও গ্রাহ্য হবে না, এই বোধটাই তাদেরকে বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত করেছে সমাজতন্ত্রের রণধ্বনি তুলতে। সমাজতন্ত্রের কথা ছাত্রলীগের রক্ষণশীল অংশও বলছিল, বাধ্য হয়েই; কিন্তু তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা ভাবেনি, ভেবেছে 'গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে'র কথা, যেটা সোনার পাথর বাটির চেয়ে কম ভুয়া নয়।
আত্মজৈবনিক রচনাটিতে সিরাজুল আলম স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে জাসদ গঠনের পেছনে তাদের যে উপলব্ধি কাজ করেছে তার এক নম্বরটি ছিল এই রকমের: "যে-জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন হলো সেই 'বাঙালী জাতীয়তাবাদ' দলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে থাকতে হবে।" উপলব্ধির দুই নম্বরে সমাজতন্ত্র এসেছে, কিন্তু জাতীয়তাবাদকে পেছনে ফেলে নয়, মাথাতে রেখেই; বলা হয়েছে, "জাতীয়তাবাদকে ধারণ করার পাশাপাশি আমাদেরকে সমাজতন্ত্রের অভিমুখে নিজেদেরকে চালিত করতে হবে।" অর্থাৎ জাতীয়তাবাদই প্রধান, সমাজতন্ত্র হচ্ছে পরবর্তী বিবেচনা।
Comments